মীযানুল করীম :
তুরস্কের ইতিহাসের বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে ওসমানীয় সাম্রাজ্য। পাশ্চাত্যে এটি ‘অটোম্যান এম্পায়ার’ এবং মুসলিম বিশ্বে ‘ওসমানি খিলাফত’ নামে সমধিক পরিচিত। এই শাসক বংশের প্রতিষ্ঠাতা ওসমানের নামের বিকৃত রূপ ‘অটোম্যান’। ওসমানি সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই ছিল জনকল্যাণকামী, দূরদর্শী, উদার ও অসাম্প্রদায়িক।
ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের সূচনা ১২৯৯ সালে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এটি দুর্বল হয়ে পড়লেও টিকে ছিল ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত। সে মোতাবেক এর স্থায়িত্বকাল ৬২৫ বছর, যা বিশ্বে একটা রেকর্ড বৈকি। এ সাম্রাজ্যের শাসক ‘সুলতান’ ও ‘খলিফা’ এ দু’টি পদবির মাধ্যমে যথাক্রমে রাজনৈতিক গুরুত্ব ও ধর্মীয় ঐতিহ্য বহন করতেন। যদিও ইসলামের স্বর্ণযুগের খিলাফতের সাথে ওসমানি বংশের রাজত্বের তুলনা চলে না, তবুও স্বীকার করতে হয়Ñ তুরস্কের এই খলিফা তার বাস্তব কর্তৃত্বের আওতাবহির্ভূত অনেক দেশেও মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও মর্যাদার প্রতীকরূপে গণ্য হতেন।
ওসমানি সাম্রাজ্যের শক্তি ও ক্ষমতা তুঙ্গে ছিল ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে। তখন এর অন্তর্ভুক্ত ছিল মধ্য ইউরোপ থেকে মধ্য এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ। এর মধ্যে ছিল ২৯টি প্রদেশ। আরো ছিল অসংখ্য করদরাজ্য। এগুলোর একাংশ পুরোপুরি করায়ত্ত করে নেয়া হলেও অন্যরা নানামাত্রিক স্বায়ত্তশাসন ভোগ করেছে বিভিন্ন শতাব্দীতে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সুদূর মহাসাগরের কোনো কোনো দ্বীপও তুর্কি সুলতানের আনুগত্য ঘোষণা করেছিল। যেমন পূর্বে ইন্দোনেশিয়ার আচেহ অঞ্চল এবং পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগরের লাঞ্জারোটে দ্বীপপুঞ্জ এভাবে তুরস্কের সাময়িক নিয়ন্ত্রণে এসেছিল যথাক্রমে ১৫৬৫ ও ১৫৮৫ সালে।
বর্তমান ইস্তাম্বুল ছিল তুর্কি ওসমানি সাম্রাজ্যের রাজধানী। প্রাচীন নগরটি ইউরোপে কনস্টান্টিনোপল, তুরস্কে কুস্তানতিনিইয়ে এবং আরবে কুস্তুনতানিয়া নামে অভিহিত হতো। দুই মহাদেশের সংযোগস্থল ইস্তাম্বুল থেকে শাসনের সুবাদে ওসমানি সাম্রাজ্য ৬০০ বছর ছিল প্রাচ্য-প্রতীচীর মিথস্ক্রিয়ার প্রাণকেন্দ্র।
১৩০০ সালের মধ্যে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ায় আনাতোলিয়ার বেশির ভাগই হাতছাড়া হয়ে যায়। তখন যে ১০ জন ‘গাজি’ শাসকের অধীনের অঞ্চলটি বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, তাদের একজন প্রথম ওসমান। তার নামেই ওসমানি বা অটোম্যান সাম্রাজ্য। তিনি রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়ে রাজধানী বুর্সায় নিয়ে যান। সাহসের জন্য তাকে ‘কারা’ (মহান বা শক্তিশালী) বলা হতো। তার গতিশীল সুশাসনের প্রমাণ শত শত বছরের এই তুর্কি প্রবাদ, ‘সে যেন ওসমানের মতো মহৎ হয়’। ওসমান নাকি স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার সাম্রাজ্য হবে তিন মহাদেশে বিস্তৃত। বাস্তবে পরবর্তীকালে এটাই সত্য হয়েছে।
ওসমানের পরবর্তী শতাব্দীতে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় ও বলকান অঞ্চল তুর্কিদের করতলগত হয়। ১৩৮৯ সালে কসোভোর যুদ্ধে তুর্কি বিজয় সার্বিয়ার শক্তির অবসান ঘটিয়ে ইউরোপে ওসমানি সাম্রাজ্য প্রসারের পথ খুলে দেয়। ‘মধ্যযুগের শেষ বৃহৎ ক্রুসেড’ নিকোপলিসের যুদ্ধ ১৩৯৬ সালে তুর্কি অগ্রযাত্রা রুখতে ব্যর্থ হয়। তবে ইস্তাম্বুলের চার পাশে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সব এলাকা দখলে নিলেও নগরটি তখনো জয় করা হয়নি।
এ দিকে তৈমুর লং ১৪০২ সালে আংকারার যুদ্ধে হারিয়ে তুর্কি সুলতান বায়েজিদকে বন্দী করে। এরপর বায়েজিদের ছেলেরা পরস্পর যুদ্ধ করেন ১১ বছর। মেসিডোনিয়া ও কসোভো হাতছাড়া হলেও সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ পরে এসব উদ্ধার করেন।
১৪৫৩ সালে ইস্তাম্বুল বিজয় বিশ্ব ইতিহাসের একটি স্মরণীয় ঘটনা। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী এই মহানগরী। তখনকার তুর্কি সুলতান, তথা ওসমানি শাসক মোহাম্মদ সশস্ত্রবাহিনীসহ রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের পর ইস্তাম্বুল জয় করে সামরিক নৈপুণ্যের প্রমাণ দিয়েছিলেন। তখন তার বয়স মাত্র ২১। আর দিনটি ২৯ মে, ১৪৫৩। তিনি এ নগরে রাজধানী স্থাপনের সাথে ‘কায়সারে রুম’ (রোমের সম্রাট) উপাধি গ্রহণ করেন। এই পদবির দাবিদার ছিলেন রুশ সম্রাট বা জারও। উপাধির যথার্থতা প্রদর্শনের জন্য মোহাম্মদ পশ্চিম রোমক সাম্রাজ্যের রাজধানী রোম জয়ে মনস্থ করেন। তখন তুর্কি ফৌজ ইতালির একাংশ দখল করে নেয়।
ইস্তাম্বুল বিজয়ের মধ্য দিয়ে তুর্কিরা বিশ্বের এ অঞ্চলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়। বিজয়ী সুলতান মোহাম্মদ অর্থোডক্স চার্চকে নিজস্ব ভূমিসহ স্বশাসন বজায় রাখতে দিলে তারা আনুগত্য স্বীকার করে। এ দিকে অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের বেশির ভাগই রোমানদের চেয়ে তুর্কি শাসনকে উত্তম বলে স্বীকার করে নেয়। তাদের একটা বিখ্যাত উক্তিÑ ‘সুলতানের পাগড়ি পাদ্রির হ্যাটের চেয়ে ভালো।’ তুর্কিরা সাবেক বাইজান্টাইন রাষ্ট্রযন্ত্রকে সাফল্যের সাথে ব্যবহার করেছিল।
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে ওসমানি সাম্রাজ্য দীর্ঘ দিন ধরে সম্প্রসারিত হতে হতে ইউরোপ ও আফ্রিকার গভীরে পৌঁছতে থাকে। সামরিক উদ্ভাবন ও নৌবাহিনীর পারদর্শিতা এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিল। তুর্কি নৌসেনারা ইতালির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কৃষ্ণ, ইজিয়ান ও ভূমধ্যসাগরে এবং পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে প্রতিযোগী হিসেবে লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগরে সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটগুলো নিরাপদ রেখেছিল। পশ্চিম ইউরোপ-এশিয়ার স্থলভাগের প্রধান বাণিজ্যপথ নিয়ন্ত্রণে রাখায় তুর্কি সাম্রাজ্য অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছিল। এ কারণে এশিয়ার সাথে যোগাযোগের বিকল্প রুটের সন্ধানে স্পেনের রানী ইসাবেলা কলম্বাসকে অভিযানে পাঠিয়েছিলেন। তিনি অভিযানে গিয়ে আমেরিকা অধিকার করে বসেন।
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গিবনের মতে, ওসমানি সাম্রাজ্য চরিত্রের দিক থেকে গভীরভাবে ইসলামি ছিল না। এর বিপরীতে অস্ট্রিয়ান ইতিহাসবিদ পল উইটেক মনে করেন, এই তুর্কিরা ইসলামি বিশ্বের প্রসার ঘটাতে জিহাদে লিপ্ত ছিল। তবে মার্কিন ইতিহাসবিদ হিথ লোরি বলেছেন, উইটেকের উক্তি মেনে নেয়া যায় না। বরং ওসমানি সাম্রাজ্যে শাসনকার্যে নিয়োজিতদের অর্ধেক ছিল তুর্কি, বাকি অর্ধেক গ্রিক। যদিও তারা সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ নর্মান স্টোনের ভাষ্য : তুর্কি সাম্রাজ্যে সুন্নি ইসলাম ছিল রাষ্ট্রধর্ম। তবে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ শাসকদের প্রতি অনুগত থেকে ওসমানি আমলে সাম্রাজ্যের মধ্যে সবার চেয়ে বেশি ভূমির মালিক হতে পেরেছিল।
যা হোক, বিখ্যাত সুলতান প্রথম সেলিম নাটকীয়ভাবে ইরানের সম্রাট ইসমাইলকে হারিয়ে সাম্রাজ্যের সীমান্ত সম্প্রসারিত করেন। তিনি মিসরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং লোহিত সাগরে নৌবাহিনী মোতায়েন করেন। এখানে আধিপত্য নিয়ে পর্তুগাল-তুরস্ক দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়।
সেলিমের উত্তরাধিকারী, ‘মহান সুলাইমান’ ১৫২১ সালে সার্বিয়ার বেলগ্রেড জয় করেন। হাঙ্গেরির বড় অংশও হয় পদানত। ১৫২৯ সালে ভিয়েনা অবরোধ করলেও শীতের তীব্রতায় ফিরে আসেন। তিন বছর পর আড়াই লাখেরও বেশি সৈন্য নিয়ে আবার ভিয়েনা আক্রমণ করেন। তবে এবার বর্ষা তাকে ফিরতে বাধ্য করে। সুলাইমানের সময়ে ট্রানসিলভানিয়া ও মোলদাভিয়া তুর্কিদের অধীনে আসে। ১৫৩৫ সালে ইরানের হাত থেকে বাগদাদ দখল করায় পারস্য উপসাগরে নামার সুযোগ পায় তুর্কিরা। সুলাইমানের আমলে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির একটি প্রমাণ, দেড় কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এলাকার ওপর তার কর্তৃত্ব। তত দিনে তুর্কিরা অপ্রতিরোধ্য নৌশক্তি হয়ে ভূমধ্যসাগর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অ্যাডমিরাল খায়েরুদ্দিন পাশা কয়েকবার খ্রিষ্ট নৌশক্তিকে পরাজিত করেন। ফলে তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়া স্পেন থেকে তুর্কিদের দখলে আসে। যখন স্পেনে চলছিল কুখ্যাত ইনকুইজিশনের বর্বরতা, তখন তুর্কিরা মুসলিম ও ইহুদিদের উদ্ধার করে গ্রিস, সাইপ্রাস ও ইস্তাম্বুলে আশ্রয় দিয়েছিল। ওই সময়ে তুর্কিরা ইউরোপের রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি বড় শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং একপর্যায়ে ফ্রান্সের সাথে অর্থনৈতিক ও সামরিক জোট গড়ে ওঠে। স্পেন, ইতালি ও অস্ট্রিয়ার মোকাবেলায় তুর্কিরা ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের সাথেও সামরিক জোট বেঁধেছিল।
তবে সাম্রাজ্যের দুই প্রান্তে অস্ট্রিয়া ও ইরানে যুদ্ধলিপ্ত থাকায় তুর্কি সাম্রাজ্যের আর্থিক ক্ষতি হয়। এর প্রভাবে নৌশক্তির সামর্থ্য হ্রাস পায়। তবুও ১৬৮৩ সালে ভিয়েনার যুদ্ধ পর্যন্ত ইউরোপে তুর্কি সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল। এ দিকে পাশ্চাত্যের তীব্র প্রতিযোগিতায় তুর্কিদের বাণিজ্যিক একাধিপত্য ক্ষুণœ হতে থাকে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও ব্যাপক মূল্যস্ফীতি সমাজের সর্বস্তরে প্রভাব ফেলে। খ্রিষ্টশক্তির জোট ‘হলি লিগ’ ১৬৮৩-তে ভিয়েনায় তুর্কি পরাজয়ের সুযোগ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ১৬৯৯ সালে কার্লোভিৎজের চুক্তির মাধ্যমে তুর্কিরা প্রথমবারের মতো হাঙ্গেরিসহ ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলো ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৭০৯ সালে রুশদের হাতে পরাজিত হয়ে সুইডেনের রাজা দ্বাদশ চার্লস ইস্তাম্বুলে রাজপ্রাসাদে আশ্রয় নেন এবং পাঁচ বছর সেখানে কাটান। তার প্রেরণায় সুলতান আহমদ ১৭১০ সালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাদের পরাস্ত করেন।
এরপর তুর্কি সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের পরিবর্তে সঙ্কোচনের সূচনা হয়। নানা কারণে ওসমানি সুলতানের সামরিক শক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। এ দিকে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে রুশ-তুর্কি যুদ্ধ চলতেই থাকে। তুরস্কের ক্রমেই শক্তি ক্ষয় হতে হতে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি তাকে ‘ইউরোপের দুর্বল ব্যক্তি’ (ঝরপশ সধহ ড়ভ ঊঁৎড়ঢ়ব) বলা শুরু হয়। মধ্যযুগে দর্শন ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির গুণে তুর্কিরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য পেয়েছিল। কিন্তু আধুনিক যুগের সূচনাপর্বে দেখা গেল, তাদের জ্ঞান-গবেষণাকে স্থবিরতা ও পশ্চাৎপদতা গ্রাস করে নিয়েছে। অবশ্য অর্থনৈতিক ও সামরিক সংস্কারের মাধ্যমে তুর্কিদের শক্তি ও গৌরব পুনরুদ্ধারের প্রয়াস চলে।
১৮৩০ সালে সার্বিয়ায় সার্বদের নিজস্ব রাজতান্ত্রিক শাসন মেনে নেয়া হয়। এর আগেই ১৮২১-এ গ্রিস যুদ্ধ ঘোষণা করে সুলতানের বিরুদ্ধে। মোলদাভিয়া ও মন্টেনিগ্রো স্বাধীন হয়ে যায় ১৮৬০ সালের কিছু পর। তুর্কি সাম্রাজ্যের পতনের পালা এবং আধুনিকায়ন দুটোই চলছিল একত্রে। তুরস্ক ইউরোপের বড় বড় শক্তির সাথে জোট বেঁধে সামরিক অভিযানে নামা যুক্তিযুক্ত বলে মনে করে। যেমন ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে তুরস্ক ১৮৫৩ সালে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় রাশিয়ার বিরুদ্ধে। এ সময়ে দুই লাখ তাতার তুরস্কে আশ্রয় নেয়। উল্লেখ্য, অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে বলকান, ককেশাস, ক্রিমিয়া, ক্রিট অঞ্চল থেকে এত মুসলিম তুরস্কে হিজরত করে যে, তারা তুরস্কের মৌলিক বৈশিষ্ট্যকেও প্রভাবিত করেছিল। ১৯২২ সালে খিলাফতের অবসানলগ্নে দেখা গেল, তুরস্কের জনসংখ্যার অর্ধেকই রাশিয়ার মুসলিম উদ্বাস্তু। তুর্কি শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণে তাতারদের অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে।
‘তানজিমাত’ নামে তুরস্কে সার্বিক আধুনিকায়ন শুরু করেন সুলতান মাহমুদ। ১৮৩৯ সালে সূচিত এই ব্যাপক কার্যক্রমের আওতায় ছিল কৃষি, শিল্প, অর্থ, শিক্ষা, আইন, ভূমি, প্রতিরক্ষা, সংস্কৃতি, জীবনাচার প্রভৃতি অনেক কিছুই। ১৮৭৬ পর্যন্ত স্থায়ী, তানজিমাত পর্বে একের পর এক সাংবিধানিক সংস্কার অব্যাহত ছিল। ১৮৬৩ থেকে আর্মেনীয় খ্রিষ্টানরা বিশেষ সুবিধা পায় এবং তাদের জন্য আলাদা সংবিধান ও জাতীয় পরিষদ গঠিত হয়। খ্রিষ্টানরা শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রণী থাকায় তারা মুসলিমদের চেয়ে বেশি উন্নতি লাভ করছিল। ১৯১১ সালে ইস্তাম্বুলের ৬৫৪টি পাইকারি ব্যবসায়প্রতিষ্ঠানের ৫২৮টিই ছিল গ্রিক খ্রিষ্টানদের।
সংবিধান সংস্কারের চূড়ান্তপর্যায়ে ১৮৭৬ সালে ‘মৌলিক আইন’ জারি হয়। এতে বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং সব নাগরিকের সাম্যকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষিত যে তরুণেরা এই আইনপ্রণেতা, তারা মনে করতেন ক্রমবর্ধমান সামাজিক অসন্তোষ মোকাবেলার পন্থা হলো সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। সে মোতাবেক তারা ১৮৭৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সুলতান আবদুল আজিজকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের ঘোষণা দেবেন এ শর্তে ক্ষমতাসীন করা হয় আবদুল হামিদকে। কিন্তু এই সুলতান দুই বছর পরই পার্লামেন্ট স্থগিত করেন। পরে তা একেবারে বাতিল করে দেয়া হলো।
সংস্কার কার্যক্রমও তুর্কি সাম্রাজ্যের পতন ঠেকাতে পারেনি। একে একে বিভিন্ন অঞ্চল স্বাধীন হওয়ার ধারাবাহিকতার মধ্যে ১৮৭৮ সালে ‘বার্লিন কংগ্রেস’ চলে এক মাস ধরে। এটি ছিল ইউরোপের পরাশক্তিগুলোর সাথে তুর্কি সাম্রাজ্যের বৈঠক। এর অব্যবহিত আগে রাশিয়া ও তার খ্রিষ্টান মিত্ররা তুরস্ককে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিল। বার্লিন কংগ্রেসের উদ্যোক্তা ছিলেন জার্মানির বিখ্যাত বিসমার্ক। তিনি বড় যুদ্ধ এড়ানোর কথা বলে সীমান্ত সমন্বয়ের নামে তুর্কিদের ক্ষমতা হ্রাস্ এবং বৃহৎ শক্তিগুলোর স্বার্থ নিশ্চিত করেন। রুমানিয়া-বুলগেরিয়া তুর্কি সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্নতার দিকে এগিয়ে যায়। ১৮৭৮ সালে অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি মিলে বসনিয়া দখল করে নিলে তুর্কিরা পাল্টা অভিযান চালায়। উভয়পক্ষের সৈন্যদের অবস্থান ৩০ বছর অচলাবস্থা জিইয়ে রাখে। ১৯০৮ সালে প্রগতিবাদী ‘তরুণ তুর্কি’ বিপ্লবের সুযোগে অস্ট্রিয়া বসনিয়া-হারজেগোভিনা দখল করে নেয়। এর আগে ব্রিটেন ১৮৭৮ সালে সাইপ্রাস এবং ফ্রান্স ১৮৮১ সালে তিউনিসিয়া দখল করে নিয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক জার্মানির পক্ষাবলম্বন করলে ব্রিটেন সাথে সাথে মিসর ও সুদান দখলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। অবশ্য সেখানে ১৮৮২ থেকেই ব্রিটিশ সৈন্য ছিল। আসলে বার্লিন কংগ্রেসেই তুরস্ককে হীনবল করার ব্যবস্থা পোক্ত হয়েছিল। তবে ওই কংগ্রেসে বুলগেরিয়ার হাত থেকে মেসিডোনিয়াকে তুর্কিদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এতে যে প্রচণ্ড ক্ষোভ বুলগেরিয়ায় সঞ্চারিত হয়েছিল, তার পরিণামে ১৯১২ সালে প্রথম বলকান যুদ্ধ ঘটে। তখন তুর্কিরা পরাজিত হয়ে ইউরোপে তাদের সাম্রাজ্যের প্রায় পুরোটাই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। একই সময়ে ইতালি দখল করে লিবিয়া। এর সংলগ্ন আলজেরিয়াকে ফ্রান্স দখল করেছিল ৮২ বছর আগেই ১৮৩০ সালে।
১৯০৮ সালের ৩ জুলাই ‘তরুণ তুর্কি’দের বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং সুলতান আবদুল হামিদ ঘোষণা দিতে বাধ্য হন, ১৮৭৬ সালের সংবিধান পুনর্বহাল এবং পার্লামেন্ট আবার আহ্বান করা হবে। মূলত এ ঘোষণা ওসমানি সাম্রাজ্যের অবসান ঘটায়। এবার শুরু হয় পাশ্চাত্যপন্থী ও সেকুলার, কমিটি অব ইউনিয়ন অ্যান্ড প্রগ্রেসের রাজনীতি। অপর দিকে ১৯১২-১৩ সালের বলকান যুদ্ধে গ্রিস, সার্বিয়া ও বুলগেরিয়ার গণহত্যার শঙ্কায় চার লাখ মুসলমানকে তুরস্কে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
প্রথম মহাযুদ্ধের শুরুতে ‘তরুণ তুর্কি’ সরকার জার্মানির সাথে গোপন চুক্তি করে জোট বাঁধে। টার্গেট ছিল অভিন্ন দুশমন রাশিয়া। দু’টি জার্মান জাহাজকে আশ্রয় দিয়ে তুরস্ক মহাযুদ্ধে শামিল হয়। প্রথম দিকে তুর্কিরা কয়েকটি বড় বিজয় অর্জন করেছিল, যেমন গ্যালিপলির যুদ্ধ। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র কখনো তুর্কি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি।
আর্মেনীয়দের সহায়তায় রাশিয়া তুরস্কের বিরুদ্ধে অগ্রাভিযান চালাচ্ছিল। তাই তুর্কি সরকার আর্মেনীয় নাগরিকদের রুশ ফ্রন্ট থেকে সরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়। তাদের সিরিয়া ও ইরাকে নিয়ে যাওয়া হয়। আর্মেনীয় ও পাশ্চাত্যের দাবি তখন ১৫ লাখ আর্মেনীয় নিহত হয়েছিল। অথচ আগে পাশ্চাত্যের গবেষকেরাই বলেছেন, এ সংখ্যা ছয় লাখ। আর তুরস্ক সরকার জানিয়েছে, মৃত্যু ঘটেছিল তিন লাখের।
১৯১৬ সালের ‘আরব বিপ্লব’ তুরস্ককে একেবারে দুর্বল করে ফেলে। ১৯১৮ সালের শেষ দিকে শুধু ইয়েমেন, বর্তমান সৌদি আরবের মদিনা শহর ও আসির অঞ্চল এবং সিরিয়াÑ ইরাকের উত্তরাঞ্চলের একাংশ ছাড়া আরবের সব এলাকাই তুর্কি সাম্রাজ্যের হাতছাড়া হয়েছিল। এই ক’টি স্থানও তিন মাসের মধ্যে ব্রিটেনকে দিয়ে দিতে হয়। জর্জিয়া-আর্মেনিয়া-আজারবাইজান তুরস্ক অধিকার করেছিল ১৯১৭ সালে। অথচ এগুলোও ত্যাগ করার নির্দেশ মানতে হয় তুরস্ককে। সেভর্স চুক্তির অধীনে সীমানা স্থির করে ওসমানি সাম্রাজ্যের যবনিকা টানা হলো। সে সাম্রাজ্যের আওতায় ছিল, এমন ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র বর্তমানে ৪০টি।
ইস্তাম্বুল ও ইজমির শত্রুপক্ষ দখল করার প্রতিক্রিয়ায় তুর্কিদের জাতীয় আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে ১৯১৯ সালে। মুস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে শেষাবধি বিজয়ী হয়। ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর সুলতানাত বাতিল ঘোষিত হলে ১৬ দিন পরই সর্বশেষ সুলতান মোহাম্মদ ওয়াহেদুদ্দিন দেশত্যাগ করেন। ১৯২৩ সালের লসান চুক্তিমাফিক তুরস্কের নবগঠিত ‘গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। এ ফোরাম তুর্কি প্রজাতন্ত্রের ঘোষণা দেয়। পরে ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ খেলাফতের অবসান ঘটে সাংবিধানিকভাবে। তদুপরি সুলতানকে সপরিবারে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করা হয়। ১৯১৯ সালে পাক-ভারত উপমহাদেশে যে খেলাফত আন্দোলন চলছিল তুর্কি খেলাফতের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে, তার সমাপ্তি ঘটে স্বাভাবিকভাবেই।
ওসমানি শাসনব্যবস্থা নিবর্তনমূলক মধ্যযুগীয় গোঁড়া ও স্বেচ্ছাচারী সিস্টেম ছিল না। সেই সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো যুগের প্রয়োজনে বিভিন্ন পর্যায়ে রূপান্তরিত হয়েছে। ওই শাসনে ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুরা যথেষ্ট অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করতেন। ওসমানি শাসক বংশ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মুসলিম ইতিহাসে নজিরবিহীন। এত বিশাল সাম্রাজ্যের, এত দীর্ঘকাল টিকে থাকার দৃষ্টান্ত নেই আর। এর রাজনৈতিকব্যবস্থার সুদৃঢ়তার প্রমাণ হলো, ওসমানি বংশের শাসন উৎখাতের মাত্র দু’বার চেষ্টা হয়েছিল ৬০০ বছরে। তা-ও ব্যর্থ হয়ে যায়। শাসনকার্যে নিয়োজিত ব্যক্তিরা যেমন ছিলেন সুলতানের অনুগত, তেমনি যোগ্য ও দক্ষ। প্রশাসনে মুসলমান ছাড়াও বহু ইহুদি-খ্রিষ্টান কর্মকর্তা ও কর্মচারী থাকা ওসমানি শাসকদের উদারতাই তুলে ধরে। নামে ‘তুর্কি সালতানাত’ হলেও আলবেনীয়, গ্রিক, আর্মেনিয়ান, সার্ব, হাঙ্গেরিয়ান প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক লোকপ্রশাসনের দায়িত্ব পালন করেছিল। ষোড়শ শতকের শেষ দিক থেকে সুলতানেরা আর রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তখন থেকে প্রধানমন্ত্রী (গ্র্যান্ড ভিজিয়ার) ছিলেন প্রকৃত রাষ্ট্রপ্রধান।
মুস্তফা কামাল নব্য তুরস্কের ‘জাতির পিতা’। তার সর্বশ্রেষ্ঠ সাফল্য হলো ইউরোপের ‘সিক ম্যান’ বা রুগ্ণ ব্যক্তি হওয়ার গ্লানি থেকে তুরস্কের মুক্তিদান। অবশ্য আধুনিক তুরস্ক ‘স্ট্রং ম্যান’ বা ‘হেলদি ম্যান’ হওয়ার আগেই কামালের মৃত্যু হয়। প্রগতি ও আধুনিকতার মোহে ধর্মবিদ্বেষ এবং সেই সাথে স্বৈরাচারী শাসন ও চারিত্রিক নিম্নমানে তিনি আজো সমালোচিত। তিনি দেশ ও জাতির উন্নতির কথা বলে কট্টর সেকুলারিজম নিষ্ঠুরভাবে কায়েম করেছিলেন। তবুও তার মৃত্যুর ৭৩ বছর পর আজো এর গভীর প্রভাব তুরস্কের সেনাবাহিনী, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকদের বিরাট অংশে পরিলক্ষিত হয়।
১৯৩৮ সালে কামাল পাশার মৃত্যু তার দক্ষিণহস্ত ইসমত ইনোনুকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। তিনি কামালবাদী মতাদর্শ বাস্তবায়ন করেন নিষ্ঠার সাথে। পঞ্চাশের দশকে প্রেসিডেন্ট জালাল বায়ার ও প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দারেসের অবদানে গণতন্ত্রের সুবাতাসের সূচনা উগ্র সেকুলারিজমের দুর্গন্ধ কিছুটা দূর করেছিল। কিন্তু অচিরেই দেশটির প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কথিত ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী দেশকে আগের স্বেচ্ছাচারিতায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সে অভ্যুত্থানের অপনায়ক জেনারেল জামাল গুরসেল। সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে ১৯৮০ সালে জেনারেল কেনান এভরানের নেতৃত্বে। এর আগে সুলেমান ডেমিরেলের দুই শাসনামলে সেকুলার ও স্বেচ্ছাচারের তাণ্ডব ছিল কম।
নব্বইয়ের দশকে প্রফেসর নাজমুদ্দিন এরবাকানের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক ধারা গণরায়ে ক্ষমতায় গিয়েও টিকতে পারেনি। সেকুলারদের মজ্জাগত চক্রান্তের মাসুল দিয়ে শুধু যে এই প্রবীণ নেতাকে বিদায় নিতে হয়, তা নয়। ঐতিহ্যবাহী মুসলিম দেশটিকে মানবিক আদর্শনিষ্ঠ কল্যাণ রাষ্ট্রে উন্নীত করার সুযোগও হারিয়ে গিয়েছিল। তবে নিকট অতীতে একে পার্টির উত্থান এবং পুনর্নির্বাচন ধর্মীয় মূল্যবোধে আস্থাবান ও গণতন্ত্রমনা মানুষকে আবার আশাবাদী করে তুলেছে।