প্যারিসে বৈঠকে বসবেন আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাস জুড়ে সারা বিশ্বের খবরের কাগজে শিরোনাম সেটাই। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাওয়া দুনিয়ায় ডুইট আইজেনহাওয়ার এবং নিকিতা ক্রুশ্চেভের মুখোমুখি হওয়ার খবরে আলোড়ন উঠবে এমনটাই স্বাভাবিক। প্যারিসের ওই বৈঠকে পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা কমানো নিয়ে সদর্থক আলোচনা করার কথা ছিল দুই বিশ্বনেতার। কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল অঘটন।
সে বছর পয়লা মে ভোর রাতে পাকিস্তানের পেশোয়ার বিমানঘাঁটি থেকে আকাশে উড়েছিল মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-র একটি ইউ-২ বিমান। ৭০ হাজার ফুট উপরে উঠে গোপনে সোভিয়েত রাশিয়ার অভ্যন্তরে লুকনো বিভিন্ন সেনাঘাঁটি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ব্যবস্থার ছবি তোলার জন্য বছর পাঁচেক আগেই ওই ব্রহ্মাস্ত্রটি হাতে পেয়েছিলেন সিআইএ কর্তারা। ইউ-২র শক্তিশালী ক্যামেরা দিয়ে নাকি ৭০ হাজার ফুট নীচে কোনও রুশ নাগরিকের হাতের সংবাদপত্রের হেডলাইনেরও ঝকঝকে ছবি তোলা যেত। এর আগে অনেকবার সোভিয়েত আকাশসীমা পেরিয়ে গোপনে ছবি তুলে এনেছে ইউ-২। টের পেয়েও বিশেষ কিছু করতে পারেনি ক্রুশ্চেভের দেশ। কিন্তু সেদিনটা হিসেবে গোলমাল হয়ে গেল।
সেদিন ওই গুপ্তচর বিমানের চালকের আসনে ছিলেন ৩১ বছরের ফ্রান্সিস গ্যারি পাওয়ার্স। কেনটাকির যুবকের গলায় ঝোলানো ছিল একটা রুপোর কয়েন, তাতে লুকনো ছিল বিষ মাখানো ইঞ্জেকশনের একটা ছোট্ট সিরিঞ্জ। শত্রুর হাতে কোনওভাবে ধরা পড়ার আগে আত্মঘাতী মিশনের একমাত্র অস্ত্র। সেদিন সোভিয়েত আকাশসীমায় ঢুকতেই পাওয়ার্সের বিমানকে তাড়া করে আসে ১৪টি রুশ যুদ্ধবিমান। তাদের একটির আঘাতে উরাল পর্বত লাগোয়া স্বেরদলভস্কে ভেঙে পড়ে পাওয়ার্সের বিমান। কিন্তু এতদিনের ট্রেনিং ভুলে গিয়ে শেষ মুহূর্তে ইঞ্জেকশনটা শরীরে বিঁধিয়ে ফেলতে পারেননি তিনি। বরং প্যারাশুট বেয়ে শত্রুদেশের মাটিতে নেমে পড়ার সময় বোধহয় বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছেটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল।
সুযোগ হাতছাড়া করেনি সোভিয়েত ইউনিয়ন। পাওয়ার্স মাটিতে পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় মস্কোর কুখ্যাত লুবিয়াঙ্কা জেলে। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে তড়িঘড়ি বিবৃতি জারি করে আমেরিকা। তাদের দাবি ছিল, ভুল করে সোভিয়েত মাটিতে ভেঙে পড়েছে আমেরিকার একটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকারী বিমান। কিন্তু তাতে লজ্জা নিবারণ হয়নি সুপারপাওয়ার আমেরিকার। বরং আইজেনহাওয়ারের বিড়ম্বনা বাড়িয়ে প্রায় অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া ইউ-২ বিমানের অংশ, তার ক্যামেরা এবং সর্বোপরি কেজিবির টানা জেরার পর বিধ্বস্ত পাওয়ার্সের ছবি দুনিয়ার সামনে প্রকাশ করে দেয় সোভিয়েত রাশিয়া। ঢোক গিলে আমেরিকা মেনে নিতে বাধ্য হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নজরদারির অভিযোগ।
প্যারিসে ক্রুশ্চেভ-আইজেনহাওয়ার সাক্ষাৎ হবে কি না, তা নিয়ে চরম দোলাচল থাকলেও মধ্যে শেষ পর্যন্ত ১৬ মে বৈঠকে মুখোমুখি দেখা হয় দুই রাষ্ট্রপ্রধানের। কিন্তু সর্বশক্তিমান মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য আরও হেনস্থা অপেক্ষা করে ছিল। বৈঠকে এসে তাবড় বিশ্বশক্তির সামনে ইউ-২ বিমানের ঘটনা নিয়ে আইজেনহাওয়ারকে চরম অপমান করেন ক্রুশ্চেভ। তার পর বেরিয়ে যান বৈঠক থেকে। ভেস্তে যায় বিশ্বে শান্তি ফেরানোর লক্ষ্যে ডাকা সেই শীর্ষ সম্মেলন। অপমানিত আইজেনহাওয়ার দেশে ফিরে এই হেনস্থার জন্য দায়ী করেন ওই 'স্টুপিড' বিমান দুর্ঘটনাকে।
কয়েক মাস বন্দি থাকার পর অবশেষে বিচার শুরু হয় পাওয়ার্সের। মস্কোর সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে গুপ্তচরবৃত্তির কথা স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন তিনি। তবে পাওয়ার্সের মুক্তির জন্য শেষ পর্যন্ত আলোচনার টেবিলে বসতেই হয় আমেরিকাকে। বিমানবাহিনীর ক্ষোভ প্রশমন করতে, প্রবল জনমতের চাপে শেষ পর্যন্ত কেজিবির গুপ্তচর কর্নেল ভিলিয়াম ফিশার ওরফে রুডল্ফ আবেলের বিনিময়ে মুক্তি পান পাওয়ার্স। বরফে ঢাকা বার্লিনের গ্লিনিক ব্রিজে দুই দেশের সেনাবাহিনী মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়, সোভিয়েত অধিকৃত বার্লিনের দিক থেকে মার্কিন দখলে থাকা বার্লিনে ফিরে আসেন গ্যারি। তাঁর বিমান ভেঙে পড়ার প্রায় দু'বছর বাদে, ১৯৬২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি।
গ্যারি পাওয়ার্সের নজরদারি বিমান ভেঙে পড়ার ঘটনায় বিধ্বংসী পরমাণু যুদ্ধের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্র। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটি প্রাণ রক্ষা করার তাগিদে যুদ্ধের হুঙ্কার ছেড়েও কূটনৈতিক আলোচনার টেবিলে বসতে হয় দু'পক্ষকে। যুদ্ধোন্মাদ রাষ্ট্রের জনতা একটি প্রাণকে বাঁচাতে চেয়ে সে দিন সম্ভাব্য ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল আরও বহু প্রাণ।
[এই সময়ের সৌজনৌ]