ইলহান ওমরকে নিয়ে বিতর্ক

ইলহান ওমর -

  • আলফাজ আনাম
  • ০৭ মে ২০১৯, ১০:৪৩


যুক্তরাষ্ট্রের একজন মুসলিম কংগ্রেসওম্যান ইলহান ওমরকে ইহুদি বিদ্বেষী হিসাবে চিহিৃত করে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলা দেয়া হয়েছে। যিনি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। বলা যায় সারা বিশে^র মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি লবির প্রভাব নিয়ে কথা বলে প্রাননাশের হুমকিতে রয়েছেন ইলহান ওমর। তিনি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পের আক্রমনের শিকার হয়েছেন। স্পষ্টভাষী এই সাহসী নারী এখন মানবতাবাদী অনেক মানুষের আইকনে পরিনত হয়েছেন। যদিও তাকে নানা ভাবে হয়রানির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ইসরাইলি লবি ও শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থীরা তৎপর রয়েছে। এমনকি তার রাজনৈতিক জীবন অনিশ্চিত করে তুলতেও নানা চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
ইলহান ওমর সোমালি বংশোদ্ভুত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। যিনি মিনোসোটা অঙ্গ রাজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তার জন্ম ৪ অক্টোবর ১৯৮১ সালে। সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসুতে। ১৪ বছর বয়সে পরিবারের সাথে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। সোমালিয়ার যুদ্ধপরিস্থিতির কারনে যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে তিনি পরিবারের সাথে কেনিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে চার বছর কাটিয়েছিলেন। পিতা-মাতার সাত সন্তানের মধ্যে তিনি সবচেয়ে ছোট। তার পিতা নূর মোহাম্মদ ওমর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতেন। ইলহানের বয়স যখন প্রায় দুই বছর, তখন তার মা মারা যায়। পিতা এবং দাদার কাছে তিনি বড় হন। ১৯ বছর বয়সে ২০০০ সালে ইলহান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন। নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে ২০১১ সালে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন।
ইলহান ওমরের স্বামী আহমেদ নুর সাইদ একজন সোমালী। তিন সন্তানের জননী ইলহান পেশায় স্বাস্থ্য কর্মী ও রাজনীতিক। হিজাব-পরিহিত ইলহান ওমর সার্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কট্টর সমর্থক। একইসাথে, ঘণ্টায় কমপক্ষে ১৫ ডলার মজুরীর পক্ষে প্রচারনা চালিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে ইলহান ওমর মিনোসোটা হাউজে প্রতিনিধি নিযুক্ত হন।
২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে দুজন মুসলিম নারী কংগ্রেস ওম্যান হিসাবে নির্বাচিত হন। সোমালি বংশোদ্ভূত ইলহান ওমর এবং ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত রাশিদা তালেব - এরা দুজনেই ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী ছিলেন। দুজনেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিবাসী-বিরোধী এবং মুসলিম-বিরোধী বক্তব্যর প্রকাশ্য এবং ঘোরতর সমালোচক। রাশিদা তালেব বিজয়ী হন মিশিগান রাজ্য থেকে। ইলহান ওমর মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের একটি আসন থেকে। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে প্রথম মুসলিম নারী কংগ্রেস সদস্য হিসেবে কোরআন শরীফের ওপর হাত রেখে শপথ নিয়ে ইতিহাস গড়েন ইলহান ওমর।
নির্বাচনে জেতার পর প্রথম ভাষণে, ইলহান ওমর বলেন," মিনেসোটায় আমরা অভিবাসীদের শুধু সাদরে বরণই করিনা, আমারা তাদের ওয়াশিংটনে পাঠাই।" এরপর তিনি বলেন "আজ রাতে অনেকগুলো 'প্রথম' বিশেষণের অধিকারী হিসাবে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি - প্রথম অশ্বেতাঙ্গ হিসাবে আমি এই রাজ্যকে কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্ব করতে চলেছি, হিজাব পরিহিত নারী হিসাবে কংগ্রেস যাচ্ছি, আমিই প্রথম শরণার্থী যে কংগ্রেসে নির্বাচিত হয়েছি, এবং প্রথম একজন মুসলিম নারী হিসাবে কংগ্রেসে যাচ্ছি।"
এর আগে ২০১৬ সালে মিনাসোটা অঙ্গরাজ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন "এ বিজয় শরণার্থী শিবিরে ৮-বছর বয়সী এক শিশুর বিজয়। এই বিজয় একজন তরুণীর যাকে জোর করে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়। এই বিজয় তাদের যাদের বলা হয় যে তাদের স্বপ্ন দেখার সীমা রয়েছে।"
ইলহান ওমরকে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে নিউইয়র্কে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) জানিয়েছে, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির নাম প্যাট্রিক কারলিনিও (৫৫)। তিনি ইলহান ওমরের ওয়াশিংটন অফিসে ফোন করে তাঁকে হত্যার হুমকি দেন। ইলহান ওমরকে তিনি মিসরের নিষিদ্ধ ইসলামপন্থী সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য বলে দাবি করেন। গুলি করে তাঁর মাথার খুলি উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। গ্রেপ্তারের সময় তিনি সগর্বে বলেন, ‘আমাদের বাপ-দাদারা বেঁচে থাকলে ইলহান ওমরকে গুলি করে হত্যা করতেন।’ ধারনা করা হয় শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদি বা মুসলিম বিরোধী রাজনৈতিক বিশ^াস দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই ব্যক্তি ইলহানকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন।
রাশিদা তালেব ও ইলহান ওমর দুজনে ফিলিস্তিন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সমালোচনা করে আসছেন। তাদের এই অবস্থান ছিলো প্রকাশ্য। ইলহান ফিলিস্তিন ও মুসলিম নীতিতে সোচ্চার হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু গনমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারনা শুরু হয়। এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি এগিয়ে ছিলো ফক্্র নিউজ। তাকে নিয়ে নতুন করে বির্তকের ঝড় তোলা হয় একটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে ইলহানের দেয়া বক্তব্যকে ঘিরে। যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী ইহুদি লবির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন , আমেরিকানদের মধ্যে বিদেশী আনুগত্য করার প্রবণতা রয়েছে। তিনি টুইটারে দেয়া এক বার্তায় দাবি করেন, ইসরাইলের প্রতি মার্কিন আইন প্রণেতাদের অব্যাহত সমর্থনের মূল চালিকা শক্তি হলো ইহুদিবাদী লবি গুলোর দান করা মোটা অংকের অর্থ। তিনি বুঝিয়েছেন, ইহুদি লবি আমেরিকান-ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির (এআইপিসি) কাছ থেকে বিপুল অর্থ পাওয়ার কারনেই মার্কিন আইন প্রণেতারা অব্যাহতভাবে ইসরাইলকে সমর্থন করে। এআইপিসি নামের এই সংগঠনটি যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদের স্বার্থ দেখভাল করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে সব প্রার্থীরা এআইপিসির সমর্থন নেয়ার চেষ্টা করেন। এই সমর্থনের বিনিময়ে মুল প্রতিশ্রুতি থাকে ইসরাইলের স্বার্থরক্ষা করা।
ইলহান ওমরের খোলামেলা বক্তব্যে মার্কিন রাজনীতিতে ব্যাপক বির্তকের সূত্রপাত করেছে। প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পও ইলহানের সমালোচনা শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, এর জন্য তাঁর লজ্জিত হওয়া উচিত। এবং আমি মনে করি না যে, তাঁর ক্ষমা প্রার্থনাও যথেষ্ট হবে।’ তবে ইলহানের মতকেও অনেক কংগ্রেসম্যান সমর্থন করেন। অবশ্য ইহুদি-বিদ্বেষের নিন্দা জানিয়ে একটি রেজ্যুলেশন পাস করে প্রতিনিধি পরিষদ। তখন ইলহান ওমর তার বক্তব্যে যদি কেউ আহত হয় সেজন্য ক্ষমা চান।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ইহুদি-বিদ্বেষকে এখন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিকে ঘায়েল করার জন্য এই অস্ত্র সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করছে রিপাবলিকানরা। ইলহান ওমর কি ইহুদি-বিদ্বেষের অস্ত্রেই ঘায়েল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি ব্যক্তি ইলহান ওমরই ইসরাইলি লবির প্রধান টার্গেট পরিনত হয়েছেন। তারা ইহুদি-বিদ্বেষের অভিযোগকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এমন একজন কংগ্রেস সদস্যের পতন ঘটানোর চেষ্টা করছেন, যিনি প্রতিনিধি পরিষদে ইসলামী বিধান অনুসারে হিজাব পরে মানুষের নজর কেড়েছেন। যিনি মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে, বিশেষ করে ইসরাইল ইস্যুতে স্পর্শকাতর সব তথ্য অকপটে প্রকাশ করেন।সাম্প্রতিক সমালোচনা ও নিন্দার মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের ক্ষোভেরই বহি:প্রকাশ ঘটেছে।
ইলহান ওমর মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলি নীতির কঠোর সমালোচক হিসাবে শুরু থেকেই পরিচিত। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি রাজনীতিতে প্রতিষ্টিত হয়েছেন। অবশ্যই তার সমর্থনের একটি বড় ভিত্তি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীরা। ইসরাইল সর্ম্পতে তিনি বলেছিলেন, ইসরাইলকে যখন মধ্যপ্রাচ্যের একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তুলে ধরা হয় তখন আমি হাসি ধরে রাখতে পারি না। ফিলিস্তিন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র একপেশে নীতি অনুসরণ করছে বলেও মন্তব্য করেন ইলহান ওমর। তিনি বলেন, আমরা এমন এক নীতি অনুসরণ করছি যাতে এক পক্ষকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আমেরিকার একপেশে নীতির উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ইসরাইল যখন অন্য ধর্মকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজেকে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে তখনও আমরা সেটাকে মধ্যপ্রাচ্যের গণতান্ত্রিক দেশ বলি। কিন্তু অন্য কোনো দেশ ও সমাজে এমনটি ঘটলে আমরা এর কঠোর সমালোচনা করতাম। কিন্তু ইসরাইলের ক্ষেত্রে আমরা তা করছি না।
মনে করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান হারে যে ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষ বাড়ছে, ইলহান ওমরকে নিয়ে বির্তক সৃষ্টি তার একটি উদহারন মাত্র। পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা গেছে - যুক্তরাষ্ট্রের ৪৮ শতাংশ মুসলিম অভিযোগ করেছে গত ১২ মাসে তারা কোনো না কোনোভাবে বৈষম্যের শিকার হয়ছে। ৭৫ শতাংশ মুসলিম মনে করে, তাদের বিরুদ্ধে "মারাত্মক" বৈষম্য করা হচ্ছে। প্রায় একই সংখ্যক মুসলিম মনে করে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মুসলিম বিদ্বেষী। ২০১৭ সালের এক হিসাব মনে. যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমের সংখ্যা সাড়ে ৩৩ লাখ। এই সংখ্যা এক দশক আগের তুলনায় ১০ লাখ বেড়েছে।
ইলহান ওমর যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের কন্ঠস্বর হিসাবে আগেই পরিচিতি পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে শে^তাঙ্গ আধিপত্যবাদের উন্থান ঘটছে তাতে একজন কালো মুসলিম নারী যে টার্গেট হবেন তা অস্বাভাবিক নয়। যার সাথে যোগ হয়েছে ক্ষমতাধর ইহুদি লবি। ইলহান ওমর এসব বাধা ডিঙ্গিয়ে ভবিষ্যতে কতটা সামনে এগুতে পারবেন তা এখন দেখার বিষয়।