আসছে ড্রোন, ভয়াল দিন

মনুষ্যবিহীন ড্রোন - সংগৃহীত

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৬ অক্টোবর ২০১৯, ২১:০০


মিডিয়ার কল্যাণে আজকাল সাধারণ মানুষও ‘ড্রোন’ শব্দটির সাথে পরিচিত। তারা জানে, ড্রোন হচ্ছে পাইলটবিহীন বিমান, যা সাধারনত যুদ্ধে, গোয়েন্দাগিরিতে ব্যবহৃত হওয়ার কথা এবং হচ্ছেও।


ড্রোন প্রযুক্তি প্রথম উদ্ভাবন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে ‘রাজনৈতিক কারণে’ তারা এ কর্মসূচি থেকে সরে এসেছে। আর তা লুফে নিয়েছে রাশিয়া, চীন এবং এমনকি ইসরাইলও। তারা ভাবছে, ভবিষ্যতে তাদের সামনে আছে যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধে এ স্টেলথ কমব্যাট ড্রোন বা মানুষবিহীন যুদ্ধযান (ইউক্যাভ) তাদের কাজে লাগবে।
স্টেলথ ড্রোন আধুনিক স্টেলথ জঙ্গি বিমানের চাইতে অনেক কম খরচে বানানো ও চালানো যায়, কিন্তু একটি কমব্যাট এয়ারক্র্যাফটের প্রায়-সব কাজই একে দিয়ে করানো যায়। ফলে যেসব দেশের হাতে অনেক টাকা নেই তারাও তাদের আকাশসীমা রক্ষা এবং আকাশে আধিপত্য বজায় রাখার লড়াইয়ে স্টেলথি ইউক্যাভ ব্যবহার করতে পারে। এর ফলে ওসব দেশ তাদের ব্যয়বহুল জঙ্গি বিমানের সংখ্যাও কমিয়ে ফেলতে পারে। কোন কোন দেশ চালকবিহীন জঙ্গি বিমান নিয়ে কাজ করছে।


প্রথমে ধরা যাক চীনের কথা। গত ১ অক্টোবর ছিল চীনের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষে আয়োজিত সামরিক প্যারেডে দেশটি প্রথমবারের মতো তাদের শার্প সোর্ড জিজে-১১ লিচিয়ান স্টিলথ কমব্যাট ড্রোন প্রদর্শন করে। এর আগে দেশটি পরীক্ষামূলকভাবে নির্মিত যেসব ড্রোন দেখিয়েছিল, অক্টোবর প্যারেডে প্রদর্শিত ড্রোনটি সেগুলোর চাইতে একেবারেই আলাদা।


চীন দাবি করছে, অক্টোবর প্যারেডে যেসব অস্ত্র প্রদর্শন করা হয়েছে তার সবগুলোই এখনই ব্যবহার-উপযোগী। তবে দেশটির এ দাবি অনেকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করছে না। তাদের মতে, জি জে-১১ এর আগের ছবি আর প্যারেডে প্রদর্শিত ড্রোনে অনেক তফাৎ। তাদের দেখানো ড্রোন এখনই কাজে লাগানো যাবে চীনের এ দাবি পুরোপুরি সত্য না-ও হতে পারে।


এবার দেখা যাক রাশিয়া কী করছে ড্রোন নিয়ে। গত জুলাই মাসে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় একটি ফুটেজ প্রকাশ করে। এতে তাদের নির্মিত সু-৭০ অখোনিক (হান্টার) নামের স্টিলথ কমব্যাট ড্রোনের পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন দেখানো হয়। চীনের জি জে-১১ এর চাইতে এটি অনেক বড়। এর ওজন প্রায় ২০ টন। এর পাখার দৈর্ঘ্য ২০ মিটার এবং এটি ঘণ্টায় এক হাজার কিলোমিটার গতিতে উড়তে পারে। এটিও সু-২৭ জঙ্গি বিমানের মতোই এআই-৩১ টারবোফ্যান ইঞ্জিন দিয়েই চলে। তবে তফাৎ হলো সু-২৭ জঙ্গি জেটে ইঞ্জিন লাগে দু’টো আর নতুন উদ্ভাবিত ড্রোনে একটি ইঞ্জিনেই কাজ চলে।


গত সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক ভিডিওতে দেখা যায়, সু-৭০ নামের ড্রোনটি সু-৫৭ জঙ্গি জেট বিমানের সাথে উড়ছে। বলা হচ্ছে, দু’টি বিমানই মিলিতভাবে লক্ষ্যস্থলে আঘাত হানতে সক্ষম।


রাশিয়া ও চীণ যে দু’টি ড্রোন বানিয়েছে, উভয়টিই বানানো হয়েছে ইউএস এক্স-৪৭ বি-র ওপর ভিত্তি করে। এক্স-৪৭বি নির্মাণ করা হয়েছিল আমেরিকান নৌবাহিনীর জন্য। এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নরথ্রপ গ্রুম্যান। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এটি প্রথম আকাশে ওড়ে। নৌবাহিনীর এ প্রকল্পের আগে আমেরিকান বিমান বাহিনী পরীক্ষামূলকভাবে একটি ইউক্যাভ বানিয়েছিল। এক্স-৪৫এ নামের এ স্টিলথি প্ল্যাটফর্মটির নির্মাতা ছিল বোয়িং-এর ফ্যান্টম ওয়ার্কস। নৌবাহিনীর ড্রোনের মতো এটিও পরিত্যক্ত হয়। তা সত্ত্বেও দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র সহযোগিতায় আমেরিকান বিমান বাহিনী একটি গোয়েন্দা বা নজরদারি স্টেলথ ড্রোন নির্মাণ করে।


লকহিড কোম্পানির বানানো এই ড্রোনটির নাম আর কিউ-১৭০। এটি আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে তালিবান ও আল-কায়েদার ওপর নজরদারি কাজে ব্যবহৃত হতো। পাকিস্তানে এটি পরিচিত ছিল ‘কান্দাহার জানোয়ার।’ এটিই পাকিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের গোপন অবস্থান খুঁজে বের করে।


একই সময়ে আর কিউ-১৭০ ড্রোনটি ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ওপরও নজর রাখতে সময়। ইরান ভূখ-ের ওপর দিয়ে কান্দাহার থেকে উড়ে যাওয়ার সময় এ নজরদারি চলতো। তবে ড্রোনটি ধরা খায় ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর। এদিন ইরান, সম্ভবত রাশিয়ার সহযোগিতায়, একটি আর কিউ-১৭০ ড্রোনকে ধরে ফেলতে সক্ষম হয়। মনে করা হয়, ইরানের ওপর দিয়ে চলাচলের কারণেই তারা ড্রোনটির নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। ইরান অথবা রাশিয়া সম্ভবত উপগ্রহের সাহায্যে এটির রিয়েল টাইম ডেটা লিংকে বিঘ্ন সৃষ্টি করে এবং এভাবে ড্রোনটির অবস্থান খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়।


কমব্যাট ড্রোনগুলোর চলার ধরন একেকটার একেক রকম। সবচাইতে পরিচিতটি হলো, ড্রোনের একজন চালক থাকবেন দূরে কোথাও, তা হোক স্থলে, সমুদ্রে কিংবা অন্য কোনো উড়োজাহাজের ভেতর। আর কিছু ড্রোন ওড়ে আধা-স্বাধীনভাবে এবং সেগুলোর অবস্থান আপডেট করা হয় জিপিএস বা অন্য কোনো উপগ্রহের সাহায্যে। সত্যিকার স্বাধীন ড্রোন হলো সেগুলো, যেগুলো কোনো ডেটা লিঙ্ক ছাড়াই একটি মিশন সম্পন্ন করতে পারে।


একটি কমব্যাট ড্রোন তার লক্ষ্যস্থলে হামলার আগে লক্ষ্যস্থলটি নিশ্চিত করতে চাইতেও পারে, আবার না-ও চাইতে পারে। কারণ, এর সাথে জড়িয়ে আছে নানা রকমের ডেটা লিঙ্ক। তা হতে পারে ডাইরেক্ট রেডিও লিঙ্ক অথবা স্যাটেলাইট কিংবা এয়ারক্র্যাফট।


ড্রোনের টার্গেট খোঁজার কাজে রাশিয়ানরা সু-৫৭ এবং এর এইএসএ রেডার ব্যবহার করছে। এতে তাদের ড্রোনের ব্যয়বহুল সেন্সর ব্যবহার করতে হচ্ছে না বলে খরচ সাশ্রয় হচ্ছে। তাছাড়া একটি জঙ্গি জেট বিমান দিয়ে একই সময়ে অনেকগুলো ড্রোনকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে। আর শত্রুর বিমান থেকে অনেক দূরে বসেই জঙ্গি জেট বিমানটি তা করতে পারছে। এর ফলে জঙ্গি বিমানে উচ্চক্ষমতার স্টিলথ সংযোজনের প্রয়োজন কমে আসছে, একই সময়ে আক্রমণ সক্ষমতা অনেক বেড়ে যাচ্ছে।
চীনের কথায় এলে বলতে হয়, এর জি জে-১১ ড্রোন অনেক বেশি রহস্যময়। এটি দেখতে এমনিতে স্টেলথ ড্রোনের মতোই, কিন্তু অক্টোবর প্যারেডে প্রদর্শিত মডেলটি দেখে মনে হয়েছে, এই ড্রোনটির আছে একটি সম্পূর্ণ সমন্বিত ইঞ্জিন। এর পাখার দৈর্ঘ্য ১৪ মিটার অর্থাৎ কিনা রাশিয়ান ড্রোনের চাইতে কম। বলা হচ্ছে, এটি আমেরিকান স্মল-ডায়ামিটার বোমা বহনকারী ড্রোনের চীনা সংস্করণ। আমেরিকার জিবিইড-২৭ আড়াই শ’ পাউন্ড বোমা বহন করতে পারতো। চীনেরটি পারে ৫০, ১০০ ও ২৫০ পাউন্ড।
তবে রাশিয়া ও চীন যত কথাই বলুক, তাদের স্টিলথ কমব্যাট এখনও যুদ্ধে কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুত হয়নি। তা হতে তাদের আরো ক’ বছর লাগবে।


ইসরাইলের আছে হারপ নামে একটি প্রায়-ড্রোন। ইসরাইল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ এটির নির্মাতা। এটি কারিগারি দিক থেকে ‘ভবঘুরে’ একটি যুদ্ধ-উপকরণ। এর বৈশিষ্ট্য হলো যদি কোনো কারণে এর মিশন প- হয়, তবে তা ঘাঁটিতে ফিরে আসতে পারে।


হারপ-কে বানানো হয়েছিল এমনভাবে যে, এটা তার টার্গেটে গিয়ে বিস্ফোরিত হবে। এটি ছয় ঘণ্টাব্যাপী স্বাধীনভাবে অপারেশন চালাতে পারে। এর ওয়্যারহেড খুবই ছোট, মাত্র ২৩ কেজি, তবে একেবারে নিখুঁত। ইসরাইল তার এই আধা-ড্রোনটি রফতানি করেছে আজারবাইজান, জার্মানি, তুরস্ক ও সিঙ্গাপুরে এবং নিজেরা ব্যবহার করেছে ইরাক ও সিরিয়ায় হামলার কাজে। আর আজারবাইজান ২০১৬ সালে নগর্নো-কারবাখ সঙ্কটকালে সফলভাবে কাজে লাগিয়েছে হারপকে।


ড্রোন নিয়ে খানিকটা এগিয়েছে ইরানও। তারা আমেরিকার আরকিউ-১৭০ ড্রোনকে ‘ক্লোন’ করে বানিয়েছে সায়েকেহ বা বজ্রাঘাত । এটি সিরিয়া থেকে ইসরাইলের ওপর দিয়ে ইরানে ফেরার সময় ইসরাইলের একটি অ্যাপাচে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। এছাড়া ইরান শাহেদ ১৭১ নামে একটি ড্রোনের কথাও বলে থাকে। তবে এটি সত্য নয়। তাদের হাতে এরকম কোনো ড্রোন নেই।


প্রতিবেদনের শুরুতেই যদিও বলা হয়েছে, আমেরিকা ড্রোন প্রযুক্তির উদ্ভাবক হয়েও ড্রোন কর্মসূচি বাদ দিয়েছে। বস্তুত, তারা এক ধরনের ড্রোন বাদ দিলেও এক্সকিউ-৫৮ নামের আরো উন্নত এক ধরনের ড্রোন নিয়ে মাঠে নেমেছে। মার্কিন বিমান বাহিনী গত মার্চে এর প্রথম এবং জুনে পরীক্ষামূলকভাবে এগুলো উড়িয়ে দেখেছে।
বলা হচ্ছে, নতুন ড্রোন অত্যাধুনিক জঙ্গি জেটের সাথে সমন্বিত হবে এবং এতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযোজন করা হবে। এতে করে এগুলো আরো দক্ষতার সাথে শত্রুর ওপর আঘাত হানতে সক্ষম হবে। মার্কিন কংগ্রেসের অনুমোদন পেলে এসব ড্রোন ২০২৩ সালে আকাশে উড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
সুতরাং বলা যায়, আগামী দিনে শুধু ড্রোনই আসছে না, আসছে ভয়াল দিনও।

এই প্রতিবেদনের ভিডিও  রুপ দেখতে নীচের লিংকে ক্লিক করুন