২০০২ সালে চীন তার নাগরিকদের যে দক্ষিণ এশীয় দেশটি সফরের অনুমতি দেয় সেটি হলো নেপাল। তখন চীনাদের মধ্যে নেপাল সফরের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। প্রতি বছর পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে চীনা পর্যটকের সংখ্যা। ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো এ সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। এর ফলে নেপালে একের পর এক গড়ে উঠতে থাকে চীনা রেস্তোরাঁ।
রমেশ বিশ্বকর্মা নামে এক নেপালী রাজধানী কাঠমান্ডুর থামেল এলাকায় খুলে বসলেন একটি চীনা খাবারের রেস্তোরাঁ। নাম নিউ চং কিং ওয়েই। রেস্তোরাঁর জন্য খুবই উপযোগী এলাকাটি। কারণ, রাতদিন সেখানে পর্যটক গিজ গিজ করে। রমেশ নিজেই রেস্তোরাঁর মালিক, নিজেই পাচক।
এক দিন তাঁর রেস্তোরাঁয় প্রথম একজন চীনা খদ্দেরকে ঢুকতে দেখলেন রমেশ। কিন্তু ঢুকেই, এদিক-ওদিক তাকিয়ে, রেস্তোরাঁয় নেপালীরা কাজ করছে দেখে গট গট করে যেমন ঢুকেছিল তেমন বেরিয়ে যেতে থাকলো। রমেশও ছাড়ার পাত্র নন। তিনি দৌড়ে গিয়ে পথ আগলে দাঁড়ালেন লোকটির সামনে। জানতে চাইলেন, ''কী ব্যাপার, মেন্যু জানতে চাইলে না, দাম জিজ্ঞেস করলে না, ঢুকেই চলে যাচ্ছো যে ? নেপালীরা চাইনিজ ফুড পাকাচ্ছে, তাই?''রমেশের মুখে চীনা ভাষায় সওয়াল শুনে থমকে গেল চীনা পর্যটক। রমেশ তাকে বললেন, ''তুমি একটা ডিশ তো মুখে তুলে দেখো!''
তা-ই হলো। রমেশের রেস্তোারাঁর সিচুয়ান ফুড খেয়ে চীনাম্যান ভারি খুশি। সে খবরটি পৌঁছে দিল তার বন্ধুদেরও। আর কী চাই, চীনাদের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠলো রমেশ বিশ্বকর্মার নিউ চং কিং ওয়েই রেস্তোরাঁ। রেস্তোরাঁটির ইন্টেরিয়র একেবারেই ছিমছাম। এর বসার আসনগুলো কৃত্রিম চামড়ায় মোড়ানো। কিন্তু রেস্তোরাঁর খাবার মোটেই সাধারণ নয়, বরং রমেশের রান্নার গুণে সুস্বাদু এবং মনমাতানো সুগন্ধে ভরপুর।
একদিনের দৃশ্যই বলা যাক। রেস্তোরাঁর বাইরের আঙ্গিনায় শামিয়ানার নিচে চারজন চীনা গ্রাহক বসে আছে। তারা হরদম সিগারেট ফুঁকছে আর ডুবে আছে মালা সস দিয়ে ষাঁড়ের ঠান্ডা মাংস খাওয়ায়। সেই খাবারের সৌরভে চারদিক ম ম করছে। রেস্তোরাঁর ভেতরে আছে প্রাইভেট ডাইনিং সেকশন। সেখানে বেইজিং থেকে আসা ছয় পর্যটক বসে আছেন। তারা নেপালে এবারই প্রথম। বন্ধুদের কাছে শুনেই এ রেস্তোরাঁয় খেতে এসেছেন। তারা খাচ্ছেন মশলাদার আস্ত মাছ রান্না, সাথে বিন সস।
রমেশের রেস্তোরাঁটি যেখানে অবস্থিত সেই থামেল এলাকাটি এক সময় পর্বতারোহী ও ট্র্যাকারদের পদচারণায় মুখর থাকতো। এখন তাদের জায়গা নিয়েছে চীনা পর্যটকরা। আর তাই সেখানে এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে প্রায় দেড় শ'র মতো চীনা মালিকানাধীন সিচুয়ান রেস্তোারাঁ। তাতে কিন্তু রমেশ বিশ্বকর্মার নিউ চং কিং ওয়েই রেস্তোারাঁর জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি, বরং রমেশ এখন ''সান দাই'' বা বড় দা নামেই নামেই সম্মানিত ও খ্যাতিমান হয়ে উঠেছেন।
তার রান্নাই শুধু সুস্বাদু নয়, তিনি চীনা খদ্দেরদের সাথে কথাও বলেন অনর্গল মান্দারিন বা চীনা ভাষায়, যদিও তিনি কখনো চীনের মাটিতে পা-ও রাখেননি। এভাবেই রমেশের রেস্তোরাঁটি যেন হয়ে উঠছে নেপালের পর্যটনশিল্প বিস্ফোরণের একটি প্রতীকে। পর্যটন শিল্প বিকাশের সাথে যুক্ত হচ্ছে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের চাহিদা। তারা নতুন নতুন দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে নতুন বাস্তবতার সাথে।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে নেপালে ২০১৫ সালের প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের কথা। ওই ভূমিকম্পে দেশটি একেবারে তচনচ হয়ে যায়। ভাঙ্গাচোরা দেশটি ভ্রমণে আসতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে চীনারা। অথচ ভারতের পর চীন থেকেই সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসে নেপালে। এ অবস্থায় চীনাদের নেপালে ফিরিয়ে আনতে দ্রূত ব্যবস্থা নেয় নেপাল সরকার; চীনা ট্যুরিস্টদের জন্য ভিসা ফী মওকুফ করা হয়। এর ফলও মিলে হাতে হাতে। ২০১৮ সালের তুলনায় চলতি ২০২০ সালে চীন থেকে দ্বিগুণেরও বেশি পর্যটক আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
পর্যটকদের এই জোয়ার সামাল দেয়ায় ভালো ভূমিকা রাখছে থামেল এলাকা। এখানে যেদিকে তাকানো হোক, চোখে পড়বে চীনা ভাষায় হোটেল-রেস্তোারাঁর বিজ্ঞাপন। ফুটপাথের হকাররাও চীনা ভাষায় পর্যটকদের ডাকাডাকি করছে - এমন দৃশ্যও অস্বাভাবিক নয়। থামেল এলাকায় ঠিক কতসংখ্যক চৈনিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে তা সুনির্দিষ্ট করে জানা না গেলেও নেপাল সরকারের এক দলিলে বলা হয়, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে দেশে ১৪ হাজার চাকরি সৃষ্টি হয়েছে, সেক্ষেত্রে প্রায় অর্ধেক অবদান চীনা মদদপুষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের।
উদাহরণ হিসেবে সিয়ান তাং নামে এক চৈনিক নারী উদ্যোক্তার কথা বলা যায়। পাঁচ বছ আগে তিনি তাঁর স্বামীকে নিয়ে থামেল এলাকায় খুলেছিলেন চিলিয়ান প্যাভিলিয়ন রেস্টূরেন্ট। সেখানে এখন ছয় জন নেপালী কর্মী কাজ করে। সিয়ান বলেন, একজন দোভাষী পাওয়ায় এখানে ব্যবসা করাটা অনেক সহজ হয়েছে। আর আগে এদেশে প্রতি নয় মাস পরপর সরকার বদল হতো। নেপাল এখন রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল। এ কারণে চীন থেকে পর্যটক আগমনের সংখ্যাও বাড়ছে।
চীনের শানদং প্রদেশের বাসিন্দা এ নারী বলেন, আমাদের যেসব বন্ধু নেপাল ভ্রমণ করে গেছে, তাদের মুখেই শুনেছি, কাঠমান্ডু একটি চমৎকার জায়গা। সেখানে বড় কোনো সমস্যা নেই। এ কথা শুনেই আমরা এখানে ব্যবসা করতে এসেছি।
নেপালে প্রথম চাইনিজ রেস্তোরাঁ চালু হয় '৮০র দশকের শেষ অথবা '৯০র দশকের গোড়ার দিকে। তখন লোকে একে বলতো ইন্ডিয়ান-চাইনিজ রান্না। ২০১০ সালেও থামেল এলাকায় এরকম রেস্তোরাঁর সংখ্যা চার-পাঁচটির বেশি ছিল না। ২০১২ সালের দিকে এর সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। চীনা পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধিই এর কারণ। কারণ, তারা এসেই চীনা খাবারের খোঁজ করে। ফলে এখন থামেলের ফুটপাথেও চীনা খাবার মেলে। চৈনিক রান্নায় উপাদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকম্পের আগে সেগুলো যোগাড়ের জন্য সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত দৌড়াতে হতো রেস্তোরাঁ-মালিকদের। এখন থামেলেই চীনা ব্যবসায়ীদের ১০টি দোকান হয়েছে। তারা সিচুয়ান থেকে খাদ্যোপকরণ আমদানি ও বিক্রি করে।
চীনা রেস্তোরাঁ-মালিক ও তাদের নেপালী পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে সম্পর্কও বেশ আন্তরিক। তবে সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছুই বদলে যায়। যেমন, শুরুতে যার কথা বলা হয়েছে সেই রমেশ বিশ্বকর্মাকে ওই জায়গার মালিক একদিন এসে বললো তার রেস্তোরাঁ সরিয়ে নিতে। কারণ, অন্য এক চীনা ব্যবসায়ী এ জায়গার জন্য দ্বিগুণ ভাড়া দিতে চেয়েছে। ক্রমবর্ধমান হারে চীনাদের আগমন ও অবস্থানের ফলে থামেল এলাকা তার চিরায়ত বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে - এমন উদ্বেগও ক্রমেই বাড়ছে নেপালের অনেকের কাছে।
নেপাল সরকারও উদ্বিগ্ন 'উইচ্যাট', 'আলি পে' ইত্যাদি চাইনিজ ডিজিটাল ওয়ালেট নিয়ে। সরকারি নিয়মকে পাশ কাটিয়ে লেনদেনের দায়ে নেপাল এ দু'টোকে ২০১৯ সালের মে মাসে নিষিদ্ধ করে। আলি পে অবশ্য বলেছে, তারা নেপালে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করবে, তবে এখনো করেনি। এভাবেই নেপাল-চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যত জোরদার হচ্ছে, নেপালে চীনা পর্যটকের সংখ্যাও ততোই বাড়ছে, আর বাড়ছে নেপালের আয়। ২০১৮ সালে পর্যটন খাত থেকে নেপালের অর্থনীতিতে যোগ হয় ৬১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যান্য দেশের পর্যটকরা প্রতিদিন গড়ে ৪৪ মার্কিন ডলার ব্যয় করলেও চীনারা করে ১০০ ডলার। তাই তো থামেলের ব্যবসায়ীরা বলেন, চীনা পর্যটকরা না এলে আমাদের ব্যবসা করাই কঠিন হয়ে যেত। নেপালী উদ্যোক্তারা এখন আর ভয় পান না। তাদের চোখ খুলে গেছে। নেপাল সরকারও বসে নেই। আরো পর্যটক আকর্ষণ করতে তারা হিমালয় অভিযানের ফি কমিয়েছে, চীনা অভিনেত্রী সু কিং-কে নিয়োগ দিয়েছে ট্যুরিজম গুডউইল অ্যাম্বাসেডর হিসেবে। সব মিলিয়ে পর্যটনকে নিয়ে নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখছে নেপাল। এখন কেবল দেখার অপেক্ষা, তারা কত দূর যেতে পারে।