তখন সাগর আরো দিক্ষণে ছিলো। মিয়ানমার থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ছিলো বিস্তীর্ণ ভূমি। এই ভূমি ভেঙে যায় বড় কিছু ভূমিকম্পে। সুনামি এসে প্লাবিত করে। মাথা উঁচু করে থাকে কিছু পাহাড়ের চূড়া। সেই চূড়াগুলোই এখন দ্বীপ। আর এমন কিছু দ্বীপ নিয়েই আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। মোট আয়তন ৮ হাজার ২৫০ বর্গকিলোমিটার। ওই পুঞ্জে আছে ৫৭২ টি দ্বীপ। কিছু দ্বীপে মানুষ থাকে। কিছু দ্বীপ জনমানবহীন। তবে সবগুলো দ্বীপেই আছে পাহাড়ি ভূমির চিহ্ন। একটি দ্বীপের নাম ব্যারন। ওখানে ঘুমিয়ে আছে আগ্নেয়গিরি। ১৯৯১ সালে জেগে উঠেছিলো ওটা। এর আগে ঘুম ভেঙেছিলো ১৮০৩ সালে। বৃটিশ এক নাবিকের দাবি ১৭৯৫ সালেও ওই দ্বীপে ঘুমন্ত গিরিটিকে জ¦লে উঠতে দেখা গেছে।
বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরের সীমান্তে এই আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। এখন ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। একটা সময় ছিলো জাপানের নিয়ন্ত্রণে। তারও আগে বৃটেনের। তখন উপমহাদেশে ছিলো বৃটিশ শাসন। এর আগে এই দ্বীপ ছিলো সভ্যতার চোখের বাইরে। তখন ওখানে বসতি ছিলো আদিম কিছু জনগোষ্ঠির। এদের অনেকেই টিকে আছে এখনো। আগে ওরা লড়াই করতো প্রকৃতির সঙ্গে। এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে প্রধান প্রতিপক্ষ সভ্য পৃথিবী। আন্দামান নিকোবরের দ্বীপগুলোর ইতিহাস দীর্ঘ। ওই ইতিহাসের সবটাজুড়ে রোমাঞ্চ আর লড়াইয়ের গল্প।
গল্পগুলো থরে থরে সাজানো আছে ওখানকার একটি জাদুঘরে। জাদুঘরের পেছনের গল্পটাও দুঃসহ, নির্যাতনের। দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার। ওখানেই তিনতলা কাঠামো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই জাদুঘর। একটা সময় এটা ছিলো কারাগার। কুখ্যাত ‘কুঠুরি কারাগার’। কেমন ছিলো ওটা? জানতে হলে ঘুরে আসতে হবে এখনকার এই জাদুঘরের ভেতর থেকেই। জাদুঘরে আছে আন্দামানের অতীত। এই দ্বীপে মানুষ এসেছিলো আফ্রিকা থেকে। এরা এশিয় উপকূল দিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছে। কেউ কেউ থেকে গেছে ভারত উপমহাদেশের এমন কিছু দ্বীপে। এর পর বহু শতাব্দী পেরিয়ে গেছে। দ্বীপে ছুঁয়া লেগেছে সভ্য পৃথিবীর। তবে সভ্যতার ¯্রােতে ভেসে যায়নি সব। আন্দামানের আদিম অরণ্যে এখনো টিকে আছে সেইসব জনগোষ্ঠী।
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে মূলত চারটি আফ্রিকার উপজাতি গোত্র বাস করে। গ্রেট আন্দামানিজ, অনেজ, জারোয়া এবং সেন্টিনেলিজ। নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বাস করে দুইটি মঙ্গোলয়েড গোত্র-শোম্পেন এবং নিকোবরিজ।
এদের মধ্যে রহস্যময় গোত্র সেন্টিনেলিজ এবং জারোয়া। বৃটিশ সময় থেকে এদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ব্যর্থ হতে হয়েছে। ভারত সরকারও বহুবার সেন্টিনেলিজদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ। সেন্টিনেলিজরা আপোষহীন। এখনো দ্বীপের কাছে ঘেঁষতে দেয় না বহিরাগতদের।
জারোয়ারাও এমন-ই ছিলো। এরা দেখতে মিশমিশে কালো। খাটো গড়ন। পেশীবহুল শরীর। থাকে আলাদা দ্বীপে, নিজেদের মতো করে। এখনো ওদের হাতে থাকে তীর-ধনুক। বিশ মাখানো তীর ছুঁড়ে শিকার ধরে। বনে বনে ঘুরে। ফল খায়, মাছ ধরে। শূকর শিকার করে। পাথরে ঠুকে আগুন জ্বালায়। আর পালিয়ে বেড়ায় সভ্য পৃথিবী থেকে।
বেশ কিছু বছর আগেও বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচয় ছিলো না জারোয়াদের। আন্দামান নিকোবর পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়ার পর এরা কৌতুহলী হতে থাকে। দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে পাশের দ্বীপগুলোতে সভ্য মানুষের আনাগোনা। তবে তখনো কেউ তাদের কাছে ভীড়তে পারতো না। নৌকা নিয়ে ওদের ভূমিতে যেতে চাইলে বিষ মাখানো তীর ছুঁড়ে হত্যা করতো জারোয়ারা।
তখন ১৯৯৮ সাল, আন্দামানে শুরু হয় জঙ্গল সাফারি। আধুনিক নিরাপত্তা নিয়ে দলে দলে পর্যটক ঢুকতে থাকে জঙ্গলে। হুমকির মুখে পড়ে জারোয়ারা। জারোয়া নারী-পুরুষদেরকে খাবারের লোভ দেখাতে থাকে পর্যটকরা। ধীরে ধীরে ভয় কাটতে শুরু করে। মিশতে থাকে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে। সেই সুযোগটাই নেয় কিছু পর্যটক। এরা জারোয়া নারীদের ব্যবহার করতে থাকে অনৈতিক কাজে। ট্যুর অপারেটর কোম্পানিগুলো আয়োজন করতে থাকে ‘জারোয়া জলসা’র। এসব জলসায় জারোয়া নারীদের উলঙ্গ নাচ দেখানো হতো। জারোয়ারা যখন আধুনিক বিশ্বের বিনোদনের চরমে, তখন ভারতীয় আদালত একটি রায় দেয়। রায়ে তাদের আবাসভূমিকে সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। নিষিদ্ধ করা হয় পর্যটকদের জন্য।
এর পর থেকে জারোয়াদের দিন ঘুরতে থাকে। এদের জন্য পৃথিবীব্যাপি তৈরি হয় সহানুভূতি। জারোয়ারা যেন নিজেদের ভূমিতে নিজেদের মতো করে থাকতে পারে, সেজন্য চলতে থাকে সচেতনতামূলক প্রচার। স্থানীয় প্রশাসনও এ ব্যাপারে সজাগ। তবুও সব ভালোভাবে চলছে না ওদের। জারোয়ারা যেখানে থাকে, সেই এলাকার মাঝ বরাবর বানানো হয়েছে একটি আধুনিক সড়ক। দিনের ভেতর অনেকবার পর্যটকদের গাড়ি যাতায়াত করে ওই সড়ক ধরে। এরা মূলত জারোয়াদের দেখা পেতেই যান ওই পথে।
একটা সময় ওইসব দ্বীপ ছিলো আদিম গোত্রগুলোর। গোত্রের সঙ্গে গোত্রের বিবাদ হতো। তবে সবাই থাকতো প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে। বাইরের দুনিয়ার কাছে দ্বীপগুলো ছিলো বিপদসঙ্কুল, দুর্গম। সাগরে বাণিজ্য জাহাজ ভাসতো। দূর থেকে দ্বীপ দেখতো। বিপদ হলে এখানে আশ্রয়ও নিতো নাবিকেরা। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে মারাঠারা এখানে আসে এবং দ্বীপ দখলে নেয়। অষ্টদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে কয়েকবার বৃটিশ, ডাচ এবং পর্তুগীজদের জাহাজ দখলকারী মারাঠা নৌসেনাপতি কানহোজী আংগ্রে ঘাঁটি গড়ে তুলেন। ১৭২৯ সালে আংগ্রের মৃত্যু হয়।
দ্বীপপুঞ্জের দিকে চোখ পড়ো বৃটিশদের। তখন ভারত উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দাপট। সাগরে ভাসতো তাদের বাণিজ্য জাহাজ। ইউরোপের কিছু দেশের জাহাজও দেখা যেতো। পূব দিক থেকে ভারতে ঢুকতে হলে আন্দামান ছিলো জাহাজগুলোর মূল দরজা। সে কারণেই বৃটিশদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে এই দ্বীপ।
১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত উপমহাদেশের ওপর পুরোপুরি চেপে বসলো। শুরু হলো তাদের একচ্ছত্র রাজত্ব। ১৭৮৯ সালে বৃটিশ ক্যাপ্টেন ব্লেয়ারের নজর যায় আন্দামানে। তিনিই প্রথম এখানে বসতি গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। সে কারণেই ওই অঞ্চলের রাজধানী, বন্দরদ্বীপের নাম রাখা হয় ব্লেয়ারের নামে, পোর্ট ব্লেয়ার।
বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে যারা বন্দী ছিলেন, তাদের মধ্য থেকে তিন শ’ কয়েদিকে নিয়ে যান ওই দ্বীপে। জঙ্গল পরিষ্কার করার কাজ দেওয়া হয় এদের। কিছু বসতিও গড়ে তোলা হয়। তবে তাদের ওপর হামলে পড়ে ম্যালেরিয়া রোগ। বছর তিনেক পর অন্য একটি দ্বীপে চলে যেতে বাধ্য হন তারা। কিন্তু ওখানেও ম্যালেরিয়া। শেষে আন্দামান ছেড়ে ফেরত আসেন ব্লেয়ার সাহেব।
কেটে যায় আরো অনেক বছর। ১৮৫৭ সালে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে উপমহাদেশে শুরু হয় সিপাহী বিপ্লব। মেরে ফেলা হয় অনেক বিপ্লবীকে। বন্দী করা হয় অসংখ্য সাধারণ ও সিপাহীদের। এদের মধ্যে অনেক বাঙালিও ছিলেন। ১৮৫৮ সালে বিপ্লবীদের নির্বাসনে পাঠানো শুরু হয় আন্দামানে। জাহাজ ভরে বাঙালিদেরও পাঠানো হতে থাকে। মূলত সে কারণে ওই দ্বীপে বাংলা ভাষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের পর ওখানেই সবচেয়ে বেশি বাংলা বলা হয়।
বিদ্রোহীদের যখন থেকে আন্দামানে নির্বাসন দেওয়া শুরু হলো তখনো দ্বীপগুলো দুর্গম রয়ে গেছে। ঘন জঙ্গলের ভেতর ছেড়ে দেওয়া হয় নির্বাসিতদের। প্রকৃতি এবং রোগের সঙ্গে লড়াই করে যারা বেঁচে থাকতো তারা মাথার ওপর কোনোরকম ছাউনি তৈরি করে নিতো। ১৮৯৬ সালে সেখানে গড়ে তোলা হয় কারাগার। কারাগারে রাখা হয় ছোট ছোট কুঠুরি। এক কুঠুরি থেকে অন্য কুঠুরিতে যোগাযোগের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। কুখ্যাত সেই কারাগারকে ডাকা হতে থাকলো ‘সেলুলার জেল’। অর্থাৎ ‘কুঠুরি কারাগার’। ভীতিকর এই কারাগারে পাঠানোর শাস্তিকে ডাকা হতো ‘কালাপানি পার’। সাগরের কালো পানি পার হয়ে যাদের এই দ্বীপে পাঠানো হতো, তারা আর ফিরে আসতো না। কালাপানি পেরিয়ে ওই দ্বীপ থেকে পালানোর কথা ভাবতেও পারতো না। দিনে কঠোর শ্রম এবং রাতে অন্ধকার কুঠুরিতে থাকতে হতো তাদের। এখানে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু হয়েছে বৃটিশবিরোধী অনেক স্বাধীনতাকামীর।
বৃটিশরা শেষ পর্যন্ত দখলে রাখতে পারেনি ওই এলাকা। ১৯৪২ সালে জাপানী সেনারা দখল করে নেয় আন্দামান ও নিকোবর। ১৯৪৫ সালের বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এরাই ছিলো দ্বীপগুলোর মালিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয় জাপান। বৃটিশরা ভারত ছেড়ে চলে যায়। ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ যায় ভারতের কাছে। কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়া বন্দীদের অনেকের শরীরে তখন শক্তি ছিলো না। এরা থেকে যান ওই দ্বীপেই।
শুরু হয় নিরাপদ বসতি। আর বিকাশ ঘটতে থাকে পর্যটনের। ২০১১ সালের হিসাবে ওই এলাকার লোকসংখ্যা ৩ লাখ ৮০ হাজার ৩৮১ জন। লোকেরা কথা বলে বিভিন্ন ভাষায়। প্রধান ভাষা নিকোবরি। এছাড়া আছে বাংলা ভাষার প্রাধান্য। পর্যটকদের সুবিধার জন্য ইংরেজি এবং হিন্দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তামিল, তেলেগু ভাষারও প্রচলন আছে ওখানে।
বন আর সাগরের টানে পর্যটকরা ছুটে যান আন্দামানে। তাদের জন্য কুখ্যাত সেই কারগারটিকে বানানো হয়েছে জাদুঘর। জাদুঘরের ওপর টাওয়ারের মতো করে আরো দুটো তলা বাড়ানো হয়েছে। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় ওই টাওয়ারে। ওখান থেকে দেখা যায় পুরো বন্দর। বন্দর ঘিরে সাগরের কালো পানি।
কুঠুরি কারাগার থেকে একটু এগুলেই রাজিব গান্ধী ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্স। ওখানে একদিকে আছড়ে পড়ছে সাগর। অন্যদিকে টলটলে স্থির জল। ওখানে সন্ধ্যা নামে সাগর আর আকাশকে সঙ্গে নিয়ে।
প্রাচীন এই দ্বীপভূমিতে আছে হাজার রঙ। সাগরের পানি কালো, আবার স্বচ্ছ। কোথাও তিন রঙে ভাগ হয়ে আছে। হালকা নীল, তারপর গাঢ়। শেষে গভীর নীল। সন্ধ্যার পর সবটাই কালো। দ্বীপগুলো পাথুরে। পাথরের ওপর সবুজ। আছে নারিকেল ও পাম গাছ। সৈকতে স্বচ্ছ জল। জলের তলে ডুবে থাকে প্রবাল। আর থাকে সাগরতলের রহস্য। এই রহস্য ভেদ করতে চাইলে ডাইভ দিতে পারেন আপনিও। সাগরে কিম্বা বনে নেমে যেতে পারেন দুঃসাহসিক অভিযানে।
তবে সব জায়গায় দুঃসাহস নয়।
মনে রাখতে হবে, দ্বীপটি পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হলেও ভূ-রাজনীতিতে এর গুরুত্ব আলাদা। অতীতে যেমন বিভিন্ন দেশের নজর ছিলো এর ওপর, এখনো আছে। সে কারণে ভারত ওখানে তৈরি করেছে সামরিক ঘাঁটি। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপ নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ‘আন্দামান অ্যান্ড নিকোবর কমান্ড’। ওখান থেকে নজর রাখছে মলাক্কা প্রণালীতে টহলে থাকা চীনের সাবমেরিনগুলোর ওপর। পাল্টা নজর আছে চীনেরও। মহাসাগরে ঘন ঘন ভাসতে দেখা যায় চীনের জাহাজ। আন্দামান ও নিকোবর হয়ে উঠেছে চীন-ভারতের নতুন রণাঙ্গন। সুতরাং মাত্রা ছাড়িয়ে কোনো দুঃসাহস দেখাতে যাওয়াটা হবে বোকামি। তাছাড়া বেপরোয়া দুঃসাহস আপনার সঙ্গে বাঁধিয়ে দিতে পারে জারোয়া কিম্বা সেন্টিনেলিজদের যুদ্ধ।