বিশ্বের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের একজন সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্ম মোহাম্মদ বিন সালমান। একই সাথে উত্তরাধিকার সূত্রে বিপুল অর্থের মালিক। দুনিয়ার অর্থশালী ব্যক্তিরা যেভাবে বিলাসী জীবন যাপন করেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স তার ব্যতিক্রম নন। ৩৩ বছর বয়সী ক্রাউন প্রিন্স সৌদি রাজ পরিবারের বিস্তৃত সম্পদের বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রন করেন। যার পরিমান হতে পারে ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার।
২০১৫ সালের কথা। তখন এক অজ্ঞাত ক্রেতা ২৩ কোটি ডলার খরচ করে একটি শ্যাটো বা আবাসিক বাড়ি কিনে বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছেন। কিন্তু সে সময় এই ক্রেতার নাম গোপন করা হয়েছিলো। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের পশ্চিমে ওই বাড়িটির অবস্থান। তখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হওয়া বাড়ি ছিলো এটি। বছর দুয়েক পর খবরে বলা হয়েছে- ৩৪ বছর বয়সী সৌদি রাজপুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানই কিনে নিয়েছিলেন ওই বাড়ি।
ফ্রান্স সফরে গিয়ে ৫০ হাজার বর্গফুটের শ্যাটো লুইস এক্সআইভির প্রেমে পড়ে যান তিনি। বাড়িটিতে তিনটি শয়নকক্ষ, একটি ইনডোর ও আউটডোর পুল, একটি লাইব্রেরি ও অ্যাকুরিয়ামে দিয়ে সাজানো রয়েছে বাড়িটি। এই বাড়ি দেখার পর যুব রাজের এতোটাই ভালো লেগে যায় যে সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। দাম শুনে চক্ষু চড়ক গাছ হয়েছিলো কী ? না সৌদি যুবরাজ বলে কথা। টাকার অংকে পরিমান অনেক বেশি মনে হলেও ভালো লাগার মুল্য আরো বেশি। ফলে নিশ্চিত ভাবে কিনে ফেলেন বাড়িটি। ভালোবাসার জিনিসের জন্য অর্থ খরচ করতে তিনি খুব একটা ভাবেন না।
এতো গেলো একটি বাড়িক কথা। দুনিয়ার অর্থশালী ব্যক্তিদের চলাচলের জন্য কিন্তু থাকে নিজস্ব বিমান। সৌদি যুবরাজেরও আছে। থাকে প্রমোদতরী। হ্যা সেটিও আছে। আর এই প্রমোদ তরী কেনা নিয়ে দুনিয়া জুড়ে কম আলোচনা হয়নি। আসুন আমরা জেনে আসি বিন সালমানের প্রমোদতরীটি কেমন।
বিশ্বেল সবচেয়ে বড় প্রমোদকরী বা ইয়টের একটির নাম সেরিন। রাশিয়ার ভদকা ধনকুবের হিসাবে পরিচিত ইউরি শেলফারের কাছ থেকে সৌদি রাজপুত্র ২০১৫ সালে এই সুপার ইয়ট কেনেন ৩৮ কোটি ডলার খরচ করে। ইতালের শিপইয়ার্ডে এই ব্যয়বহুল ইয়টটি বানানো হয়। এক সময় বিখ্যাত ধনকুবের বিল গেটস এই ইয়টটি লিজ নিয়েছিলেন। এই ইয়টের যার দৈর্ঘ্য হবে ৪৩৯ ফুট ৪ ইঞ্চি। আর কড়িকাঠের প্রস্থ হবে ৬০ ফুট। গত বছর ইয়টের খোলের মারাত্মক ক্ষতি’ হয়। মিশরের শারম আল শেখে যাওয়ার উদ্দেশ্য লোহিতসাগর দিয়ে চলাচল করার সময় জলমগ্ন চড়ায় ভাসমান পাথরে আঘাত লেগে এই ক্ষতি হয়েছে।
শুধু ইয়ট নয় বিশ্বখ্যাত ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মতো বিন সালমানের বিখ্যাত সব পেইনিটং কেনার প্রতি ঝোক আছে। যেকোনো ধনাঢ্য ব্যক্তির মতোই শিল্পকর্ম পছন্দ করেন মোহাম্মদ বিন সালমান। কিন্তু একটি শিল্পকর্ম নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে। ২০১৭ সালে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির একটি বিরল শিল্পকর্ম ৩৪ কোটি ডলার খরচ করে কিনে নেন সৌদি যুবরাজ। এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রীত কোনো শিল্পকর্ম হচ্ছে দা ভিঞ্চির এই সালভাতোর মুন্ডি। অবশ্য নিলাম প্রতিষ্টান ক্রিস্টি এই খবর প্রত্যাখন করে। বর্তমানে আবুধাবির ল্যুভর জাদুঘরে ওই শিল্পকর্মটি রয়েছে।
সম্প্রতি বৃটিশ ট্যাবলয়েড সান খবর দিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নিয়ন্ত্রণ নিতে যাচ্ছেন। এ জন্য যুবরাজ ৩০০ কোটি ডলার দর হাকা হয়েছে। যা হবে এই ক্লাবের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দর।
অসাধারণ ইয়ট, ফরাসি বাড়ি ও বিরল শিল্পকর্ম কিনতে লাখো ডলার খরচ করতে পারেন যে রাজপুত্র তার বন্ধুত্বও রয়েছে উচ্চপর্যায়ে। হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেছেন তিনি। ট্রাম্প তাকে বন্ধু বলে সম্বোধন করেছেন। ট্রাম্পের জামাই জ্যারেড কুশনারও তার বন্ধু।
সৌদি আরবের দুর্দান্ত প্রতাপশালী ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান, সংক্ষেপে যাকে বলা হয় এমবিএস। তার জন্ম ১৯৮৫ সালে রিয়াদে। লেখাপড়া করেছেন আইন বিষয়ে। তিন সন্তানের জনক বিন সালমান কাগজে কলমে ক্রাউন প্রিন্স হলেও সৌদি আরবের সবচেয়ে ক্ষমতার ব্যক্তি এখন তিনিই। বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের তৃতীয় স্ত্রীর সংসারের বড় ছেলে। ২০১৫ সালে সামলান বাদশাহ হওয়ার পর থেকেই তার ছেলে মোহাম্মদ ধীরে ধীরে নিজেকে নিয়ে আসেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে।
বাবার ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করেই তিনি এগিয়েছেন মসনদের দিকে। বার্ধক্য আর অসুস্থতার কারণে রাজকাজে সালমানের অক্ষমতাও বাড়তি সুযোগ তৈরি করে বিন সালমানের জন্য। তৎকালীন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে তাকে ক্রাউন প্রিন্স করেন বাদশাহ সালমান। সমালোচকেরা বলেন, পিতাকে ম্যানেজ করে বিন সালমান এই পদে বসেছেন। এ ঘটনা নিয়ে রাজপরিবারে কিছুটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়েছিল। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে একটি পালাবদল আসে সৌদি রাজবংশে। সাম্প্রতিক অতীতে সাবেক বাদশাহ আবদুল আজিজের বংশধরদের মধ্যেই পর্যায়ক্রমে ও ভাগাভাগি করে রাজকাজ পরিচালিত হতো। তারই ধারাবাহিকতায় সালমান বিন আবদুল আজিজের উত্তরাধিকারী বা ক্রাউন প্রিন্স মনোনীত হয়েছিলেন তার ভাতিজা ও আবদুল আজিজের নাতি মোহাম্মদ বিন নায়েফ। কিন্তু তাকে অপসারণ করে উত্তরাধিকারীর পদে বাদশার ছেলেকে বসানোর মধ্য দিয়ে শাসনক্ষমতা এখন পুরোপুরি মোহাম্মদ বিন সালমানের চলে আসে।
ব্যক্তিগত বিলাসী জীবন যাপনের পাশাপাশি সৌদি আরবকে বদলে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন ক্রাউন প্রিন্স। যা পশ্চিমা বিশ্বে তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। আসুন আমরা জেনে নেই সৌদি আরবকে কিভাবে বদলে দেয়ার কাজ করছেন ক্রাউন প্রিন্স।
সৌদি আরবকে বদলে ফেলতে নানা উদ্যেগ নিয়েছেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেড়িয়ে আসতে সৌদি আরবকে একটি পর্যটন নগরী হিসাবে গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। দুবাইয়ের মতো করে তিনি গড়ে তুলতে চান জেদ্দাকে। যেখানে থাকবে নাইট ক্লাব, বার ও বিদেশি শিল্পীদের কনসার্টের আয়োজন। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স ইতোমধ্যে দেশটির আভ্যন্তরিন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনছেন। নারীদের সিনেমা দেখা, গাড়ি চালানো এবং স্টেডিয়ামে পুরুষ সঙ্গীর সাথে খেলা দেখার অনুমতি দেয়া হয়েছে। বিদেশি পর্যটক টানতে লোহিত সাগরের সৈকতে আর্ন্তজাতিক মানের অনেকগুলো বিলাসবহুল রিসোর্ট তৈরি করতে যাচ্ছে সৌদি আরব।
‘রেড সি প্রজেক্ট’ নামে এই পরিকল্পনার মুল লক্ষ হলো তেলের উপর নির্ভরতা কমিয়ে পর্যটন থেকে আয় বাড়ানো। পর্যটনের উন্নয়নে বৃহৎ এই প্রকল্পের অধীনে ২০২২ সালের মধ্যে সৌদি আরবের শহর আমলাজ ও আল-জাওয়াহের মধ্যবর্তী লোহিত সাগরের উপকূলঘেঁষে প্রায় ৫০টি দ্বীপে রিসোর্ট তৈরি করা হবে। সেখানে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য উপভোগ, কোরাল রিফে ডাইভিং ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো পরিদর্শনের সুযোগ থাকবে।
সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান পশ্চিমা জন মানসে একজন সংস্কারকামী নেতা হিসাবে হাজির করার চেষ্টা করছেন। তার বিলাসী জীবন পশিচমা গনমাধ্যমে নানা সময়ে আলোচনার বিষয়ে পরিনত হয়েছে। নিজের জীবনের মতো করে তিনি সৌদি আরবকে কতটা বদলাতে পারেন তা দেখার বিষয়।