মানকল্যাণে ধনকুবেরদের দানের প্রচলন শত শত বছর ধরেই চলে আসছে। তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এটি ব্যাপকভাবে শুরু হয়। সে সময় শিল্পায়নের প্রবৃদ্ধির যুগে প্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায়ের মুনাফাভোগীদের সাথে নিম্নস্তরের কর্মীদের ব্যাপক আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়। এই সমস্যার সমাধানে কিংবা নিজেদের সুনাম বৃদ্ধি অথবা মানবিক দায়িত্ববোধ যে কারণেই হোক, বিশ্বের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ধনী ব্যক্তি তাদের সম্পদের বিরাট অংশ দান করার সিদ্ধান্ত নেন।
পশ্চিমা শিল্পপতিদের মধ্যে মহৎ কাজের অগ্রপথিক ছিলেন স্কটল্যান্ডে জন্ম নেয়া মার্কিন শিল্পপতি এন্ড্রু কার্নেগি। যিনি ১৯০১ সালে ছিলেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী। জীবদ্দশায় কার্নেগি তার সম্পদের নব্বই শতাংশই মানবকল্যাণে দান করেন। অঙ্কের হিসাবে যার পরিমাণ ছিল ৩৫ কোটি মার্কিন ডলার। মূল্যস্ফীতি হিসেবে ধরলে বর্তমান বাজারে যার মূল্য আনুমানিক ৫০০ কোটি ডলার। কার্নেগি দুই হাজার আট শরও বেশি পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। পেনসিলভেনিয়ার পিটসবার্গের কার্নেগি-মেলন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা তিনি। নিউ ইয়র্কের কার্নেগি হলসহ বেশ কয়েকটি থিয়েটার হলও এই মহান ব্যক্তির অনুদানে তৈরি।
সফল উদ্যোক্তাদের মানবকল্যাণে কাজ করাকে নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করতেন কার্নেগি। এ বিষয়ে ১৮৮৯ ‘সম্পদের সুসমাচার’ নামে একটি বই লেখেন তিনি। বইটিকে বিবেচনা করা হয় দাতাদের জন্য পথনির্দেশক হিসেবে। ১৯১৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন এন্ড্রু কার্নেগি।
কার্নেগির উত্তরসূরি হিসেবে আরেক শীর্ষ ধনী জন ডি রকফেলারও তার দেখানো পথেই হাঁটেন। এই তেল ব্যবসায়ীর মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৪০ কোটি মার্কিন ডলার, বর্তমান বাজারে যা প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সমান। বিশ্বব্যাপী মানবকল্যাণে নিবেদিত এই মানুষটির অনুদানে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ববিখ্যাত শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়। মানুষকে বিভিন্ন জটিল রোগের ভ্যাকসিন দেয়ার প্রকল্প চালু করেন তিনি। এ ছাড়া জন হপকিন্স ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জনস্বাস্থ্য বিভাগ চালু করেন তিনি।
গাড়ি প্রস্তুতকারক হেনরি ফোর্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন আমেরিকার সবচেয়ে বড় দাতব্য চিকিৎসালয়। শিল্পপতি জ্যাঁ পল গেটি প্রতিষ্ঠা করেন আমেরিকার সবচেয়ে নামকরা শিল্পকলা প্রতিষ্ঠান। এসব দানবীর কর্মকান্ড সম্পর্কে বিখ্যাত লেখক মার্ক ডোয়ি বলেন, যদিও প্রত্যেক দানবীরের কাজের ভিন্নতা ছিল, তবু সবারই উদ্দেশ্য ছিল মানবকল্যাণ।
দান-অনুদানের ক্ষেত্রে বর্তমান যুগের অনেক ধনকুবেরও পিছিয়ে আছেন তা নয়। অনেক শিল্পপতি তাদের পূর্বসূরিদের দেখানো পথেই হাঁটছেন। আবার উদ্দেশ্য ও কর্মপরিধিতে অনেক ক্ষেত্রে তারা ছাড়িয়ে গেছেন ইতিহাসকেও।
মাক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। বিল গেটস ইতোমধ্যে নিজের সম্পদ থেকে এই প্রতিষ্ঠানে দুই হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার দান করেছেন। পাশাপাশি তিনি বিশ্বের দ্বিতীয় সম্পদশালী ওয়ারেন বাফেটকে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনে অর্থদান করতে অনুপ্রাণিত করেন। বাফেট পর্যায়ক্রমে তার সম্পদের ৮৫ শতাংশ বিল গেটসের ফাউন্ডেশনে দান করেন, যার পরিমাণ ছয় হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার।
বতর্মানে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের চার হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের বৃত্তিকার্যক্রম চলছে, যা কার্নেগি, রকফেলার ও ফোর্ডের সম্মিলিত অনুদানের চেয়েও বেশি। এ প্রতিষ্ঠানটির দাতব্য কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে অনেক বিস্তৃত পরিসরে। তবে তাদের মূল ফোকাস হচ্ছে দরিদ্র দেশগুলোতে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করা। তাদের শতকোটি ডলারের টিকাদান কর্মসূচি উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে পোলিও নির্মূল করতে সাহায্য করছে। পাশাপাশি হাম রোগে ৯০ শতাংশ, যক্ষ্মা রোগে ৪৫ শতাংশ ও ম্যালেরিয়ায় ৩০ শতাংশ মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে সাহায্য করেছে।
বিশ্বমানব হিতৈষী জোটের প্রেসিডেন্ট অ্যান পিটারসেন বলেন, ‘আমেরিকার অনুদানগুলো সাধারণত স্থানীয়ভাবে কাজে লাগানো হতো। কিন্তু বর্তমানে এ ধরনের অনুদান বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা চালু হয়েছে এবং যা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।’
বিলগেটস বা ওয়ারেন বাফেটের মতো ব্যবসায়ী বা ধনী ব্যক্তিরা নিজেদের মানবসেবামুলক কাজে অন্যদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছেন। বিশ্বের শীর্ষ দুই ধনী ব্যক্তি অন্যদের এই পথে আনার লক্ষ্যে কাজ করেছেন তারা। কিভাবে তারা অন্যদের মানব সেবামুলক কাজে টেনে আনছেন আসুন জেনে নেই
২০১০ সালে বিল গেটস ও ওয়ারেন বাফেট যৌথভাবে বিশ্বের ৩৮ জন ধনকুবেরকে মানবকল্যাণে সম্পদ ব্যয় করতে অনুপ্রাণিত করেন। ফলে তাদের প্রত্যেকেই তাদের অর্জিত সম্পদের কমপক্ষে অর্ধেক মহৎ কাজে ব্যয় করার স্বেচ্ছা অঙ্গীকার করেন। পরে এই ধনকুবেরদের তালিকা আরো দীর্ঘ হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৬টি দেশের ১৪১ জন ধনকুবের এই তালিকায় নাম লিখিয়েছেন, যাদের সমন্বিত দানের পরিমাণ হবে ৮০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। তবে এ কথা সত্যি, বিশ্বের সব ধনীব্যক্তিই গেটস ও বাফেটের আহ্বানে সাড়া দেননি।
বর্তমান বিশ্বের তরুণ ধনকুবেরদের মধ্যে অন্যতম ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবাগ তিনি ও তার স্ত্রী তাদের ফেসবুক মালিকানার ৯৯ শতাংশ মানবকল্যাণে দান করার ঘোষণা দিয়েছেন। নগদ অর্থে যার পরিমাণ হবে চার হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। ৩১ বছর বয়সী প্রযুক্তিবিদ জাকারবার্গের সাথে এই ফাউন্ডেশনে আরো রয়েছেন কয়েকজন তরুণ ধনকুবের। তাদের মধ্যে অনলাইন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ন্যাপস্টারের শেন পার্কার, ই-বাইয়ের পিয়েরে ওমিডায়ার ও ফেসবুকের আরেক শেয়ার মালিক ডাস্টিন মোসকোভিজ উল্লেখযোগ্য।
ধনী ব্যক্তিদের মানব সেবামুলক কাজ নিয়ে কিন্তু আছে নানা বির্তক। অনেকে মনে করেন এজেন্ডা নির্ধারন করে এই মানব সেবায় হাত দেয়া হয়। যার মুল লক্ষ থাকে কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষা করা। সেবার নামে বিশ্বব্যবস্থা নিয়ন্ত্রনের কৌশলও কাজ করে থাকেভ আবার অনেক সমালোচক মনে করেন, এর মাধ্যমে গুটিকয়েক ধনকুবেরের হাতে বিশ্বব্যবস্থার নীতিনির্ধারণ ও সমাজব্যবস্থা পুনর্গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থাৎ অর্থের বিনিময়ে তারা হয়তো অনেক দেশ ও সমাজের নীতিনির্ধারণে নিজেদের প্রভাব খাটাবেন।
বিশ্বের শীর্ষ এই ধনী ব্যক্তি সমালোচকদের কথায় কর্ণপাত না করে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখছেন। বিশ্বখ্যাত রিটেইল কোম্পানি হোম ডিপোর প্রতিষ্ঠাতা বার্নার্ড মারকাস তার সম্পত্তির বড় একটি অংশ সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে দান করার ঘোষণা দিয়েছেন। সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন ‘এসব অর্থের পুরোটাই ব্যবহৃত হচ্ছে মানুষকে সাহায্য করার কাজে। অনেক সমালোচক ভাবে আমরা এ অর্থ ইয়ট কেনা কিংবা বাড়ি তৈরির কাজে ব্যবহার করছি?
নিজের কষ্টার্জিত সম্পদ মানুষের কল্যাণে দান করার ক্ষেত্রে এন্ড্রু কার্নেগি পথপ্রদর্শক হলেও তার এই মহৎ কাজ সর্বজনপ্রশংসিত হয়নি। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের কারখানাগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। শ্রমিকদের দিনে ১২ ঘণ্টা করে সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করতে হতো। এ ছাড়া বছরে মাত্র একটি ছুটির দিন ছিল। কাজের পরিবেশ এতই কঠোর ছিল যে, বেশির ভাগ শ্রমিককে ৪০ বছর বয়সে অবসরে যেতে হতো। সে অবস্থায় কার্নেগি যখন শ্রমিকদের পারিশ্রমিক না বাড়িয়ে তার মুনাফা তাদের মধ্যে দিতে চাইলেন, শ্রমিক নেতা ও পাদ্রিরা প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হলো।
ধর্মযাজকেরা শিল্পমালিকদের ‘ধর্মবিরোধী, সমাজবিরোধী ও রাজনৈতিক সুবিধাভোগী’ হিসেবে আখ্যা দেয়। তবে কার্নেগি এসব অভিযোগ বরাবরই নাকচ করে দিয়েছেন। তার মতে, উপার্জিত অর্থ দিয়ে তিনি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন সমাজহিতৈষী কাজে ব্যয় করতে চান, যা সরকার অগ্রাহ্য করছে। তার যুক্তির বিপরীতে ১৮৯২ সালের শ্রমিক ধর্মঘটের সময় শ্রমিকেরা বলত, দিনে বারো ঘণ্টা কাজ করা একজন লোক বই দিয়ে কী করবে?
বর্তমান সময়ের সম্পদশালী ব্যক্তিরা অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অনেক বেশি নিরপেক্ষতা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমান সময়ে গেটস অ্যান্ড মেলিন্ডা ফাউন্ডেশন ও অন্য ধনকুবেরদের সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের কাজে ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোকে। সেসব দেশে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তারা চেষ্টা করছেন সবার মধ্যে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্নকে ছড়িয়ে দিতে। এসব কাজে সমালোচনার অনেক দিক আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই ধনী ব্যক্তিরা বিপুল অর্থ ব্যয় করছেন।