জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার জন্য মুসলিম শাসনামলে গড়ে উঠেছিলো অসংখ্য লাইব্রেরি। বাগদাদ, দামেস্ক, কর্ডোভা আর মিশরে মুসলিম শাসকদের পৃষ্টপোষকতায় গড়ে তোলা হয়েছিলো বিশাল লাইব্রেরী। যেখানে বিভিন্ন ভাষায় দুস্প্রাপ্য বই গুলো অনুবাদ করা হতো। মুসলিম বিশ্বে সরকারি লাইব্রেরিগুলো বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল যেমন বায়তুল হিকমাহ, খিজানাত আল-হিকমাহ, বা দার আল-হিকমাহ, বা দার-আল-ইলম, দার আল-কুতুব, খিজানাত আল-কুতুব, বায়তুল-কুতুব, কুতুফানে। তুরস্কের অটোম্যান শাসকরা বাগদাদ, কায়রো, দামেস্ক, মক্কা, মদীনা এবং জেরুসালেম শাসন করেছিলো। এ সময় গড়ে উঠে নতুন মসজিদ, কলেজ এবং লাইব্রেরি। সেই গৌরবময় শাসনের স্মৃতি আবার ফিরে আসছে তুরস্কে। নির্মান করা হচ্ছে বড় দুটি লাইব্রেরী।
বিশালাকায় দুই লাইব্রেরির অধিকারী হতে যচ্ছে তুরস্ক। এর মধ্যে একটি হবে তুরস্কের সবচেয়ে বড় পাবলিক লাইব্রেরি। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরির তালিকায় স্থান পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া তুরস্কে নির্মিত হয়েছে অত্যাধুনিক আরেক লাইব্রেরি। এর অবস্থান তুর্কি নেতা রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের প্রেসিডেনশিয়াল কমপ্লেক্সের মধ্যে।
প্রেসিডেনশিয়াল এই লাইব্রেরিতে ৪০ লাখ ছাপা বই, ১২ কোটি ইলেকট্রনিক পাবলিকেশন্স থাকবে। ইলেকট্রনিক পাবলিকেশন্স এর মধ্যে ৫ লাখ ৫০ হাজার ই-বুকসহ বিরল অনেক সংগ্রহ থাকবে। লাইবে্িরর অভ্যন্তরীণ পরিসর ১ লাখ ২৫ হাজার বর্গমিটার। এক সাথে ৫ হাজার মানুষ এই লাইব্রেরীতে কাজ করতে পারবে। সব মিলিয়ে লাইব্রেরির পরিসর ৩ লাখ বর্গমিটার। এতে থাকবে দুষ্প্রাপ্য বই, ম্যানুস্ক্রিপ্ট, প্রাচীন ডিক্রি, দুষ্প্রাপ্য ম্যাপ, ফটো, শিশূদের জন্য থিয়েটার হল প্রভৃতি। লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে এতে মূল্যবান বই, ম্যানুস্ক্রিপ্ট দান করার হিড়িক পড়ে তুরস্ক জুড়ে। অনেক ইতিহাসবিদ, লেখক, গবেষক, প্রফেসর তাদের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ও সংগ্রহ দান করেছেন মূল্যবান এ লাইব্রেরিতে। প্রেসিডেন্ট এর দোয়ান উপহার দিয়েছেন হাতে লেখা একটি কুরআন শরীফ।
তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় প্রেসিডেনশিয়াল কমপ্লেক্সের তৃতীয় ভবনে নির্মান করা হয়েছে প্রেসিডেনশিয়াল লাইব্রেরি। প্রেসিডেন্ট প্রসাদ বা প্রেসিডেনশিয়াল কমপ্লেক্সকে ন্যাশন অব দি হাউজ ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান । এ লাইব্রেরি উপলক্ষে সাধারণ মানুষ অবাধে প্রবেশের সুযোগ পাবে এ প্রসাদ এলাকায়। তারা সুযোগ পাবে প্রাসাদ মসজিদে নামাজ আদায়ের।
অটোম্যান, সেলজুক এবং আধুনিক স্থাপত্যের সংমিশ্রনে নির্মিত এ লাইব্রেরি ভবনটি দৃষ্টি নন্দন। লাইব্রেরিটি উদ্বোধন করা হবে ২০ ফেব্রুয়ারি। এর নির্মান কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেন, এটি হবে ৫০ লাখ বইয়ের এক লাইব্রেরি। এটা ২৪ ঘন্টা খোলা থাকবে।
তার্কিশ লাইব্রেরিয়ানস এসোসিয়েশন এর প্রধান আলি ফুরাাত কারতাল বলেন, এটা এমন এক চমৎকার উদ্যোগ যেখানে অনন্য বৈশিষ্টর সাথে থাকছে সমৃদ্ধ সংগ্রহ। এখানে আছে গবেষক, শিশু এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা আলাদা বিভাগ ।
এখানে বসে গবেষকরা বিশ্বের অন্যান্য বড় বড় লাইব্রেরি সাথে যুক্ত হতে পারবে ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে। প্রেসিডেনশিয়াল কমপ্লেক্সের তৃতীয় ভবন এ উপলক্ষে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। ৪ হাজার প্রশিক্ষিত লাইব্রেরিয়ানকে নিয়োগ দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তুরস্কজুড়ে বর্তমানে ২৯ হাজার লাইব্রেরি রয়েছে। এর মধ্যে একটি জাতীয় লাইব্রেরিসহ ১ হাজার ১৩৭টি পাবলিক লাইব্রেরি এবং ৫০০টি বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি রয়েছে।
তুরস্কের অটোম্যান সা¤্রাজ্যের অধীনে ১৫ শতক থেকে ২০ শতক পর্যন্ত লাইব্রেরি কেন্দ্রিক সমৃদ্ধ এক ইতিহাস রয়েছে। বর্তমান তুর্কি নেতা এরদোয়ান উদ্যোগ নিয়েছেন তাদের অটোম্যান সা¤্রাজ্যের লাইব্রেরি সংস্কৃতির ধারা নতুন করে প্রতিষ্ঠা করার। এ্ই উদ্যেগের অংশ হিসাবে প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল এই লাইব্রেরী।
তুর্কি জাতি গৌরবময় ইতিহাসকে ধারন করে। লাইব্রেরীরর এই ধারনা তুরস্কের সাধারন মানুষের মধ্যে এক ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তুরস্কের খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ প্রফেসর ইলবার অরটিল তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি দান করেছেন প্রেসিডেনশিয়াল লাইব্রেরিতে। ইলবার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে এরদোয়ানের সাথে সাক্ষাত করে ব্যক্তিগত লাইব্রেরি দান করার কথা জানান। তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদুলুর আরেক খবরে বলা হয়েছে তুরস্কের সবচেয়ে বড় পাবলিক লাইব্রেরি খুব শীঘ্র উদ্বোধন করা হচ্ছে ইস্তাম্বুল শহরে। দেড় কোটি মানুষের শহর ইস্তাম্বুল। ১৭৭০ সালে নির্মিত ঐতিহাসিক রামি আর্টিলারি কোয়ারর্টাস ভবনকে পরিণত করা হবে পাবলিক লাইব্রেরিতে। তুরস্কের ইউরোপ প্রান্তে ইয়াপ জেলায় অবস্থিত এ ভবন। লাইব্রেরি রুপ দেয়া এ ভবনে মোট ৭০ লাখ বই থাকবে। ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির নির্বাচনী ইশতেহারে এ প্রকল্পের কথা উল্লেখ আছে। এরদোয়ান বলেন, আমরা আমাদের প্রজন্মকে বই পড়ার জন্য উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি।
কালচার অ্যান্ড টুরিজম এর আঞ্চলিক পরিচালক কসকুন ইলমাজ বলেন, এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো তুরস্কের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি এবং বই ভ্যালী নির্মান করা।
এ প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ হলে এটা বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরির তালিকায় স্থান পাবে। এতে থাকবে রিডিং রুম, প্রদর্শনী হল, ক্যাফে, সিনেমা এবং স্টোর। লাইব্রেরীর মাঝে খোলা জায়গা থাকবে যেখানে দর্শনার্থীরা এসে দীর্ঘ সময় বসতে পারবে। এতে শিশুদের জন্য আলাদা বিভাগ থাকবে। থাকবে সংগ্রহশালা এবং আর্ট ও শহরের ওপর বই থাকবে। থাকবে একটি যাদুঘর যেখানে কাগজের আবিষ্কার থেকে বই ছাপার ইতিহাস বর্ণিত থাকবে, জানান ইলমিজ। পার্কিং লটে থাকবে ১ হাজার ২৫০টি গাড়ী ধারণ ক্ষমতা। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার। এ বছরই এ লাইব্রেরি উদ্বোধন করা হবে।
তুরস্কের অটোম্যান সা¤্রাজ্যের অধীনে ১৫ শতক থেকে ২০ শতক পর্যন্ত লাইব্রেরি কেন্দ্রিক সমৃদ্ধ এক ইতিহাস রয়েছে। অটোম্যান সুলতান ও সুলতানাদের কর্তৃক এসব লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা, মূল্যবান বই সংগ্রহ এবং লাইব্রেরিতে লক্ষ লক্ষ বই দান করার ইতিহাস রয়েছে। তুরস্কের অটোম্যান বা ওসমানীয় সা¤্রাজ্যের অধীনে কয়েকশ বছর পর্যন্ত লাইব্রেরি কেন্দ্রিক জ্ঞান চর্চার ইতিহাস। রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় গড়ে উঠে এসব লাইব্রেরী। শুধু সুলতানরা যে পৃষ্টপোষক ছিলেন এমন নয়, তাদের স্ত্রী বা সুলতানারাও জ্ঞান চর্চায় অবদান রেখেছেন। এদের মধ্যে প্রথমেই রয়েছেন নুরবানু সুলতানার নাম। অটোম্যান সা¤্রাজ্যের অধীনে তিনি প্রথমে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার ধারা চালু করেন। তিনি সেলিম দ্বিতীয়ের স্ত্রী এবং অটোম্যান সা¤্রাজ্যের সবচেয়ে বিখ্যাত শাসক সুলতান সুলেমানের পুত্রবধু। যিনি সুলতান মুরাদ তৃতীয়ের মা।
নুরবানু সুলতানা তার প্রসাদের কাছে সামজিক ভবন, স্কুল, হাদীস শিক্ষা কেন্দ্র এবং শিক্ষাথীদের জন্য লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে তার পুত্র সুলতান মুরাদ তৃতীয় বিপুল পরিমান বই দান করেন। এ ছাড়া আরো অনেকের দানে বিপুল সংখ্যক বইয়ের সংগ্রহশালায় পরিণত হয় এ লাইব্রেরি। নুরবানু এ লাইব্রেরিতে নিয়োগ দেন লাইব্রেরিয়ান।
লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় আরেক সূরতানা হলেন হেতিস তুরহান সুলতানা। তিনি শাহজাদা মেহমেদ এর মা। ইয়েনি কামি বা বর্তমানে নতুন মসজিদ নামে পরিচিত মসজিটির নির্মান তার উদ্যেগে শেষ হয়। এ মসজিদে তিনি হাতে লেখা ৩০০ মূল্যবান বই দান করেন।
অটোম্যান সা¤্রাজ্যের বিপর্যয় পর্যায়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী কোসেম সুলতানেরও নাম রয়েছে তুরস্কে লাইব্রেরি সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। এ ছাড়া রয়েছে গুলনাস এমেতুল্লাহ ভালিদ সুলতান, উসকুদার এবং কিওস, পারতেভ নিহাল ভালিদ সুলতানের নাম। পারতেভ নিহাল ভালিদ সুলতান এক লাখ বই দান করেন তার প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরিতে।