নীল নদীর তীরে গড়ে ওঠা মিশরীয় সভ্যতার বয়স অন্তত ৭০০০ বছর। নীল নদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই সভ্যতা। তবে দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন আর জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে নীল নদের ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি হয়েছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে নীল নদের ২০০০ মাইল উজানে ৪৫০ কোটি ডলার ব্যয়ে আফ্রিকার বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে ইথিওপিয়া। ফলে নীল নদের ওপর মিশরের কয়েক হাজার বছরের একচ্ছত্র আধিপত্য হুমকির মুখে পড়েছে। মিশরের অস্তিত্ব রক্ষায় দেশটির ইতিহাসে একমাত্র গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি ওই বাধটি বোমা মেরে গুড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। নিউইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নীল নদকে ঘিরে সংঘাতের নানা দিক আমরা আজ তুলে ধরবো।
কয়েক বছর আগেও নীলনদের তীরের শস্য ক্ষেত ছিল গম ও আলুতে পরিপূর্ণ। এখন সেখানে মরুকরণ শুরু হয়েছে। বালুময় সেই ভূমি এখন পরিত্যক্ত আর বন্ধ্যা।নীল নদের পানিপ্রবাহ কমে আসায় সেচ সংকটকেই এর কারন। মিশরের জনসংখ্যা ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১০ কোটিতে পৌঁছেছে। দেশটির মানুষের সামনে নতুন দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে। ইথিওপিয়ার তৈরি প্রকা- জলবিদ্যুৎ বাঁধটি মিশরের পানি প্রবাহকে আরও সংকুচিত করবে।
গ্রীষ্ম থেকেই বাধটি পানিতে ভরার কথা রয়েছে। মিশরীয়রা শঙ্কিত। নীল নদ ছাড়া মিশর বাচবে না। ‘গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ ড্যাম’ নামের আফ্রিকার বৃহত্তম বাঁধটির জলাধারের আকার প্রায় লন্ডন শহরের সমান। এটি এখন মিশর ও ইথিওপিয়ার জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এটা নিয়ে গভীর শঙ্কা আছে দুই দেশেই, শোনা যায় রণহুঙ্কারও।
ইথিওপিয়ানদের কাছে বাঁধটি তাদের লালিত স্বপ্নের প্রতীক। প্রকল্পটির মাধ্যমে লাখো ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছাবে আর প্রতিবেশী দেশে বিদ্যুৎ রফতানি করে শত শত কোটি ডলার আয় করতে পারবে তারা। এর মাধ্যমে আফ্রিকার উদীয়মান শক্তি হিসেবে তার আসনটি আরও পাকাপোক্ত হবে।
কয়েক বছর ধরে বাঁধের কাজ চললেও নানা বাধায় কাজের গতি বিঘিœত হয়। দুর্নীতি, স্ক্যান্ডাল এবং প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলীর রহস্যজনক মৃত্যু ছিল এ প্রকল্পের অনুসঙ্গ। অবশেষে দুটি টারবাইন স্থাপন করা হয়েছে। জুলাই থেকে বাঁধটি ভরা শুরু হবে বলে কর্মকর্তারা জানান। প্রকল্পটি ইথিওপিয়ায় সম্ভাবনার দ্বার খুললেও মিশরে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। তাদের কাছে বাঁধটি সবচেয়ে মৌলিক হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মিশরের স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে ভাষণে বলেছেন, নীল নদ মিশরের জীবনের প্রশ্ন, অস্তিত্বের অনুসঙ্গ।
গত আট বছর ধরে মিশর, ইথিওপিয়া ও সুদানের কর্মকর্তারা বাধটি নিয়ে ব্যর্থ আলোচনা চালিয়েছেন। ৯৫ ভাগ মিশরীয়ই নীল নদের পাশে এব জনসংখ্যায় ঠাসা বদ্বীপে বাস করেন। নীল নদই তাদের সব পানি সরবরাহ করে। তারা আশঙ্কা করছেন যে বাধটি খুব দ্রুত ভরা হলে পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে হ্রাস পেতে পারে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে আলোচনা গড়ায় ওয়াশিংটনে। হোয়াইট হাউস এতে মধ্যস্ততা করছে। চুক্তি সম্পাদনকারী হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি উপস্থাপনকারী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তার এই প্রচেষ্টা তাকে নোবেল পুরস্কার এনে দিতে পারে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে হোয়াইট হাউস। তবে মিশরীয় ও ইথিওপিয়ান কর্মকর্তারা বলছেন বিষয়টি এতো সহজ নয়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এক সাক্ষাৎকারে ইথিওপিয়ার পানি সম্পদমন্ত্রী সেলেশি বেকেলে বলেছেন, নীল নদের ওপর মিশরের দাবি ‘আপনার শোনা সবচেয়ে অসার কথা’।
হাজার হাজার বছর ধরে মিশরীয়রাই ছিল নীল নদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নিয়ন্ত্রা। একে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে প্রাচীন সা¤্রাজ্য আর আধুনিক প্রজাতন্ত্র। ফারাওরা কুমিরের পূজা করতো। নীল নদ দিয়েই পরিবহন করা হতো বিখ্যাত গিজা পিরামিড তৈরির গ্রানাইট ব্লক । মিশরের স্বাধীনতা-উত্তর সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা গামাল আবদেল নাসের নীল নদের মৌসুমী প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৭০ সালে আসওয়ান হাই ড্যাম নির্মাণ করে দেশটির কৃষিতে রূপান্তর ঘটনা।
প্রাক ঔপনিবেশিক চুক্তি ও ১৯৫৯ সালে সুদানের সঙ্গে সমঝোতার ওপর ভিত্তি করে মিশর নীল নদের ওপর তার আধিপত্যকে ন্যায়সঙ্গত মনে করে থাকে। তবে ইথিওপিয়া এসব চুক্তি মানে না। দেশটির সাবেক নেতা মেঙ্গিসটু হেইল মরিয়াম ১৯৭৮ সালে নীল নদের ওপর কয়েকটি বাধ নির্মাণের প্রস্তাব দিলে তাকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দেওয়া হয়। মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বলেন, ‘মিশরে তৃষ্ণার্ত হয়ে মরার জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকব না। আমরা ইথিওপিয়ায় গিয়েই মরব , সেখানে গিয়ে যুদ্ধ করব। ’
আফ্রিকায় চার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে মিশরের উত্তর উপকূলের সমুদ্রতীরবর্তী শহর রাস আল বার হয়ে ভূমধ্যসাগরে মিলিত হয়েছে নীল নদ। নীল নদের শাখানদী ব্লু নাইলজুড়ে অবস্থান রেনেসাঁ ড্যামের। এই শাখা নদীটি থেকেই আসে মিশরের বেশিরভাগ পানি। ইথিওপিয়ার তরুণ নেতা আবি আহমেদ দাবি করেছেন বাধটির প্রভাব নিয়ে মিশরের আশঙ্কা অতিরঞ্জিত।
২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিয়ে তিনি কায়রো গিয়ে মিশরীয়দের আশ্বস্ত করেন। তখন সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘ আমি শপথ করে বলছি, আমি শপথ করে বলছি আমরা মিশরের পানি প্রবাহের ক্ষতি করব না।’ তবে গত শরতে প্রেসিডেন্ট আবি হুশিয়ারি দিয়ে বলেন, কোনো শক্তিই বাধ নির্মাণ ঠেকাতে পারবে না। তিনি একথাও বলেন যে প্রয়োজনে মিশরের সঙ্গে যুদ্ধে লাখো লোক প্রস্তুত করবেন তিনি। এর দুই সপ্তাহ পরই ইরিত্রিয়ার সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার জন্য তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীল নদের জন্য আসন্ন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তন। প্রতি ৬ মাসে মিশরের জনসংখ্যা ১০ লাখ করে বৃদ্ধি পায়। জাতিসংঘ বলছে, এই হারে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে ২০২৫ সালে দেশটিতে পানিসংকট দেখা দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ কলেজের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, উজানে নীল নদের অববাহিকায় আগামী শতাব্দীতে বৃষ্টিপাত বাড়তে পারে। তবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বছরের গ্রীষ্ম ও শুষ্ক সময়টাও প্রলম্বিত হবে। শুষ্ক বছরগুলো হবে খুবই ভয়াবহ এবং ঘনঘন গরম পড়বে। ফলে নীল নদের ওপর নির্ভরশীল কৃষকদের জীবন আরও কঠিন হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় মিশরে পানির অপচয় রোধে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। খুতবায় পানি সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরা হচ্ছে। মিশরের সরকারগুলো ধারাবাহিক ভাবে যেসব অতিকায় প্রকল্প নিয়েছেন তাতে নীল নদের পানির ব্যবহার আরও বেড়েছে। প্রেসিডেন্ট সিসি কায়রোর বাইরে যে প্রশাসনিক রাজধানী বানাচ্ছেন তাতে এ নদের পানি আরও নিঃশেষিত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন। মিশরীয়রা আশঙ্কা করছেন, রেনেসাঁ বাঁধটি দ্রুত ভরা হলে তাদের দেশে খরা দিতে পারে। ইথিওপিয়া বলছে, তারা বাঁধ ভরতে চার বছর সময় নেবে। মিশরের আশঙ্কা এতে সেখানে ১২ মাস বা তারও বেশি সময় খরা দেখা দিতে পারে। মিশরের সামরিক লৌহমানব সিসি কোনো পরামর্শ শুনতে নারাজ। সমালোচনা রয়েছে যে তিনি মিশরের এই সংকটে খুবই নমনীয় ভূমিকা রাখছেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী আবি এবার ফের নির্বাচন করবেন। প্রকল্পটি শেষ করার জন্য তার ওপর সাধারণ মানুষের প্রচ- চাপ আছে।
উদীয়মান শক্তি ইথিওপিয়া আফ্রিকার সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির দেশ। বাঁধটি শেষ হলে আফ্রিকার বৃহত্তম বলছে বিদ্যুৎ রফতানিকারক দেশে পরিণত হবে ইথিওপিয়া। মিশরের মতোই এদেশটির কেন্দ্রবিন্দুতেও রয়েছে নীল নদ। সেখানে স্কুল শিক্ষার্থীদের নীল নদের প্রশংসাসূচক গান শেখানো হয়। নানা বাধাবিপত্তি সামলেই প্রকল্পটি এখন শেষের পথে। এখন মিশরের মানুষের সবচেয়ে বড় দু:শ্চিন্তার কারন এখন এই বাধ।
২০১১ সালে মিশর যখন আরব বসন্তের ধাক্কায় প্রকম্পিত, সেই সুযোগে প্রকল্পটি শুরু হয়। ২০১৩ সালে টেলিভিশনে প্রচারিত এক ফুটেজে দেখা যায়, প্রকল্পটি ভ-ুল করে দিতে গোপন অভিযান নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে বোমা হামলার পরিকল্পনাও ছিল। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মুরসিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এরপর ইথিওপিয়া মিশরের সঙ্গে বাধ নিয়ে আলোচনার গতি কমিয়ে দেয়। ইথিওপিয়ার অভিযোগ, মিশর বরাবরই তাদের প্রতি রূঢ়। উদাহরণ হিসেবে আঠারশ’ সালের সত্তরের দশকে ইথিওপিয়ায় মিশরের ব্যর্থ আগ্রাসনের কথাও বলে থাকেন তারা।
প্রেসিডেন্ট সিসি এ সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চান। তিনি ইথিওপিয়ার প্রতিবেশীদের সঙ্গে কূটনৈতিক বোঝাপড়া বাড়িয়েছেন। অন্যভাবেও প্রকল্পটি ঠেকাতে চায় মিশর। ইথিওপিয়ার বৈরি দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছে মিশর। ইথিওপিয়া অভিযোগ করছে, দেশটিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ও সশস্ত্র বিদ্রোহে মদত দিচ্ছে মিশর। কায়রো এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।তবে সিসি যে বড় সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন তা হচ্ছে বাঁধ নিয়ে আলোচনা যত দীর্ঘ হবে প্রকল্পটিও ততই শেষের দিকে চলে আসবে।
প্রধানমন্ত্রী আবির হাতকে শক্তিশালী করছে ইথিওপিয়ার ক্রমবর্ধমান ভূকৌশলগত শক্তিমত্তা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হর্ন অফ আফ্রিকায় প্রভাব বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র।
অনেক বিশ্লেষক একে বলছেন ‘গ্রেট গেম’ বা বিশাল খেলা। এসব হিসাবনিকাশের মূলে রয়েছে এ অঞ্চলের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ১০ কোটি মানুষের ইথিওপিয়া। যেমন বাঁধ নিয়ে আলোচনায় ইথিওপিয়া মিশরের ঐতিহ্যবাহী মিত্র সুদানের সমর্থন লাভে সক্ষম হয়েছে।হোয়াইট হাউস ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্ততায় আলোচনা চললেও মিশরের প্রত্যাশামত অগ্রগতি হয়নি। ফলে নীল নদের ওপর মিশরের মূল দাবিই ছাড়তে হয়েছে কায়রোকে। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট আবি গর্ভ করে টুইটারে বলেছেন, তাদের বিজয় সন্নিকটে।