উত্তর কোরিয়া প্রায়ই হুমকি দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বোমা হামলা চালিয়ে সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস করে দেয়ার। এ হুমকি হালকা করে দেখার উপায় নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেকের পক্ষে। কারন দেশটি পারমানবকি বোমার অধিকারী। দেশটির কাছে রয়েছে পারমানবিক বোমা বহনে সক্ষম ব্যালেস্টিক মিসাইল। এ মিসাইল দিয়ে সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র আঘাত পরিচালনা করতে সক্ষম।
উত্তর কোরিয়া যখন খুশী একের পর এক চালিয়ে যাচ্ছে মিসাইল আর পরমানু বোমার পরীক্ষা। ফলে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশলীতাসহ গোটা বিশ্বের প্রতি উত্তর কোরিয়াকে বড় ধরনের হুমকি মনে করেন অনেকে। ২০১৭ সালের ভয়াবহ ক্ষমতার এক পারমানবিক বোমার পরীক্ষা চালানোরর পর গোটা বিশ্ব নজর দিতে বাধ্য হয় উত্তর কোরিয়ার প্রতি। একের পর এক শক্তিশালী মিসাইল ও পরমানু বোমার পরীক্ষা আর হুমকির কারনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হয়েছে উত্তর কোরিয়ার সাথে বৈঠকে বসতে। দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে ২০১৯ সালে উত্তর কোরিয়া নেতা কিম জং উনের সাথে বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
২০১৭ সালের ১৭ নভেম্বর কিম পরমানু বোমার পরীক্ষা বন্ধ করেন উত্তর কোরিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করনের চেষ্টার অংশ হিসেবে। ২০১৮ সালের জুনে সিঙ্গপুরে কিম জং উনের সাথে বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ বৈঠক নিয়ে বিশ্বব্যাপী আশাবাদ তৈরি হলেও ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভিয়েতনামের হ্যানয় বৈঠকে তা আকস্মিকভাবে শেষ হয়ে যায়। কারণ উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার ও পরমানু বিস্তার রোধ বিষয়ে দুই নেতা সমঝোতায় পৌছতে ব্যর্থ হয় । ২০১৯ সালের মে মাস থেকেই আবার অস্ত্র পরীক্ষা শূরু করে উত্তর কোরিয়া। এবার দেশটি সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপ করে ব্যালিস্টক মিসাইল। এরপর থেকে বন্ধ রয়েছে আলোচনা ও এ সংক্রান্ত অগ্রগতি।
স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী এবং স্ট্রাটেজিক রকেট ফোর্স আর স্পেশাল অপেরশেন ফোর্স নিয়ে উত্তর কোরিয়ার সশস্ত্র বাহিনী গঠিত। দক্ষিন কোরিয়া আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রধান শত্রু দেশ মনে করে। স্ট্রাটেজিক রকেট ফোর্স, মিসাইল গাইডেন্স ব্যুরো নামে পরিচিত। পারমানবিক আর কৌশলগত প্রচলিত মিসাইল নিয়ে কাজ করে এ বাহিনী। ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য মিসাইল দ্বারা সজ্জিত এ বাহীনি। অপর দিকে স্পেশাল অপারেশন ফোর্স হলো এলিট ফোর্স। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার এর তথ্য অনুযায়ী দেশটির মোট জনসংখ্যা ২ কোট ৫৩ লাখ। মোট সেনা সংখ্যা ১৮ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে সক্রিয় ১২ লাখ ৮০ হাজার। রিজার্ভ ৬ লাখ।
উত্তর কোরিয়ার প্যারামিলিটারি বা আধা সামরিক সৈন্য সংখ্যা ৫৮ লাখ ৫৯ হাজার। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্যারামিলিটারি রয়েছে উত্তর কোরিয়ায়। মোট জনসংখ্যার ২৫ ভাগই প্যারামিলিটারি। উত্তর কোরিয়ার পারামিলিটারি বাহিনীর নাম ওয়ার্কার-পিজেন্ট রেড গার্ড।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র এ দেশটি তার জিডিপির চার ভাগের এক ভাগ ব্যয় করে সামরিক খাতে।
উত্তর কোরিয়র সশস্ত্র বাহিনীকে যে কারনে শক্তিশালী আর ভয়ানক মনে করা হয় তার অন্যতম একটি কারন হলো তাদের ভয়ানক অনেক সমরাস্ত্র মূলত নিজস্ব উদ্ভাবিত। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের দুই পারে অবস্থিত উত্তর কোরিয়া আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দুই দেশের দূরত্ব ১০ হাজার ৩৬৭ কিলোমিটার বা ৬ হাজার ৪৪২ মাইল। আর উত্তর কোরিয়া উদ্ভাবন করেছে এমন এক মিসাইল যা দিয়ে সে আঘাত করতে সক্ষম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডে। উত্তর কোরিয়ার একের পর এক শক্তিশালী মিসাইল উদ্ভাবন আর সফল পরীক্ষা বিষয়েও অনেকে বিস্মিত। অনেকের মতে এতে হাত থাকতে পারে রাশিয়া ও চীনের।
সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী হওয়ার পেছনে উত্তর কোরিয়াকে যে বিষয়টি প্রেরণা যোগায় তা হলো আত্মনির্ভরশীল হওয়া এবং মিলিটারি- ফার্স্ট পলিটিক্স। উত্তর কোরিয়ার বিমানবাহিনীতে মোট বিমান ও হেলিকপ্টারের সংখ্যা ৯৪৯টি। এর মধ্যে যুদ্ধ বিমান ৪৫৮টি। হেলিকপ্টার ২০৪টি। প্রশিক্ষন বিমান ১৬৯টি। নৌ বাহিনীতে মোট রণতরীর সংখ্যা ৯৮৪টি। সাবমেরিন ৮৩টি। ফ্রিগেট ১১টি। টহল রণতরী ৪১৬টি। তাদের কোনো বিমানবাহী রণতরী ও ডেস্ট্রয়ার নেই। স্থলবাহিনীতে উত্তর কোরিয়ার ট্যাঙ্ক ৬ হাজার ৪৫টি। সাজোয়া যান ১০ হাজার। রকেট প্রজেক্টর ২ হাজার ১১০টি। এছাড়া দেশটির হাতে রয়েছে অনেক হেভি আর্টিলারি গানস, এন্টি এয়ারক্রাফট গানস।
পারমানবিক বোমার অধিকারী উত্তর কোরিয়া। ধারনা করা হয় দেশটিতে ২০ থেকে ৩০টি পারমানবিক বোমা রয়েছে । এ ছাড়া আরো ৬০টির মত পারমানবিক বোমা বানানোর মত উপাদান মজুদ রয়েছে দেশটিতে। তবে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার মতে উত্তর কোরিয়ার হাতে বর্তমানে ৩০ থেকে ৬০টি পারমানবিক বোমা মজুদ আছে। ২০১৭ সালের ৩ সেপ্টম্বর শেষ যে পারমানবিক বোমার পরীক্ষা উত্তর কোরিয়া চালিয়েছে তা ১০০ থেকে ৩৫০ কিলোটন মনে করা হচ্ছে। ১০০ কিলোটনের একটি বোমা হিরোশিয়া ফেলা বোমার চেয়ে ৬ গুন বেশি শক্তিশালী। উত্তর কোরিয়ার দাবি এটি তাদের প্রথম থার্মোনিউক্লিয়ার বা হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা। বোমা পরীক্ষার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে ৬ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করে পরীক্ষা স্থলের কাছে। উত্তর কোরিয়া আরো জানায় এ বোমা তারা ব্যালিস্টিক মিসাইলে বসিয়েছে।
ব্যালিস্টিক মিসাইলের অধিকারী উত্তর কোরিয়া। এর নাম হসং ১৫। ৮ হাজার ১০০ মাইল দূরে লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত করতে পারে এ মিসাইল। মার্র্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র যাতে আঘাত করা যায় সে লক্ষ্যে নির্ধারণ করা হয়েছে এর আওতা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সও এ মিসাইলের আওতায়। এ মিসাইল পরমানু বোমা বহনে সক্ষম। উত্তর কোরিয়া তৈরি করেছে এ মিসাইল।
উত্তর কোরিয়া মোট ৪০টি হসং ১৫ আন্তমহাদেশীয় মিসাইল তৈরি করেছে। এটি ১৫০ কেজি ওজনের বোমা বহনে সক্ষম।
উত্তর কোরিয়া খুবই শক্তিশালী পরমানু বোমার অধিকারী হলেও তা তাদের ব্যালিস্টিক মিসাইল হসং ১৫ বহন করতে পারে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা মূল্যায়ন হলো স্বল্প ক্ষমতার অধিকারী পারমানবিক বোমা বহন করতে পারে এ মিসাইল। তবে অনেকের মতে এটি অতিক্রম করা উত্তর কোরিয়ার জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বিপুল সংখ্যক সাবমেরিনের অধিকারী উত্তর কোরিয়া। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার এর তথ্য অনুযায়ী এ সংখ্যা ৮৮টি। উত্তর কোরিয়ার সাবমেরিনে রয়েছে ব্যালিস্টিক মিসাইল নিক্ষেপের ক্ষমতা। রয়েছে সিনপো ক্লাস ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিন। এ সাবমেরিন পারমানবিক বোম বহনকারী মিসাইল ছুড়তে পারে। তাদের সবচেয়ে ছোট সাবমেরিনেও রয়েছে টরপেডা নিক্ষেপ ক্ষমতা।২০১৬ সালে উত্তর কোরিয়া সাবমেরিন থেকে প্রথম শক্তিশালী মিসাইললের সফল পরীক্ষা চালায় যা চিন্তায় ফেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে।
উত্তর কোরিয়ার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন এমন একটি মিসাইল উদ্ভাবন যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো প্রান্তে আঘাত করতে পারে। আর তা হবে কে এন-৮ মিসাইলের মাধ্যমে। উত্তর কোরিয়ার কেএন-০৮ মিসাইল উদ্ভাবন মিসাইল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং চীনের সম পর্যায়ে উন্নীত করেছে। এর সর্বোচ্চ লক্ষ্যমাত্রা ১০ হাজার কিলোমিটার বলে মনে করা হচ্ছে। এ বছর এটি মোতায়েন করার কথা রয়েছে। হসং উত্তর কোরিয়ার প্রথম মিসাইল যা ১০ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত লক্ষ্যে আঘাত আনতে পারে । ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহর প্রথম বারের মত উত্তর কোরিয়ার আঘাতের আওতায় আসে এ মিসাইল উদ্ভাবনের মাধ্যমে।
উত্তর কোরিয়ার কে এন -৬ মিসাইল ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপ যোগ্য মিসাইল। উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এটি। উত্তর কোরিয়া উদ্ভাবিত এ মিসাইল দেখতে রাশিযার এস-৩০০ এর মিসাইলের মত। মাঝারি পাল্লার এ ব্যলিস্টিক মিসাইল উত্তর কোরিয়ার আরেকটি শক্তিশালী মিসাইল। এ মিসাইলের কারনে কোনো বাধা ছাড়াই পুরো দক্ষিন কোরিয়া উত্তর কোরিয়ার আঘাতের আওতায় রয়েছে। পাকিস্তানের ঘুরি-১ এবং ইরানের সিহাব-৩ এ মিসাইলের অনুকরনে বলে মনে করা হচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার কাছে ৩০০ এর অধিক এ মিসাইল থাকার কথা বলা হচ্ছে। এ মিসাইলের কারনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিন কোরিয়ায় থাড মিসাইল সিস্টেম মোতায়েন করতে বাধ্য হয়েছে। প্রতিবেশী যে কোনো রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ হুমকি উত্তর কোরিয়ার এ মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম। একে রাশিয়ার এমএলআরএস এর সাথে তুলনা করা হয়।
উত্তর কোরিয়ার প্রাথমিক আকাশ সুরক্ষার জন্য রয়েছে রাশিয়ার তৈরি ফোর্থ জেনারেশন ১৭টি মিগ-২৯। এর সমর্থনে রয়েছে ২০০ মিগ ১১ ফাইটার জেট। আকাশ যুদ্ধে মিগ-২৯ এখনো বেশ শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান হিসেবে বিবেচিত।
উত্তর কোরিয়ার হাতে আছে ননগো ক্লাস মিসাইল বোট এর গতি ঘন্টায় ৯২ কিলোমিটার। ফলে সাবমেরিন থেকে একে টার্গেট করা কঠিন। এটি ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য এবং মোবাইল। স্থল অভিযান প্রতিরোধে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমরাস্ত্র উত্তর কোরিয়ার। কারন স্বল্প পাল্লার এ ক্ষেপনাস্ত্রের রয়েছে বহুমাত্রিক আওতা। এসএ ১৩ রাশিয়ান মিসাইল। আর উত্তর কোরিয়ার মোডিফাইড এ মিসাইল আরো ছোট এবং আধুনিক। এতে রয়েছে এন্টি এয়ারক্রাফট গান যা ইউরোপে পুরনো হলেও এশিয়ায় এখনো এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ । উত্তর কোরিয়ার রয়েছে ১০ হাজার এন্টি এয়ারক্রাফট গান।
উত্তর কোরিয়া হাতে বিপুল পরিমান রাসায়নিক ও জীবান অস্ত্রের মজুদ রয়েছে মর্মে বিভিন্ন খবরে বলা হয়েছে। সালফার মাস্টার্ড, ক্লোরাইন, ফজেন, সারিন, ভিএক্স নার্ভ এজেন্টসহ যেসব রাসায়নিক অস্ত্র রয়েছে তা শেল, রেকট, বিমান ও মাসাইলের মাধ্যমে নিক্ষেপ করা যায়।