রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন। তাকে মনে করা হয় বিশ্বের প্রবল ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের একজন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়াকে আবার বিশ্বের প্রভাবশালী দেশে পরিনত করেছেন পুতিন। নিজ দেশে লৌহমানব হিসেবে পরিচিত হলেও অনেকে মনে করেন তিনি একজন নিকৃষ্ট স্বৈরাচার। পুতিন আবারো ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার আয়োজন করছেন। যার লক্ষ্য ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা।
২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকার সম্ভাবনা আরো জোরালো হয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। ২০২৪ সালের নির্বাচনে পুতিনের অংশগ্রহনের অনুমোদনের জন্য রুশ সংসদের নিম্নকক্ষে সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রস্তাব আনা হয়েছে। প্রস্তাব পাস হলেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় থাকার নতুন রেকর্ড গড়ার দিকে এগিয়ে যাবেন তিনি। আর প্রস্তাবটি পাস না হওয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনো বাধা নেই বলে মনে করা হচ্ছে। সংবিধানের বর্তমান ধারা অনুযায়ী ২০২৪ সালে টানা দ্বিতীয় ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে চতুর্থ মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ক্ষমতা ছাড়তে হবে কেজিবির সাবেক কর্মকর্তা পুতিনকে। কিন্তু পুতিনের সমর্থনে সংবিধান সংশোধনীর ফলে তার প্রেসিডেন্সিয়াল মেয়াদের সময়সীমা আনুষ্ঠানিকভাবে পুনরায় শূন্য থেকে শুরু হবে।
রুশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ডুমায় অন্যান্য সাংবিধানিক সংশোধনীর পাশাপাশি এ পরিবর্তনের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে। তৃতীয় ও চূড়ান্ত ভোটাভুটিতে প্রস্তাবের পক্ষে ৩৮৩ ভোট পড়েছে। প্রস্তাবের বিপক্ষে কোনো ভোট না পড়লেও ভোট দান থেকে বিরত থেকেছেন ৪৩ আইনপ্রনেতা।
সংশোধনীটি সাংবিধানিক আদালতের ও এপ্রিলে দেশব্যাপী ভোটে সমর্থন পেলে ২০২৪ সালে আরো প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন পুতিন। ফলে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত পরপর ছয় বছরের দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সম্ভাবনা তৈরি হবে পুতিনের। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তিনি যদি মেয়াদ শেষে আরো দুই বারের জন্য ক্ষমতায় থাকতে পারেন তা হবে একটি বিশ্ব রেকর্ড। এমনটা ঘটলে সে সময় পুতিনের বয়স দাঁড়াবে ৮৩ বছর এবং টানা ৩৬ বছর বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশটির ক্ষমতায় থাকবেন তিনি। সংশোধনীটি উভয় কক্ষে সমর্থন পাবে বলেই মনে করছেন পুতিনের সমালোচকরা।
দুই দশক ধরে কখনো প্রেসিডেন্ট আবার কখনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাশিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে আধিপত্য বহাল রেখেছেন ৬৭ বছর বয়সী পুতিন। ২০২৪ সালের পর নিজের পরিকল্পনা নিয়ে এখনও স্পষ্টভাবে কিছু জানাননি পুতিন। এর আগে তিনি বলেছিলেন সোভিয়েত যুগের মতো মৃত্যু পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার চর্চারও বিপক্ষে । কিন্তু সংসদে সংশোধনীর পক্ষে সমর্থন জানানোর সময় পুতিন জানান, রাশিয়ার সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য তার আবারো নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে বলে মনে করেন । তবে রাজনৈতিকভাবে দেশ শক্তিশালী হয়ে উঠলে নিজের মেয়াদ কমিয়ে নেবেন বলে দাবি করেছেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে রুশ রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ও সংবিধান সংস্কার আনেন পুতিন। পার্লামেন্টের বার্ষিক ভাষণে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদের ব্যক্তি নির্বাচনে পার্লামেন্টকে ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। প্রেসিডেন্টের থেকে প্রধানমন্ত্রীকে বেশি ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে প্রয়োজনে দেশব্যাপী গণভোটও চান পুতিন। প্রেসিডেন্টর ওই প্রস্তাবের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ পদত্যাগের কথা জানান। এরপর তিনি এক সাবেক আমলা মিখাইল মিশুস্তিনিকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেন।
পুতিনকে ক্ষমতায় রাখার এ তোড়জোড়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। যদিও রাশিয়াতে বিরোধী দলের তেমন কোনো তৎপরতা চালানোর সুযোগ নেই। ক্রেমলিনের সমালোচক ও বিরোধী রাজনীতিবিদ অ্যালেক্সেই নাভালনির ধারণা, পুতিন এখন আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার জন্য চেষ্টা করছেন।
পুতিন যেমন আর্ন্তজাতিক রাজনীতির একজন পাকা খেলোয়াড় তেমনি আভ্যন্তরিন রাজনীতিতে তার অবস্থান সুদৃঢ়। সময় নিয়ে ধীরে ধীরে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে চলে এসেছেন। বিরোধী মতের লোকও স্বীকার করেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়াকে তিনি আর্ন্তজাতিক রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে হাজির করেছেন।
১৯৫২ সালের ৭ অক্টোবর এক শ্রমিক পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন ভøাদিমির পুতিন। বাল্যকাল থেকেই খেলাধুলা করতে ও গুপ্তচরদের নিয়ে সিনেমা দেখতে ভালোবাসতেন। রুশ প্রজাতন্ত্র বা রাশিয়ার অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তিনি। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পুতিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে রুশ প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিন আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করার প্রেক্ষাপটেই তার এই দায়িত্বভার গ্রহণ।
২০০০ সালের ২৬ মার্চ তিনি রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালের ১৫ মার্চ তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতাজনিত কারণে পুতিন ধারাবাহিকভাবে তৃতীয় মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। পরে ২০০৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তার উত্তরসূরি হিসেবে দিমিত্রি মেদভেদেভ জয়লাভ করেন। এতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেয়ার মাত্র দুই ঘণ্টার মাথায় মেদভেদেভ রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভøাদিমির পুতিনকে মনোনীত করেন। ২০০৮ সালের ৮ মে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দাফতরিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন পুতিন। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে পুতিন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন যে, তিনি তৃতীয় মেয়াদের জন্য নতুন করে ২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি তৃতীয় মেয়াদে জয়লাভ করেন। তার এ মেয়াদকাল ছয় বছর।
ভøাদিমির পুতির লেখাপড়া করেছেন আইন বিষয়ে। চাকরি করেছেন গোয়েন্দা সংস্থায়। তিনি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির একজন কর্মকর্তা ছিলেন। ভøাদিমির পুতিন ১৯৭৫ সালে লেনিনগ্রাদ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের আর্ন্তজাতিক শাখা থেকে উত্তীর্ণ হন। তাকে সেই সময়ের নিয়ম মেনে দেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিভাগে কাজ করতে পাঠানো হয়।
পুতিনের মা-বাবা মারা গেছেন। স্ত্রীর সাথে তার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। বিচ্ছেদের সময় তার স্ত্রী লুদমিলা বলেন ‘আমাদের বিচ্ছেদ হচ্ছে। কারণ আমরা প্রায় কখনোই কেউ কাউকে বুঝিনি।’ তার দুই মেয়ে থাকলেও তারা রাশিয়ায় থাকেন না। ফলে তার ব্যক্তিগত জীবন সীমিত। গুজব রয়েছে তার কাছে প্রতি রাতে নারী মডেল, ফটোগ্রাফার ও জিনন্যাস্টরা আসেন। কিন্তু এর বাস্তব ভিত্তি পাওয়া যায়নি। বাস্তবে একটি কালো ল্যাব্রাডার কুকুরই পুতিনের সঙ্গী। পুতিনের জীবন সাধারণ। কিন্তু তিনি নিজেকে একজন কঠোর পরিশ্রমী ব্যক্তি বলেই দাবি করেন।
রাশিয়ায় স্ট্যালিনের পর নিজেকে তিনি সবচেয়ে পরিশ্রমী নেতা বলে দাবি করেন। রুশভাষী হিসেবে ভøাদিমির পুতিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে জার্মান ভাষায়ও কথা বলতে পারেন। বাড়িতে তিনি ও তার পরিবার জার্মান ভাষায় কথা বলেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর জানা যায়, তিনি ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ করছেন। অবসর পেলেই বই পড়েন পুতিন। তবে গোয়েন্দা কাহিনী পড়তে বেশি পছন্দ করেন। এ সম্পর্কে পুতিনের বিখ্যাত একটি উক্তিও আছে ‘আমাকে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত ও মুগ্ধ করে ওই বিষয়টি, যখন কোনো একটি কাজ পুরো সেনাবাহিনী মিলে করতে পারে না, অথচ সেই কাজই করে ফেলে গুটি কয়েকজন ব্যক্তি।’ পুতিন ইন্টারনেট পছন্দ করেন না আর তার অফিসে টেলিভিশনও নেই। যোগাযোগের ক্ষেত্রে তিনি খুবই নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। এর অন্যতম হলো কাগজ ও সোভিয়েত যুগের ল্যান্ড টেলিফোন লাইন। তিনি খুব কমই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। বিদেশ ভ্রমণের সময় নিরাপত্তার খাতিরে তার সাথে থাকে রাশিয়ান বাবুর্চি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ওয়েটার। হোটেলে থাকার সময় তার সাথে থাকা লোকজন হোটেলের সব কাগজ ও প্রসাধনী দ্রব্য সরিয়ে ফেলে সেখানে ক্রেমলিনের অনুমোদিত সামগ্রী রেখে দেয়। আর ক্রেমলিনের অনুমোদন ছাড়া তিনি কোনো বিদেশী খাবার খান না। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ভাষায় পুতিন পাতলা চামড়ার শক্ত নেতা। যিনি দেশে বিদেশে লৌহ মানব হিসাবে পরিচিতি পাচ্ছেন।