আক্রান্ত গোটা বিশ্ব। ব্যাপক অর্থে এমনটা বলা হলেও প্রাণঘাতি ভাইরাসের আক্রমণের বইরে রয়ে গেছে এখনো অনেক দেশ। আর এসব দেশের অধিকাংশ গরিব অথবা যুদ্ধবিধ্বস্ত। নয়তো বিশ্ব থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন। প্রশ্ন হচ্ছে আসলে এসব দেশের প্রকৃত অবস্থা কী? নাকি তথ্য লুকাচ্ছে। বিচ্ছিন্ন দেশের উদাহরণ হিসেবে টেনে আনা যায় উত্তর কোরিয়ার নাম। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যাদের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। এমন আরো একটি দেশ মিয়ানমার। বাংলাদেশের পাশের দেশ, তবুও বাংলাদেশিদের কাছে রহস্য। কেবল বাংলাদেশিদের নয়, মিয়ানমার গোটা বিশ্বের জন্যই রহস্য। এর মধ্যে জন্ম দিয়েছে নতুন আরেক রহস্যের- দেশটি কী করে ঠেকিয়ে রাখছে ভাইরাসের প্রকোপ?
মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে চীন, ভারত, থাইল্যান্ড এবং লাওসের। এই দেশগুলোর মধ্যে লাওসও ভাইরাসমুক্ত হিসেবে দাবি করছে। তবে এই দাবিকে গাল-গপ্পো বলে উড়িয়ে দিতে চাইছেন বিশ্লেষকরা। তারা দাবি করছেন, চীনের পাশের এমন একটি গরিব রাষ্ট্রের পক্ষে ভাইরাসের প্রকোপ ঠেকিয়ে রাখা একেবারে অসম্ভব। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘ফরেন পলিসি’ নামের একটি সংবাদমাধ্যম।
তাদের প্রতিবেদনে জানানো হয়, কেউ যদি লাওসে গিয়ে জানতে চান এখানে কোনো আক্রান্ত আছে কি না, তাহলে সবাই মুচকি হাসবে। তারপর সোজাসাপটা জানিয়ে দেবে, না। প্রাণঘাতী ভাইরাসে আক্রান্ত কেউ এই দেশে নেই। তবে আপনি যদি কৌতুহলী হন, তাহলে আরো একটু খতিয়ে দেখতে হবে। যেতে হবে ভেতরের দিকে। গ্রামে-গঞ্জে মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। নারীদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। শিশুদের সঙ্গে খেলতে হবে। তখন আপনার কানে আসবে কিছু কোলাহল। এর সবগুলোকেই ধরে নিতে পারেন ‘গুজব’ বলে। তবে উড়িয়ে দেবেন না। বাতাসে ভেসে আসা খবরগুলো আপনাকে জানিয়ে দেবে, আজ এখানে একজন আক্রান্ত হয়েছে। গতকাল ওখানে একজনের মৃত্যু হয়েছিলো।
তবে দেশটির সরকার সোজাসাপটা দাবি করছে, এখনো পর্যন্ত কেউ আক্রান্ত হয়নি। তারা এ পর্যন্ত ৮৫ জনকে সন্দেহ করেছিলেন। এদের মধ্যে ৮১ জনের শরীরে কিছু পাওয়া যায়নি। বাকি চারজনের অবস্থা কী, সেটা জানার আগেই বিডিভিউজের জন্য এই প্রতিবেদনটি তৈরি করতে হয়েছে। লাওসের কর্তৃপক্ষ জানায়, এই পরীক্ষার আগে বহু লোককে তারা কোয়ারেন্টাইনে রেখেছিলেন। এখনো রাখছেন।
ভাইরাসমুক্ত হিসেবে লাওসের দাবিকে গাল-গপ্পো হিসেবে দেখলেও চীনের আরেক প্রতিবেশি মিয়ানমারের দাবির বিষয়টি বিশ্বমিডিয়ার আলোচনাতেই নেই। এমনকি বাংলাদেশেও তেমনভাবে কৌতুহল তৈরি করছে না। অথচ চীনের ওহান থেকে যখন ভাইরাসটির খবর আসছিলো, তখন শঙ্কা করা হচ্ছিলো মিয়ানমার হয়ে এই মরণব্যাধি বাংলাদেশেও প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু এখন বাংলাদেশ আক্রান্ত। অন্যদিকে মিয়ানমার এখনো প্রকোপমুক্ত। অন্তত তাদের দাবি সেটাই বলছে। চীনের সঙ্গে যাদের দহরম-মহরম সেই দেশের এই দাবি কতটা বাস্তব?
মূলত বাইরের দুনিয়া থেকে মিয়ানমারের বাস্তবতা খতিয়ে দেখা কঠিন। দেশটির শাসকেরা নিজেদের রহস্যের চাদরে আড়াল করে রাখে। ভেতরে কখন কী হচ্ছে সে খবর প্রতিবেশিরাও ঠাহর করতে পারে না। মিয়ানমার বাংলাদেশের পাশের দেশ হলেও, এই দেশের অনেক কিছুই বাংলাদেশের মানুষের ধারণার বাইরে। দেশটির সরকার যে তথ্য প্রকাশ করে, সেগুলোই বাইরে আসে। সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ওহানে সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর থেকেই তটস্ত ছিলো দেশটি। তখন থেকেই সব দেশের সঙ্গে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। তবে ওহানে যখন মানুষের মড়ক শুরু হয়, মিয়ানমারের রাখাইনে তখন শুরু হয় মহিষের মড়ক। এক অজ্ঞাত রোগে একটি গ্রামেই তিন শতাধিক মহিষের মৃত্যু হয়। তখন অনেকে সন্দেহ করেন, এটা ওহান থেকে আসা কোনো ভাইরাস নয়তো!
সময় গড়িয়ে যায়। বিশ্ব সংবাদমাধ্যম তুমুল ব্যস্ত হয়ে যায় ভাইরাসের প্রকোপ নিয়ে। আজ এই দেশ, কাল ওই দেশে আক্রমণ। আক্রান্ত দেশের তালিকায় মিয়ানমারের নাম যুক্ত হয়নি। তবে মিয়ানমার টাইমস জানিয়েছে ২২ মার্চ ইয়াঙ্গুন থেকে শতাধিক চীনের নাগরিককে আটক করে কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়েছে মিয়ানমার। এরা অবৈধভাবে মিয়ানমারে প্রবেশ করেছে। দল বেঁধে ইয়াঙ্গুনের দুইটি ভবনে লুকিয়ে ছিলো। কোয়ারেন্টাইনের পর এদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে মিয়ানমার।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, বিশ্বব্যাপী মরণঘাতির প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশটিতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। লোকসমাগমে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। দরকার হলে আগামী এপ্রিলে তারা তাদের নতুন ফসলের উৎসব ‘থিংগিয়ান’ পালন করবে না। অনেকেই বলছেন, এমন কঠোর পদক্ষেপের কারণেই বিপর্যয় এড়াতে পারছে মিয়ানমার।
কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ায় ভাইরাস প্রবেশ করতে পারেনি উত্তর কোরিয়ায়। দেশটি দাবি করছে শুরুর দিকেই তারা চীনের সঙ্গে সীমান্ত-বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছিলো। সন্দেহজনক পাঁচ হাজার চারশো জনকে ত্রিশ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছিলো। এ কারণে এখনো তাদের দেশে আক্রান্তর সংখ্যা ‘শুন্য’। তবে এতে সন্দেহ প্রকাশ করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। কারণ উত্তর কোরিয়ার প্রতিবেশী চীনে এখন পর্যন্ত ৮০ হাজার ৮৯৪ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ২৩৭ জনের। বিশেষজ্ঞদের দাবি উত্তর কোরিয়া হয়তো সত্য ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এর আগে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করেছে যে, উত্তর কোরিয়ায় আক্রান্ত সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। দেশটির সেনাবাহিনীর গতিবিধির ওপর নজর রেখেও সন্দেহ জোড়ালো করছেন অনেকে। তারা বলছেন, টানা ২৪ দিন দেশটির আকাশে কোনো সামরিক বিমান উড়তে দেখা যায়নি। এই সময়টুকু কী কাজে ব্যস্ত ছিলো সামরিক বাহিনী? হতে পারে সেটা ভাইরাসের বিপরীতে যুদ্ধও। এবার ভাইরাসের বিপরীতে যুদ্ধ করে রীতিমতো বিশ্বকে চমকে দিয়েছে আফ্রিকার কখেটি দেশ।
আফ্রিকার অনেকগুলো দেশে এই মরণঘাতীর প্রকোপ দেখা দিলেও শুরুর দিকে মহাদেশটা ছিলো মুক্ত। এমনকি যখন ভাইরাসটিকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তখনো আফ্রিকা ছিলো মুক্ত মহাদেশ। অথচ যে কোনো মহামারিতে বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছে যায় আফ্রিকা। ২০১৪ সালেও এক অজানা সংক্রমণে ওখানে শুরু হয়েছিলো মৃত্যুমিছিল। কঙ্গোর আকাশ ভারি ছিলো আর্তনাদে। পরে ওই ভাইরাসের নাম দেওয়া হয় ইবোলা। গত বছরও ব্যাপকভাবে হামলে পড়েছিলো ইবোলা। এর ওপর ম্যালেরিয়ার আতঙ্ক তো সবসময়ই থাকে। এতোসব রোগ-ব্যাধী যাদের সঙ্গী, এবার তারা কী করে সংক্রমণমুক্ত! না, বৈশ্বিক এই হুমকি থেকে একেবারে মুক্ত নয় কোনো অঞ্চল-ই। পূর্ব আফ্রিকায় আক্রান্তের খবর জানা যায় দিনকয়েক আগে। ৫০ বছরের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। তবে তিনি বিদেশি পর্যটক ছিলেন। দ্বিতীয় আক্রান্ত ইথিওপিয়ার এক জাপানি পর্যটক। তবে তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল। জানা গেছে তিনি নাকি দেশেও ফিরে গেছেন। নাইরোবিতে এক নারীর ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছিলো। তিনি আমেরিকা থেকে লন্ডন হয়ে নাইরোবিতে ফিরেছিলেন। তবে পরে পরীক্ষা করে তার শরীরে কোনো ভাইরাসের খোঁজ মেলেনি। এর বাইরে পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার কোথাও সংক্রমণের খবর সেভাবে পাওয়া যায়নি।
এর পেছনের কারণ কী? প্রকৃতির খেয়াল, নাকি মানুষের সচেতনতা? এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন আফ্রিকায় কর্মরত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক মাতশিদিসো মোয়েতি। তিনি জানিয়েছেন, সংক্রামক ব্যধির বিষয়ে অনেক সচেতন আফ্রিকার মানুষ। কেবল শহরে নয়, গ্রামে-গঞ্জেও এই সচেতনতা আছে। এবারের প্রকোপ যখন মহামারিতে রূপ নিচ্ছে, তখন থেকেই মধ্য, পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকায় সতর্কতা জারি করা হয়। দোকান, বাজার, বিপনীবিতান সীমিত করে দেওয়া হয়। সব এলাকায় রাখা হয় হ্যান্ড-স্যানিটাইজার। লোকেরা হাতে করে সাবান নিয়ে ঘুরতে শুরু করেন। পকেটে থাকে স্যানিটাইজার। কারো সর্দি-কাশি দেখা দিলেই তিনি অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যেতেন। এ কারণেই ওখানে তেমন সুবিধা করতে পারেনি ভাইরাস।
মাতশিদিসো জানিয়েছেন, একেবারে অজপারা গ্রামেও এইসব সচেতনতা চলছে গত দু’মাস ধরে। লোকেরা বড় কোনো উৎসবে যাচ্ছে না। একসঙ্গে জড়ো হচ্ছে না। সর্দি-কাশি ছাড়া অন্য কোনো রোগ হলেও ঘরের বাইরে বের হয় না। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারাও তৎপর ছিলেন। জ্বর বা সর্দির রোগি পেলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্য ক্যাম্পও করা হয়। এইডস রোগীদের রাখা হয়েছিল বিশেষ সতর্কতায়। গোটা বিশ্বে আইচআইভি আক্রান্ত হয়ে যতজনের মৃত্যু হয়, তার মধ্যে আফ্রিকাতে এর সংখ্যা বিপজ্জনক। এইডস রোগীদের আগেই কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিশ্বজুড়ে বিমানবন্দরগুলিতে যখন থার্মাল স্ক্রিনিং শুরু হয়, তার অনেক আগে থেকেই স্ক্রিনিং-এর ব্যবস্থা করেছিল আফ্রিকার দেশগুলো। ফলে এখনকার সঙ্কট একটু দেরিতেই স্পর্শ করছে তাদের। আর এই সচেতনতা অব্যাহত থাকলে সেই স্পর্শটাও হয়তো খুব একটা জোড়ালো হবে না।
আফ্রিকার দেশগুলোর মুক্ত থাকার ব্যাপারটাকে অনেকে দেখছেন অলৌকিক হিসেবে। কেউ কেউ এ নিয়ে বিশ্লেষণও তৈরি করছেন। সংক্রমণমুক্ত দেশগুলোর তালিকা তৈরি করে কেউ বলছেন, মুক্ত দেশগুলোর অধিকাংশই দরিদ্র এবং যুদ্ধপীড়িত। বৈশ্বিক পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডওমিটারের হিসাবে এখনো এই ছুঁয়াচে ভাইরাস থেকে দূরে আছে ৪২ দেশ। এর মধ্যে ৩৮টি জাতিসংঘের সদস্য। বাকি চারটি সদস্য নয়। তবে বেশিরভাগ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক। হয়তো দারিদ্রসীমার নিচে রয়েছে। নয়তো যুদ্ধে বিধ্বস্ত। যেমন সিরিয়া, বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এই দেশ। হাইতি, দরিদ্র দেশগুলোর তালিকায় এর নাম। এমন আরেকটি দেশ কিরিবাতি। আরো কয়েকটি- লেসোথ, লিবিয়া, মাদাগাস্কার, মালাউই, মালি, নাইজার, তাজিকিস্তান, পূর্ব তিমুর, টোঙ্গা, ইয়েমেন, সিয়েরালিওন।
ইন্টারনেটে খুঁজলে খুব সহজে বাকিগুলোর নামও পাওয়া যাবে। সবগুলো নাম বিশ্লেষণ করলে ওয়ার্ল্ডওমিটারের দাবির সত্যতাই উঠে আসবে। আর সেই সত্য আপনাকে আচ্ছন্ন করে দিতে পারে নতুন কোনো ধাঁধাঁয়।