করোনায় পুরো বিশ্বজুড়ে যে ভয়াবহ পরিবেশ তৈরি হয়েছে তা সামনে রেখে এখনই সময় সব দেশের সরকারকে এক হয়ে কাজ করার। বিশেষ করে সব পর্যায়ের মানুষের জন্য স্থায়ী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য অর্থায়ন ও এক হয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।
বিশ্বব্যাপী মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনার ভাইরাস একটা পরিস্কার বার্তা দিয়েছে, আমাদের আশপাশের সবচেয়ে বিপন্ন মানুষের নিরাপত্তা রক্ষা করতে না পারলে আমাদেরও মুক্তি নেই। যাদের জীবিকার তাগিদে কোয়ারেন্টিনে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন না কিংবা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা সেবা নেয়ার সক্ষমতা যাদের নেই, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে অন্যদের জীবনও হুমকিতে পড়বে তা নিশ্চিত। কোন দেশ যদি বিপন্ন এসব মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় তবে সেই দেশ সংক্রমণ ঠেকাতেও ব্যর্থ হবে। সারা বিশ্বেই সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে কেননা তারা প্রান্তিক মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারছে না।
বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষের স্বাস্থ্য বীমা নেই কিংবা স্বাস্থ্য সুরক্ষার সুযোগ নেই। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ কোটি মানুষ প্রতি বছর তাদের পারিবারিক বাজেটের ১০ শতাংশ অর্থ খরচ করে স্বাস্থ্য সেবার পেছনে। স্বাস্থ্য সেবার ব্যয় মেটাতে প্রতি বছর ১ কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হচ্ছে। এর অর্থ, তারা অসুস্থ্য হলে ন্যূনতম স্বাস্থ্য সেবা পায় না। তাহলে করোনার মতো উচ্চ ঝুঁকির সংক্রামক রোগের বিস্তার তারা কিভাবে ঠেকাবে?
এমন দুর্যোগে বেশিরভাগ শ্রমিক কোন রকম আর্থিক নিশ্চয়তা ছাড়াই কাজ থেকে ছুটিতে যেতে বাধ্য হয়েছেন। বিশ্বের মোট দেশের দুই তৃতীয়াংশেরও কম দেশে এমন দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় বীমা সুবিধা কিংবা সামাজিক দূরত্ব রক্ষার বিশেষ আর্থিক স্কিম আছে।
প্রায় সব দেশেই বেকারদের সুরক্ষার ব্যবস্থা খুবই নাজুক। এসব বেকার তাদের নিজেদের পরিবারের আয়-রোজগারে তেমন কোন ভূমিকা পালন করতে পারে না। বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় করোনার ব্যাপক বিস্তারে এরই মধ্যে সরবরাহ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল ব্যবসা-বাণিজ্যে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। আবার অনেক এলাকা লকডাউন হয়ে পড়ায় ব্যাপকহারে পণ্যের চাহিদা কমেছে তাই এসব ব্যবসাও চাপে পড়েছে। এসব কারণে বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছাটাই হচ্ছে, চাকরি চলে যাচ্ছে কিংবা বিনা বেতনে কর্মীরা ছুটিতে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। তারপরও এখন প্রতি ৫ জনে একজনকে বেকার হিসেবে ধরা হচ্ছে।
এই হিসাব ঠিক থাকলেও বিশ্বের ৫৫ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ কয়েক শ’ কোটি মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বাইরে থেকে যাচ্ছে। এসব মানুষের বেশির ভাগেরই জীবিকা নির্ভর করে বাজার ভিত্তিক অর্থনীতির উপর। এর মধ্যে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ায় এখন এই সংকট শুধু গরীব মানুষকেই ভোগাবে না বরং পুরো সমাজ বা বিশ্বের কল্যাণের জন্যই তা হুমকি হয়ে দেখা দেবে।
২০১৫ সালে বিশ্ব নেতৃত্ব চমৎকার এক পরিকল্পনা হাতে নেয়। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা প্রণয়ন করা হয়। এসব লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে অনকেগুলোই সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। যেমন টার্গেট ২.৮ এ বলা হয়েছে বিশ্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা। এর মধ্যে আছে আর্থিক ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা, সবার মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার অধিকারের কথা এবং সবার জন্য নিরাপদ, কার্যকর অথচ সবার সক্ষমতার মধ্যে ওষুধ ও টীকা পাওয়ার অধিকারের কথা। টার্গেট ১০.৪ এ বলা হয়েছে, প্রত্যেকটি দেশকে নীতিগত, বিশেষ করে আর্থিক নীতি, বেতন ও সামাজিক সুরক্ষা নীতি এবং মানসম্মত সুযোগ নিশ্চিত করার নীতি গ্রহণ করতে হবে। এবং টার্গেট ১.৩ এ বলা হয়েছে প্রত্যেকটি দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে সবার সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম হাতে নেবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দরিদ্র ও বিপন্ন মানুষের টেকসই সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
কিন্তু কোভিড-১৯ সংকট আমাদের সামনে স্পষ্ট করেছে আমাদের নেয়া পদক্ষেপ এখনো পর্যাপ্ত নয়। যদি ধরেও নেই যে মহামরি নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে রয়েছে, তাহলে যে কেউ বলবেন যে এখন সময় সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য সেবা, অসুস্থকালীন সুবিধা নিশ্চিত করা এবং বেকারত্ব অবসানে ব্যবস্থা নেয়ার। সর্বপরি, এসব ক্ষেত্রে যে ব্যয় হবে তার প্রভাব অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক। বিশেষ করে কর অব্যাহতি, প্রথমবারের মতো যারা বাড়ি কিনছেন তাদের জন্য বিশেষ ছাড় এবং কিছু ক্ষেত্রে কর্পোরেট কর কমানো এসবের চেয়েও এই খরচ সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় বেশি কার্যকর।
অবশ্যই একটি প্রশ্ন বার বার সামনে আসছে, এই মহামারির খেসারত কিভাবে দিতে হবে আমাদের? আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা –আইএলও একটি ধারণা দিয়েছে এ ব্যাপারে। উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোতে গড় আর্থিক তফাত থাকবে জিডিপির ১.৬ শতাংশের সমান। আর নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এ হার দাড়াবে প্রায় ৬ শতাংশের কাছাকাছি।
যদিও এটাও ঠিক, পৃথিবী এখনকার মতো ধনি আর কখনো ছিলো না। এই মহামারি আমরা কমাতে পারি আর না পারি, আমরা অন্তত আমাদের প্রয়োজনীয় সম্পদের ব্যবহার নিশ্চিত করতে তো পারি। আর এ ক্ষেত্রে দেশগুলোকে কর্পোরেট কর নীতি সংস্কার করতে হবে। বেশি আয়ের মানুষের বেশি কর এবং সম্পদের ওপর আরোপিত করও হয়তো এ ক্ষেত্রে সহায় হতে পারে।
তবে এসব পদক্ষেপ নিলেও তা কার্যকর হতে বেশ কিছু সময় লাগবে। কেননা মহামরি এরই মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে মানুষের আয় কমে গেছে, প্রয়োজন ফুরাচ্ছে দ্রুত। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এখনই সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচিতে আর্থিক সঞ্চালন বাড়াতে হবে।
অনেক দেশের সরকারই ,বিশেষ করে সামাজিক অংশগ্রহণ বা করের টাকার ওপর ভিত্তি করে যেসব দেশ সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছেন, তারা এরই মধ্যে এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে নেয়া পদক্ষেপ বেশ চোখে পড়ছে।
তাছাড়া, বেশ কিছু সরকার জীবন যাপনের জন্য ও ব্যবসা ধরে রাখার জন্য আর্থিক সহায়তা করে যাচ্ছে। যারা অসুস্থতার জন্য কোয়ারেন্টিনে আছেন কিংবা নিজে থেকেই কোয়ারিন্টিনে গেছেন তাদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে হংকং, আয়ারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য। এছাড়া বেকার হয়ে পড়াদের জন্য সুবিধা ঘোষণা করেছে জার্মানী ও নেদারল্যান্ডস।
একইভাবে, করোনা মোকাবেলায় সরকার যেসব প্রতিষ্ঠান বাধ্যতামূলকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য বিশেষ অর্থ সহায়তা দিয়েছে চীন, ফ্রান্স, পর্তুগাল ও সুইজারল্যান্ড। সেই সঙ্গে সমাজের বিপন্ন মানুষের জন্য সামাজিক সহায়তা ঘোষণা করেছে অস্ট্রেলিয়া, চীন ও পর্তুগাল। আবার কোন কোন দেশ কর পরিশোধের সময় সীমা বাড়িয়েছে।
কিন্তু এসব পদক্ষেপ কেবলই প্রাথমিক। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ পেতে অবশ্যই দেশগুলোকে এক হয়ে অর্থায়ন করতে হবে এবং একটি আন্তর্জাতিক সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আর তাহলেই কেবল আমাদের সমাজ ও অর্থনীতি কোভিড-১৯ এর মতো মহামারি মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে।
লেখক: শাহরা রাজাভি, পরিচালক, আইএলও সামাজিক সুরক্ষা বিভাগ। আইএলও’র ওয়েব পেজ থেকে ভাষান্তর করেছেন সাজিদ রাজু।