বিশ্বের শীর্ষ দুই অর্থনীতি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অনেক দিন ধরেই ভালো যাচ্ছে না। সর্বশেষ এর শুরু হয়েছিল চীনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধের মাধ্যমে। তবে করোনাভাইরাস নিয়ে বিরোধে ওয়াশিংটন-বেইজিং সম্পর্ক একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনাভাইরাস নিয়ে বিবাদে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক চিরদিনের জন্য বদলে যেতে পারে। পাশ্চাত্যের গবেষকরা বলছেন যে করোনা উত্তর বিশ্বে চীনের আরও উত্থান হতে পারে। পতন ঘটতে পারে আমেরিকার একাধিপত্যের।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দেশের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছিলেন বেশ আগেই। তবে তিনি সবসময়ই চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রশংসা করেছেন। এমনকি করোনা সংকট শুরু হওয়ার পরও ট্রাম্প বলেছেন, জিনপিং অত্যন্ত চমৎকার কাজ করছেন। অবশ্য আমেরিকায় করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর ট্রাম্পের সুর পাল্টে যায়। ট্রাম্প ও আমেরিকার শীর্ষ কর্মকর্তারা চীন সরকারের সমালোচনায় মুখর ওয়ে ওঠে।
ট্রাম্প করোনাভাইরাসকে চীনা ভাইরাস বলে মন্তব্য করেছেন। ট্রাম্প বলেছেন,চীনের উহানে উৎপত্তি হওয়া করোনাভাইরাস এখন যুক্তরাষ্ট্রকে অচল করে দিয়েছে। চীন সরকার এ ভাইরাসের তথ্য লুকানোর কারণে বিশ্বকে চড়ামূল্য দিতে হচ্ছে। করোনার উৎপত্তি যেখানে সেখানেই এটিকে থামিয়ে দেওয়া যেতো।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, চীন সরকার এ সংক্রান্ত তথ্য বিকৃত করেছে। ফলে সারা বিশ্বের মানুষের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তিনি করোনাভাইরাসকে ‘উহান ভাইরাস’ বলেও মন্তব্য করেছেন।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এমন সময় এই মহামারি নিয়ে উত্তেজনা বাড়ছে যখন করোনা নিয়ে নজিরবিহীন সংকটে পড়ে বিশ্ব হাবুডুবু খাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের এ ধরনের সমালোচনার কারণে দুটি বিশ্বশক্তি নতুন করে শীতল যুদ্ধের দিকে এগুচ্ছে। এতে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় যৌথ প্রচেষ্টা ব্যাহত হতে পারে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠাও কঠিন হতে পারে।
কর্নেল ইউনিভার্সিটির চীনা বিশেষজ্ঞ এসওয়ার প্রসাদ এই বৈরিতাকে হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বিশেষ এক দুর্ভাগ্যজনক সময়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তিয়েনআনমেন স্কয়ারে হত্যার পরে সবচেয়ে তলানিতে ঠেকেছে। অথচ এখন মহামারিতে বিধ্বস্ত জনস্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক তৎপরতা ও শেয়ারমার্কেটের ক্ষতি সামাল দিতে দুই দেশের উচিত একযোগে কাজ করা । সাবেক কূটনীতিক ও প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চল বিষয়ক সহকারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেলি মাগসামেন বলেন, দুদেশের প্রতিযোগিতার মনোভাব করোনা রোধের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করছে। শুধু সমালোচনার জন্য চীনের সমালোচনার না করে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে একযোগে কাজ করা।
যুক্তরাষ্ট্রের চীন বিরোধীরা একে দেখছেন, বেইজিংয়ের কমিউনিস্ট শাসনের অপরাধপ্রবণতার বিরুদ্ধে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের একটি সুযোগ হিসেবে। তারা চাচ্ছেন চীনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে এবং চীনের আমেরিকা বিরোধী ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মোকাবিলা করতে।
চীনের ক্ষমতাসীন পার্টির কড়া সমালোচক এবং ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসের সাবেক প্রধান কর্মকর্তা স্টিফেন কে ব্যানন বলেন, চীন সরকার বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। শুধু তাই নয়, চীনের জনগণ এবং বাকি বিশ্বের জন্যও চীন সরকার বড় হুমকি।
ট্রাম্প প্রশাসনের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তাই ব্যাননের মত একই মনোভাব পোষণ করেন। তারা চান, চীনের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থান নিতে। তারা বলছেন, জিনপিংয়ের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসনে চীনের দ্রুত উন্নয়ন ঘটছে এবং বেইজিং সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও নিজেও আছেন এই দলে। চীন সরকার শুরুতে যেভাবে এ ভাইরাসের সংক্রমণের তথ্য লুকিয়েছেন তার নিন্দায় সরব হয়েছেন তিনি।
তবে ট্রাম্পের কয়েকজন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বলছেন, আন্তসংযুক্ত বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতা দরকার। কারণ চীনের হাতে রয়েছে অর্থনীতির অনেক কার্ড। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্টিভেন মুনচিনও আছেন এই দলে।
বিরোধের জেরে চীন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ স্থানীয় তিনটি পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস ওয়াশিংটন পোস্ট ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিকদের চীন থেকে বহিষ্কার করেছে। একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারও। ওয়াশিংটন পোস্টের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসকে চিরদিন চীন সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হিসেবে দেখতে হবে। এতে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির কেন ধপাস পতন হচ্ছে, জানতে চান? রেস্তোরা, বার কেনা বন্ধ হচ্ছে যাতে বেকার হয়ে পড়ছেন যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ মানুষ? বিমান সংস্থাগুলো কেন দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে? শেয়ার বাজারে কেন ধস নামছে? এসব উত্তর একটাই: চীনের কমিউনিস্ট সরকারের দোষে এসব ঘটছে।
এর উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, চীনের উহানে যখন ভাইরাসটির উদ্ভব হয় তখন লি ওয়েনলিং নামের একজন চিকিৎসক এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিলেও প্রাদেশিক সরকার তা গোপন রাখে। বরং তাকে দমন করা হয়। পরে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রিভিউয়ে এক নিবন্ধে করোনাভাইরাসকে জিনপিংয়ের সৃষ্ট রোগ বলে মন্তব্য করা হয়। এতে বলা হয়, করোনার জন্য চীনের জনগণ দায়ী নয়। কিন্তু চীন সরকার দায়ী । কারণ তারা এটি গোপন রেখে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সহায়তা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনায় ক্ষুব্ধ হয়েছে চীন সরকার। বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা পাল্টা জবাব দিচ্ছেন। সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র করোনাভাইরাস নিয়ে প্রচলিত গুজব বা ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী হয়তো উহানে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। তবে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, করোনাভাইরাস প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হয়েছে।
বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সামগ্রী সরবরাহের ওপর চীনের তাৎপর্যপূর্ণ আধিপত্য রয়েছে। আমেরিকার কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন যে চীন বিশাল সংখ্যায় মেডিকেল মাস্ক কিনে রেখেছে। মেডিকেল ডিভাইস ও প্রটেকটিভ গিয়ারের সবররাহ ব্যবস্থায়ও তাদের আধিপত্য রয়েছে।
চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সিনহুয়ায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে হুমকি দেওয়া হয়েছে যে আমেরিকায় কিছু জরুরি ওষুুধ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে চীন। এরপর থেকেই চীনের ওষুধের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে তৎপর হয়ে উঠেছে ট্রাম্প প্রশাসন। স্টিভেন ব্যানন বলেন, ট্রাম্প কঠিন পরস্থিতির মুখে রয়েছেন। অর্থনীতির ক্ষেত্রে তার চীনের সহযোগিতা দরকার। পাশাপাশি করোনা রোধেও।
তবে সহযোগিতার আশা দূর-অস্ত। বরং এশিয়া-প্যাসিফিকে সংঘাতের জন্য তলেতলে তৈরি হচ্ছে দুই দেশ। চীন এখন আঞ্চলিক সামরিক শক্তি। তবে বেইজিং চায় বিশ্বে তার অবস্থান আরও সংহত করতে। বিবিসি বলছে, করোনাভাইরাস যখন পরাজিত হবে তখন চীনের অর্থনৈতিক উত্থান বিশ্বের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
তাছাড়া করোনা নিয়ন্ত্রণেও চীনের সহায়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনার মেডিকেল উপাত্ত এবং এটা নিয়ন্ত্রণে চীনের অভিজ্ঞতা বিশ্বের জন্য খুবই জরুরি। এছাড়া মেডিকেল মাস্ক, প্রটেকটিভ গিয়ারসহ করোনার মোকাবিলায় জরুরি বহু মেডিকেল সামগ্রী চীনের ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হয়। চীনকে বলা হয়, চিকিৎসা সামগ্রী উৎপাদনের কারখানা। চীন যেভাবে এটা উৎপাদন করতে পারে, তা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
ট্রাম্পও হয়তো এটা বুঝতে পেরেছেন। তাই চীন সম্পর্কে সম্প্রতি ভোল পাল্টেছেন তিনি। সমালোচনা বাদ দিয়ে সম্প্রতি ট্রাম্প বলেছেন, আমি চীন ও প্রেসিডেন্ট জিন পিংকে সম্মান করি। জিনপিং আমার বন্ধু।
যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া বিষয়ক দুজন বিশেষজ্ঞ কুর্ট এম ক্যাম্পবেল ও রাশ দোশি ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে এক নিবন্ধে লিখেছেন, শুধু সম্পদ ও ক্ষমতার জোরে যুক্তরাষ্ট্র গত সাত দশক বিশ্ব নেতা হিসেবে বিশ্বে মর্যাদা পায়নি। বরং দেশটির অভ্যন্তরীণ শাসন, বিশ্ব মানবতার কল্যাণ ও সংকটে সাড়া দেওয়ার মত ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রকে এই সম্মান এনে দিয়েছে। তারা বলছেন, করোনাভাইরাস এসব অর্জনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র এই পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের এই ব্যর্থতার সুযোগ নিচ্ছে চীন। বেইজিং খুব দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের শূণ্যতা পূরণে এগিয়ে এসেছে।
বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, চীনের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়লেও সেসব এখন আর আলোচনায় নেই। এখন আলোচনায় বিভিন্ন দেশে চীনের চিকিৎসা সামগ্রী অনুদানের খবর।
পাশ্চাত্যের অনেক ভাষ্যকার বলছেন, করোনা মোকাবিলায় সাফল্যের পর চীন আরও বেশি কর্তৃত্ববাদী ও জাতীয়বাদী হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক মন্দার কারণে তাদের এই মনোভাব আরও চাঙ্গা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এর প্রভাব হতে পারে আরও সুদূরপ্রসারী। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররাও এসব লক্ষ্য করছেন। তারা প্রকাশ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের সমালোচনা না করলেও চীন ও ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবকে ভালোবাসে নিচ্ছেন না।
করোনা সংকটকে পুঁজি করে চীন ভবিষ্যতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কেও ভিত্তি মজবুত করছে। চীন এখন অনেকের কাছেই অপরিহার্য। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চীনের চিকিৎসা সামগ্রী দিয়ে চীনের সহায়তাকে এই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে।
ক্যাম্পবেল ও দোশী ফরেন অ্যাফেয়ার্সের নিবন্ধে এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের পতনের উদাহরণ টেনেছেন। তারা বলছেন, ১৯৫৬ সালে ব্রিটিশরা সুয়েজ খাল দখলের অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হলে তাদের সা¤্রাজের ক্ষয় শুরু হয়। বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে সেটাই ছিল ব্রিটিশ সা¤্রাজের পতনের শুরু। ক্যাম্পবেল ও দোশী বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা এখনকার প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে না এলে করোনা মহামারি তাদের জন্য হবে আরেক ‘সুয়েজ মুহূর্ত’।