করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি মানুষই কাঁপছে। ভয়ঙ্কর এই ভাইরাস প্রতিদিন কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য মানুষের জীবন। অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। এমন ঘোর দুর্দিনকেও বিভিন্ন দেশের স্বৈরশাসকরা দেখছেন ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে। করোনার ছোবল থেকে মানুষের জীবন রক্ষার অজুহাত দেখিয়ে দেশে দেশে স্বৈরশাসকরা ভিন্নমত দমন ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করছেন। মিশর থেকে আজারবাইজান, থাইল্যান্ড থেকে হাঙ্গেরী, ফিলিপাইন থেকে রাশিয়ার সরকারগুলো করোনা সংকটকে পুঁজি করে বিরোধী দলের কার্যালয় বন্ধ, সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ, জনসভা বন্ধের আড়ালে প্রতিবাদ-বিক্ষোভও বন্ধ করে দিচ্ছে।
করোনা সংকট নিয়ে সরকারের সমালোচনা বন্ধ করতে মিশরে নতুন করে চলছে গ্রেফতার অভিযান। রাশিয়ায় বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের আজীবন ক্ষমতায় থাকার পথ সুগম হচ্ছে করোনা সংকটের মধ্যেই। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট বিরোধী দলের অফিস বন্ধ করে দিয়েছেন। জর্ডানে সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া। হয়েছে। ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ড সরকারকে অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। হাঙ্গেরীতে এখন শাসিত হবে প্রধানমন্ত্রীর ডিক্রির মাধ্যমে। বিশ্বে গণতন্ত্রের আদর্শ ব্রিটেনে নাগরিক স্বাধীনতা কমেছে আর বেড়েছে সরকারের ক্ষমতা। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী করোনার অজুহাতে দুর্নীতির বিচার বিলম্বিত করতে বিচার বিভাগের কার্যক্রমই বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি নাগরিকদের ওপর গোয়েন্দাগিরি শুরু করতে বলেছেন। চিলিতে দীর্ঘদিন ধরা চলা আন্দোলনের পর করোনার অজুহাতে মাঠে নামানো হয়েছে সেনাবাহিনী। বলিভিয়ায় নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে।
যেসব গণতান্ত্রিক দেশ আগে এ ধরনের পদক্ষেপের নিন্দা করত তারাও এখন অনেকাংশে একই পথ ধরেছে। আর এমন সময় এসব ঘটছে যখন বিশ্বে গণতন্ত্র ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রিডম হাউসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর ৬৪টি দেশে গণতন্ত্রের অবনতি হয়েছে আর উন্নতি হয়েছে কেবল ৩৭ দেশে। করোনাকে অজুহাত দেখিয়ে বহু সরকার কোনো বাধা ছাড়াই স্বৈরাচারের মত ক্ষমতার মালিক হচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোও স্বীকার করছে যে এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কিছু অস্বাভাবিক ব্যবস্থা নেওয়া যেতেই পারে। যেমন সীমান্ত বন্ধ, কোয়ারেন্টিন বাস্তবায়ন এবং আক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করার জন্য সরকারের নতুন ক্ষমতা দরকার। তবে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পদক্ষেপের অনেকগুলোই আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। সমালোচকরা বলছেন, উল্লেখিত দেশগুলোর সরকার জনস্বাস্থ্য সংকট সামাল দেওয়ার কথা বলে যে নতুন ক্ষমতার মালিক হচ্ছে তার সঙ্গে এই মহামারির সম্পর্ক সামান্যই। আরো উদ্বেগজনক হচ্ছে, তাদের এই নতুন ক্ষমতার লাগাম টানার কোনোও ব্যবস্থা নেই। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ফিওনুয়ালা নি আওলেইন বলেন, স্বাস্থ্য মহামারি শেষে আমরা হয়তো একটি সমান্তরাল কর্তৃত্ববাদী ও নিপীড়ক ব্যবস্থার মত মহামারি দেখতে পাব।
মিশরের স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি করোনা নিয়ে চীনের মত লুকোচুরি করছেন। কথিত বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের দায়ে মিশর সরকার অন্তত সাতজনকে গ্রেফতার করেছে। মিশরে সরকারের তথ্যের বাইরে করোনা নিয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। একটি বৈধ সরকারকে বন্দুকের নলের মাথায় উৎখাত করে ক্ষমতায় বসা সিসি ভিন্নমতকে মোটেই সহ্য করতে পারেন না। তার দেশে কার এমন সাহস যে করোনা নিয়ে তার ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেবে? শুধু সিসি নয় এরকম শাসক আরো আছে।
করোনা সংকটের মধ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য সংবিধানে ৪০০ সংশোধনী এনেছেন। এটা পাস হলে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা জোসেফ স্টালিনের চেয়েও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলে গত ১০ মার্চ মস্কোতে বড় সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। এক্ষেত্রেও করোনা ছড়ানোর অজুহাত দেখানো হয়।
জর্ডানে জরুরি প্রতিরক্ষা আইন পাসের পর সরকার সংবাদপত্র প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। সরকারের দাবি, সংবাদপত্রের মাধ্যমে করোনা ছড়াতে পারে। যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এরপর থেকে জর্ডানের সংবাদপত্র বন্ধই আছে। প্রধানমন্ত্রী ওমর রাজ্জাজ বলেছেন, কেউ গুজব ও আতঙ্ক ছড়ালে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ কোনো রাখঢাক ছাড়াই বিরোধী দলের কার্যালয় বন্ধ করে দিয়েছেন। সরকারের দাবি, এই কার্যালয়ের সভার মাধ্যমে করোনা ছড়াতে পারে। আলিয়েভ আরও ঘোষণা করেছেন যে তিনি বিরোধী দলীয় নেতাদের আইসোলেশনে রাখবেন। গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনরত বিরোধী দলকে তিনি দেশদ্রোহী ষড়যন্ত্রকারী বলে দাবি করেছেন।
ভুয়া খবর বা ফেক নিউজের অজুহাত তুলে বহ দেশের সরকার সামাজিক গণমাধ্যমের পাশাপাশি মূলধারার গণমাধ্যমও নিয়ন্ত্রণ করছে। অথচ সরকারের স্বচ্ছতার অভাবেই ভুয়া খবর ছড়ায় এবং বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে। যেসব দেশে গণমাধ্যম সরকারি ভাষ্যের বাইরে যেতে চায় না সেখানেই এ ধরনের সংকট তীব্র।
এসব দেশে গণতন্ত্র আগেই থেকে মরণাপন্ন ছিল। কিন্তু ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মত গণতান্ত্রিক দেশেও এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে।
করোনার কারণে অনেক গণতান্ত্রিক দেশেও নাগরিকদের ওপর ব্যাপকহারে নজরদারি করা হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে এটার তীব্র সমালোচনা প্রত্যাশিত হলেও এখন এটা প্রশংসিত হচ্ছে। কারণ এর মাধ্যমে সংক্রমণ রোধ করা যাচ্ছে। চীন সরকার কোটি কোটি মানুষকে লকডাউন করায় যেসব সরকার সমালোচনা করছিল তারাও এখন একই পথ অনুসরণ করছেন।
করোনা সংকটে পর্যুদস্ত ইতালি, স্পেন ও গ্রীসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কমিউনিস্ট শাসিত চীন। এখন এসব দেশে চীনের সুনাম বেড়েছে। অথচ চীনের লুকোচুরির কারণেই করোনা সংকট বিশ্বে তীব্র হয়েছে বলে মনে করা হয়। আগে এসব দেশ চীনের নির্মম শাসন ব্যবস্থার কঠোর সমালোচক ছিল।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু নাগরিকদের মোবাইল ফোনের তথ্য দেখে তাদের অবস্থান শনাক্ত করার জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে অনুমোদন দিয়েছেন। অথচ সন্ত্রাসবিরোধী কাজে ব্যবহারের জন্য এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে কেউ আইসোলেশন আদেশ লংঘন করলে তাকে ধরে ছয়মাস পর্যন্ত সাজা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
দেশে দেশে যেভাবে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে তাতে সামরিক আইনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তেকে জরুরি ক্ষমতা দিয়ে সংসদে আইন পাস হয়েছে। তিনি প্রাইভেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ক্ষমতাও চেয়েছিলেন। তবে সংসদ তা নাকচ করে দিয়েছে। ফিলিপাইনের একটি মানবাধিকার সংগঠন বলেছেন, দুতার্তেকে যে অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা স্বৈরতন্ত্রের নামান্তর মাত্র। দুতার্তে এর আগে তার দেশে সংবিধানকে ব্যবহৃত টয়লেট পেপার বলে মন্তব্য করেছিলেন।
পরোক্ষ সামরিক শাসনে থাকা থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক সেনাশাসক প্রায়ুথ চান ওচাকে কারফিউ জারি ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সেখানে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ শরণার্থী প্রত্যাশীদের আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা রহিত করা এবং নাগরিকদের বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত আটকে রাখার ক্ষমতা চেয়েছিল। তবে রিপাবলিকান ও কংগ্রেসের তীব্র সমালোচনার পর সেখান থেকে সরে গিয়ে মধ্যপন্থী প্রস্তাব পেশ করেছে বিচার বিভাগ। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, জনগণকে কোণঠাসা করে সরকারগুলো যেভাবে ক্ষমতা পোক্ত করছে তা উদ্বেগজনক। করোনা সংকট কেটে গেলেও এসব ক্ষমতার অপপ্রয়োগের আশঙ্কা প্রবল। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ারে হামলার পর প্যাট্রিয়ট আইন পাস হয়। তবে সেটির প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পরও অনেক দিন তা কার্যকর ছিল।
এবারও হারানো অধিকার ফিরে পেতে জনগণকে হয়তো আবার আন্দোলনে নামতে হবে।
করোনা সংকট অনেক স্বৈরাচারি সরকারের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। হাঙ্গেরীতে প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান সংসদকে পাশ কাটিয়ে ডিক্রির মাধ্যমে দেশশাসনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ সময় বিদ্যমান আইন স্থগিত থাকবে। চলতি মাসে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন ভিক্টর অরবান। এটা কবে শেষ হবে সেই সিদ্ধান্ত তিনি এককভাবে নিবেন। সমালোচকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীকে এতো বিপুল ক্ষমতা দেওয়ায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও দুর্বল হয়ে পড়বে এবং সাংবাদিক ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা নিপীড়নের শিকার হবেন। আইন সংশোধন করে সেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাঙ্গেরীতে আপাতত কোনো নির্বাচনও হবে না। করোনা সংকট নিয়ে সরকারের কাজের সমালোচনা করলে ৫ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। এরফলে ভিক্টর অরবানের সরকার সত্যিকারের স্বৈরাচার হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
ভিক্টর অরবান দাবি করছেন, করোনা সংক্রমণের সঙ্গে অবৈধ অভিবাসীদের সম্পর্ক রয়েছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাননি , তবু ভিক্টর এসব কথা বলেই যাচ্ছেন। পাঁচ বছর আগে অভিবাসী সংকট প্রকট হলে হাঙ্গেরীতে যে কঠোর আইন হয় তা আজও বহাল আছে।
ব্রিটেনে গণতন্ত্র চর্চার ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। তবে করোনা সংকটের কারণে সংসদে তড়িঘড়ি করে নতুন যে আইন পাস হয়েছে। এতে লোকজনকে অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বন্দি ও আইসোলেশনে রাখা যাবে। বিক্ষোভ ও জনসভা করাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ব্রিটেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকুক সংসদে আইনটি উত্থাপনের সময় বলেছেন, এটা হবে ক্ষণস্থায়ী এবং হুমকির মাত্রানুসারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ৩৪০টি পৃষ্ঠার আইনটি নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক প্রয়োজন হলেও অনেক সংসদ সদস্য পুরো আইনটি পড়ে দেখার সময়ই পাননি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা সংকট নিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা স্বৈরশাসকদের থামাতে হবে গণতান্ত্রিক বিশ্বকেই। নাহলে করোনা-উত্তর বিশ্বে আমরা আরও বেশি রাজনৈতিক বন্দী দেখতে পাব। দেখব আরও বহু নেতা আজীবনের জন্য প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ সুগম করেছেন। উন্থান হবে আরও বেশি স্বৈরাচারের। গণতন্ত্রকামী দেশগুলোকে একই সঙ্গে করোনা মহামারি এবং স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। এটা অসম্ভব কিছু নয়। যেমন জার্মানি, কানাডা ও দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার দেখিয়েছে কিভাবে করোনার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হয়। অথচ সেখানে প্রাণবন্ত রাজনৈতিক বিতর্কে কোপ পড়েনি। অন্যরাও তাদের পথ অনুসরণ করতে পারে।