করোনা নিয়ে বিশ্বের কী অবস্থা, সে কথা আজ বলাটাও বাড়াবাড়ির মতোই শোনায়। সবাই জানেন, করোনায় বিশ্বব্যাপী আধা লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে এবং প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আক্রান্ত হয়েছে এবং হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। সব মিলিয়ে মানুষের মাঝে তৈরি হয়েছে এক ধরনের তীব্র আতঙ্ক। এ আতঙ্কের চাপ গিয়ে পড়েছে দোকানে, বিপণীতে। মানুষ সেলফ কোয়ারেন্টিনে যাওয়ার আগে পাগলের মতো কেনাকাটা করছে। তারা প্রয়োজনের চাইতেও অনেক বেশি করে কিনছে অপচনশীল খাদ্যপণ্য, টয়লেট পেপার ও স্যানিটাইজার আর বাড়িতে মজুদ করছে। আর এ ''হুজুগে কেনাকাটার'' কারণে অনেক বিপণীতে দেখা দিয়েছে পণ্যসঙ্কট। গরীব দেশ তো বটেই, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশও এমন সঙ্কটের বাইরে নয়।
দুনিয়াব্যাপী এমন প্যানিক বায়িং বা হুজুগে কেনাকাটার মধ্যে ব্যতিক্রম কেবল একটি দেশ - ইরান। এমনিতে আজ বহু বছর ধরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চাপে পড়ে দেশটি পিষ্ট প্রায়। আর ওপর করোনার মূলভূমি চীনের বাইরে যে দু'টি দেশ করোনায় সবচাইতে বেশি আক্রান্ত, তার একটি হলো ইরান। অপরটি হলো ইতালি। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া হিসাব অনুযায়ী দেশটিতে এ পর্যন্ত করোনায় মৃতের সংখ্যা দেড় হাজার ছুঁই ছুঁই করছে।
ইতালির মতো দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করেনি ইরান, তবে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের তরফ থেকে নাগরিকদের বলা হয়েছে সেলফ কোয়ারেন্টিনে চলে যেতে এবং প্রয়োজনে বের হলেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করতে।
ইরানে করোনা এমন এক সময় হানা দিল যখন দেশটিতে নওরোজ বা নববর্ষ এবং বসন্ত কালের শুরু। এ উপলক্ষে ওই দেশে দুই সপ্তাহ ছুটি থাকে আর ওই ছুটিতে লোকজন আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে কিংবা দূরে কোথাও বেড়াতে যায়। ইরানের একটি ঐতিহ্য হলো, বসন্তকাল এলে তারা বাড়িঘর সাফসুতরো করে আর বিশেষ ধরনের খাদ্যদ্রব্য ও কুকিজ কেনে। এবারও তা-ই হয়েছে। কিন্তু অবাক করার মতো হলেও সত্য যে, পশ্চিমা বিশ্বের মতো দোকানে দোকানে উন্মত্ত ক্রেতার ভিড় দেখা যায়নি। ইরানের রাজধানী তেহরানের একটি চেইন স্টোরের সামনে দাঁড়িয়ে সে কথাই বলছিলেন ফাতিমেহ নামের এক নারী ক্রেতা। তাঁর কথা, লোকজন আগে যেমন করতো এখনও ঠিক সে রকম কেনাকাটাই করছে। বাড়তি কিছু কিনছে না কেউ।
তবে এটা ঠিক, সেলফ কোয়ারেন্টিনের কারণে এবার ইরানের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বর্ণাঢ্য নওরোজ বা নববর্ষ উৎসব হয়নি। তারা এবার ঘরেই বন্দী ছিল, আত্মীয় স্বজনের বাড়ি কিংবা আকর্ষণীয় কোনো পর্যটন স্পটে যায়নি বেড়াতে। গত বছরের তুলনায় এবার সড়ক-মহাসড়কে যান চলাচল ছিল অনেক কম। তবে এটাও ঠিক, করোনা সংক্রমণের শুরুর দিনগুলোতে মানুষজন করোনার হাত থেকে বাঁচার আশায় এক শহর থেকে অন্য শহরে কিংবা একই শহরের এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় দলে দলে পালিয়ে বেড়িয়েছে।
একদিকে করোনার হানা, অন্যদিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চাপে প্রায় -ভঙ্গুর অর্থনীতি আর গত ফেব্রূয়ারি মাস থেকে প্রতিবেশীদের সাথে সীমান্ত বন্ধ - সব মিলিয়ে ইরান নামের দেশটিরই তো কোয়ারেন্টিনে যাওয়ার কথা। দম বন্ধ হয়ে মরার কথা।
বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, যা ভাবছেন ইরানের অবস্থা ঠিক তার বিপরীত। দেশটির অবস্থা এতোটাই স্বাভাবিক যে, তা দেখে হতভম্ব হয়ে গেছেন ইরানে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত বব ম্যাকেরে। নিজের বিস্ময়টা গোপন না করে ১৪ মার্চ তিনি টুইটারে একটি ছবি পোস্ট করেছেন, যাতে তেহরানের একটি দোকানে যথেষ্ট টয়লেট পেপার দেখা যায়। ছবির নিচে তিনি লিখেছেন, তোমরা যখন ভেবে মরছো, তখন আজ আমি তেহরানে কেনাকাটা করলাম।
পরদিন ১৪ মার্চ কেনাকাটা করতে যান তেহরানের এক বাসিন্দা মোস্তফা। তিনিও বাজারে কোনো জিনিসের ঘাটতি দেখেননি। একটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক তাঁর কাছে জানতে চান তিনি কেন বাড়তি জিনিস কিনছেন না। জবাবে মোস্তফা বলেন, কী দরকার? বাড়তি জিনিস কী কাজে লাগবে? বাজারে নিত্যপণ্য আছে এবং আমি মনে করি, থাকবে। কাজেই হুজুগে মাতার কোনো দরকার নেই।
একই প্রশ্ন করা হয়েছিল ঐতিহাসিক ইসফাহান নগরীর বাসিন্দা এক নারীকে। ফারিবা নামের ৫৫ বছর বয়সী এ নারী বলেন, আমরা সেলফ কোয়ারেন্টিন থেকে এক দিন বের হয়ে ১০ দিনের জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যাই। আমরা বাড়িতে সব জিনিসের মজুদ গড়তে চাই না। সবাই এ রকম করলে অন্যেরা জিনিস্পত্র পাবে কোথায়?
ইরানি জনগণের এমন মনোভাবে চমৎকৃত হন সাংবাদিকরা। তারা এবার কথা বলেন দেশটির প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর তাঘি আজাদারমাকি-র সঙ্গে।। জানতে চান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া হয়ে সব উন্নত দেশের মানুষজনই যখন করোনার ভয়ে পাগলপারা হয়ে কেনাকাটা করছে, তখন ইরানীরা এতটা স্বাভাবিক থাকছে কিভাবে?
সমাজবিজ্ঞানী আজাদারমাকি বলেন, গত ৪০ বছরে ইরানীরা কতো রকম ঘটনাই তো দেখেছে! কতো কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলাই না করেছে! এসব অভিজ্ঞতা তাদের বুঝতে শিখিয়েছে কোন ঘটনার পরিণাম কী এবং কিভাবে তা মোকাবিলা করতে হবে। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার মতো সব উন্নত দেশের জীবন চলেছে স্বাভাবিক গতিতে। এই স্বাভাবিকতায় যখনই সম্ভাব্য কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতি বা করোনা মহামারীর মতো কোনো ধাক্কা এসে লেগেছে, তখনই তারা অস্থির হয়ে গেছে। এ সময় সবাই শুধু নিজের কথাই ভেবেছে, অন্যের কথা একটুও ভাবেনি।
অতীত ও বর্তমানের সব তিক্ত অভিজ্ঞতাই হয়তো ইরানিদের জন্য ইতিবাচক হয়ে দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে অন্তত অনলাইন খুব কাজে দিচ্ছে। অনলাইনে নানা রকম পজিটিভ ভিডিও ও টেক্সট সম্প্রচার জনগণের মনোবল উজ্জীবিত রাখতে সহায়তা করছে। এসব ভিডিওর কোনো কোনোটিতে শেখানো হচ্ছে কী করে নানা রকম হাতের কাজ করা যায়, কী করে রুটি বানানো যায়, মাস্ক তৈরি যায়। অনেক সোশ্যাল মিডিয়া করোনার দিনগুলোতে জনগণকে ঘরে থাকতে উৎসাহিত করছে। অনলাইনে এবং সরকারি টিভিতে স্কুলের ক্লাস নেয়া হচ্ছেন। তাতে শিশুদের স্কুলে যেতে না পারার ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন হলো করোনা মহামারী নিয়ে ইরানি ও পশ্চিমা জনগণের প্রতিক্রিয়া দু' রকম হলো কেন? আসলে ইরান ও পশ্চিমা দুনিয়ার সমাজকাঠামোর বড় ধরনের পার্থক্যই এর কারণ।পশ্চিমারা পরিবারপরিজন সব ছেড়ে একা থাকাই পছন্দ করে। ফলে কোনো কিছু কিনতে গেলে দেখা যায় বাড়ির সবাই গেছে। কিন্তু ইরানের সমাজ অন্য রকম। এখানেও সিঙ্গেল ফ্যামিলির প্রবনতা বাড়ছে, তারপরও ইরানের সমাজে কেনাকাটার মতো পারিবারিক বিষয়গুলো বাবা বা পরিবারের কর্তাই দেখাশনা করেন। সবাই হুড়মুড় করে একসাথে ছোটে না। পরিবারভিত্তিক সামাজিক জীবনই এ দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে।
অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলোতে সচরাচর পণ্য ও সেবা দেয় বড় বড় কম্পানিগুলো আর ইরানে তা পাওয়া যায় খুচরা বিক্রেতা ও ছোট ছোট দোকান থেকে। এসব খুচরা বিক্রেতা ও গ্রূপ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় একই পরিবারের সদস্য বা তাদের আত্মীয়স্বজন। ফলে অন্যরা ভাবে, অমুকের দোকান তো আছেই। চিন্তা কী?
ইরানের সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি রাজনৈতিক জীবনকেও পরিবারভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। বিপরীতে পশ্চিমা সমাজ হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। ইরানে যে কোনো সঙ্কটে পরিবারের ভূমিকা থাকে, অপরদিকে পাশ্চাত্যে কেউ কারো নয়। সবাই আলাদা এবং যে যার মতো।
ইরানের যখন এই অবস্থা তখন দেশটির বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করা দেশগুলোতেও চলছে হাহাকার। দোকান থেকে সব কিছু বিক্রি হয়ে গেছে। তিন সন্তানের মা ব্রিটিশ নারী জ্যানেট বাস করেন ম্যানচেস্টারে। তিনি সেদেশের একটি টিভি চ্যানেলকে বলেন, ব্রিটেনে যেদিন থেকে করোনা দেখা দিল সেদিন হতেই বাজার থেকে জীবাণুনাশক জেল, হ্যান্ড স্যনিটাইজার ও টয়লেট পেপার মোটামুটি উধাও হয়ে গেল। একই ঘটনা ঘটলো আটা, চাল, টিনজাত খাদ্য আর পাস্তার-র বেলায়ও।
প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সন্ধানে একের পর এক চেইন স্টোরে গিয়ে খালি তাক দেখে কেমন হতবাক হয়েছেন, সে কথা বর্ণনা করে ৫৮ বছর বয়সী জ্যানেট বলেন।, ১৮ মার্চ আমি বেরিয়েছিলাম দুধ ও রুটি কিনতে। কিছুই পেলাম না। সব দোকানের তাক খালি। অন্যরকম এক ভয়ে আমার শরীর যেন জমে গেল। আমার মনে হলো যেন দুর্ভিক্ষ আসছে। আমি ওদের কাছে জানতে চাইলাম কখন এলে জিনিসপাতি পাওয়া যাবে? ওরা বললো, খুব ভোরে এসে লাইনে দাঁড়াবেন। তাহলে কিছু পেতে পারেন। নইলে সদাই যা আসে তা তখন-তখনই ফুরিয়ে যায়।
এ অবস্থা যে শুধু ব্রিটেনের, তা নয়। একই অবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া হয়ে সব উন্নত দেশেরই। মজার কাণ্ড হলো, প্যানিক বায়িং বা হুজুগে কেনাকাটার খবরটি ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই অস্ট্রেলিয়ায় অন্যান্য জিনিসের পাশাপাশি বিশেষ করে কোন জিনিসটি কেনার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, জানেন? টয়লেট পেপার।