প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস ল-ভ- করে দিচ্ছে বিশ্বকে। প্রতিদিন মারা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। দৈনিক আক্রান্ত হচ্ছে প্রায় এক লাখ লোক। করোনার কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জীবনযাত্রা। থমকে গেছে মানবসভ্যতা। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশগুলোও অদৃশ্য এই ভাইরাসের কাছে চরম অসহায় হয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, ইরান, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। অন্যদিকে জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, হংকং, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, কিউবা, শ্রীলংকা, তুরস্ক, নেপাল, ভুটান সফলতার সাক্ষর রেখেছে।
করোনা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটছে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, ইরান, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে।
এসব দেশে এত মানুষের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। জানা গেছে, এসব দেশে বেশি মৃত্যুর পেছনে নানা কারণ রয়েছে। এর মধ্যে আছে সংকটের ভয়াবহতা বুঝতে বিলম্ব, পূর্ব-প্রস্তুতিতে উদাসীনতা, ব্যাপকহারে করোনা টেস্ট না করা ও অপ্রতুল স্বাস্থ্য সেবা। এছাড়া এসব দেশে বিপুল সংখ্যক প্রবীণ মানুষের বসবাসও সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বাড়ার বড় কারণ।
ইতালিতে বিপুল সংখ্যক প্রবীণ মানুষের বাস সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ার একটি বড় কারণ। সেখানে সীমিত সংখ্যক মানুষের করোনা পরীক্ষাও একটি বড় কারণ।
অন্যদিকে স্পেনে দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা ও করোনায় পরীক্ষার সংকটকে মৃত্যুর বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশটিতে আক্রান্তের যে সংখ্যা বলা হচ্ছে সেটি হয়তো প্রকৃত সংখ্যা নয়। আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। করোনায় আক্রান্ত অনেকেই হয়তো পরীক্ষার বাইরে রয়ে গেছে। দেশটিতে শুধু গুরুতর অসুস্থদেরই পরীক্ষা করা হচ্ছে। ফলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মধ্যে এমন বৈসাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে। সারাবিশে^ করোনায় ৫ শতাংশের কম মানুষের মৃত্যু হলেও ইতালিতে এ হার ১০ শতাংশেরও বেশি।
অন্যদিকে ইতালিতে বিপুলসংখ্যক প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বাসও মৃত্যু বাড়ার একটি বড় কারণ। জাপানের পরই বিশে^ সবচেয়ে বেশি প্রবীণের বাস ইতালিতে। ইতালির স্বাস্থ্য মšúণালয় জানায়, দেশটি করোনায় মৃতদের গড় বয়স ৭৮ বছর। অনেক প্রবীণ করোনাভাইরাসের মতো একটি রোগের ধাক্কা সামলাতে পারেননি।
স্পেনে বেশি মৃত্যুর কারণ নি¤œমানের জনস্বাস্থ্যসেবা ও রোগ নির্ণয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে সম্পদের অভাব। ইউরোপের রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বলেছে, একটি দেশের প্রস্তুতির মাত্রা ও দ্রুত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর কভিড-১৯-এর প্রভাব নির্ভরশীল। যদি সংক্রমণের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায় এবং এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মানবসম্পদ ও সরঞ্জাম পর্যাপ্ত না থাকে, তাহলে এর প্রভাব হবে ভয়ানক। স্পেনে এটাই ঘটেছে।
কর্ডোভা ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ও গবেষক হোসে হার্নান্দেজ বলেন, স্পেনে জরুরি অবস্থা জারির আগে করোনা বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার তেমন দেখা যায়নি। জরুরি অবস্থা জারির আগে মানুষের একটি বিরাট অংশের মধ্যে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি বিষয়ে তেমন ধারণাই ছিল না।
করোনা মোকাবিলায় কোনো পূর্ব প্রস্তুতি নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সরকারও। দুই দেশই শাসন করছেন উগ্র জাতীয়তাবাদী দুই নেতা। তারা অন্যের মতামতকে খুব কমই গুরুত্ব দেন।
যুুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরুতে এ সংকটকে মোটেও গুরুত্ব দেননি। তিনি এমনও অভিযোগ করেছেন যে ডেমোক্রেটরা এ সংকটকে বড় করে দেখাচ্ছে। এখন অবশ্য তিনি ভোল পাল্টেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা পূর্বাভাস দিয়েছেন যে দেশটিতে ১ লাখ থেকে ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা যাবে করোনায়। ট্রাম্প এ তথ্য মেনে নিয়ে বলেছেন, মৃত্যু লাখের মধ্যে রাখতে পারলেই তিনি খুশি। তার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইতালির পথেই হাটছে।
যুক্তরাজ্যেও সংকট গভীরতর হচ্ছে। যুক্তরাজ্য সরকার বলেছে, সেখানে মৃত্যু ২০ হাজারের মধ্যে রাখতে পারাটাই হবে সফলতা।
মৃত্যুহার সর্বনি¤œ রাখার ক্ষেত্রে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়া। এ দুই দেশে করোনায় মৃত্যুহার ১ শতাংশেরও কম। ইউরোপের বড় বড় দেশের মধ্যে জার্মানিতে মৃত্যুহার সবচেয়ে কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর অন্যতম কারণ নিবিড়ভাবে করোনা পরীক্ষা। জার্মানি অনেক আগে থেকেই ব্যাপক হারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে। এমনকি কারও মধ্যে করোনার মৃদু উপসর্গ দেখা দিলেও পরীক্ষার আওতায় আনা হয়েছে। ফলে দেশটিতে করোনায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা প্রকৃত সংখ্যার কাছাকাছি। দক্ষিণ কোরিয়ায়ও একই অবস্থা।
জার্মানির স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতাও অনেক বেশি। এখানে নিবিড় পরিচর্যার সক্ষমতা ফ্রান্স, ইতালি ও যুক্তরাজ্যের মতো ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর চেয়ে বেশি। জার্মানিতে বর্তমানে যত গুরুতর অসুস্থ করোনা রোগী রয়েছে, তার চেয়েও বেশি লোককে চিকিৎসার সামর্থ্য রয়েছে দেশটির। এ কারণে ইতালি ও ফ্রান্স থেকে করোনা রোগী নিয়ে জার্র্মানিতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে করোনা রোগী জার্মানির এক-তৃতীয়াংশ, অথচ মারা গেছে জার্মানির চেয়ে তিন গুণ মানুষ।
জার্মানি প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে রক্ষায়ও দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। করোনা সংক্রমণ শুরু হতেই জার্মানিতে প্রবীণদের চলাচলে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎও নিষিব্দ করা হয়। এর ফলে রোগটি প্রবীণদের মধ্যে কম ছড়িয়েছে। জার্মানির মোট জনসংখ্যার ৭ ভাগের বেশির বয়স ৮০ বছরের ঊর্ধ্বে হলেও আক্রান্তদের মধ্যে এই বয়সী মাত্র ৩ শতাংশ।
জার্মানির চিকিৎসাসেবারও সম্প্রতি আধুনিকায়ন করা হয়েছে। চিকিৎসাকর্মী বাড়ানো হয়েছে, অর্থায়নও বেড়েছে। এমনও হয়েছে যে, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর গুরতর অসুস্থ রোগীকে ৩০ দিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে ইতালি ও স্পেনে অনেক সংকটাপন্ন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাই সম্ভব হয়নি।
চীনের পরপরই করোনাভাইরাস যে দেশটিতে সবচেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তার নাম দক্ষিণ কোরিয়া। তবে কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। এ জন্য চীনের মতো কড়া পদক্ষেপও নিতে হয়নি সিউলকে। এমনকি দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে সংক্রমিত এলাকা দায়েগুকেও লকডাউন করা হয়নি। দক্ষিণ কোরিয়ায় মৃতের হার ১ দশমিক ৬ শতাংশের কিছুটা বেশি। সারাবিশে^ করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৫ শতাংশ মানুষের। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো মৃত্যুর হার এখনও কম তুরস্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্যের মূলে রয়েছে দেশটির চমৎকার স্বাস্থ্যসেবা, ব্যাপক হারে করোনা পরীক্ষা ও আইসোলেশনে রাখা এবং আক্রান্তদের চিকিৎসা। এর আগে দেশটি সার্স ও মার্সের মতো মহামারির শিকার হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতাও কাজে দিয়েছে তাদের।
চীনে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই গত ১১ জানুয়ারি থেকে পরীক্ষা শুরু করে দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটিতে করোনায় আক্রান্তদের পৃথক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ফলে অসুস্থদের মাধ্যমে সংক্রমণ তেমন ছড়াতে পারেনি।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়া যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে করোনা পরীক্ষা করেছে, তা অসাধারণ। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশেই টেস্টের হার কম। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হচ্ছেন না। এতে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। উপসর্গ পাওয়া গেলেই পরীক্ষা করাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
একই অবস্থা কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশি কানাডায় করোনার সংক্রমণ এখনও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। করোনা রোধে দেশটির জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর পদক্ষেপ দেশ বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকলেও অস্ট্রেলিয়াতেও করোনা মহামারি রূপ নিতে পারেনি। এছাড়া সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ও হংকংয়ের করোনা নিয়ন্ত্রন করা গছে। । চীনের প্রতিবেশি এসব দেশে করোনা একেবারেই নিয়ন্ত্রণে। চীনের কারোনা শনাক্ত হওয়ার পরই তারা ত্বরিত পদক্ষেপ নেয়। ফলে এসব দেশে এখনও জীবনযাত্রা অনেকাংশে স্বাভাবিক।
চীনের মতো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন ছাড়াই অনেক দেশ সফলতা পেয়েছে। এসব দেশ যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- ভ্রমণে কড়াকড়ি, সন্দেহভাজনদের কোয়ারেন্টাইন এবং সামাজিক যোগাযোগ কমানো, যেমন :সেলফ আইসোলেশন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি উন্নয়ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পদক্ষেপ এখন অন্যান্য দেশও নিচ্ছে। তবে এরই মধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এখন এ ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু চীনে সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর তারা দু'মাস সময় পেয়েছিল। তাদের ভাবটা ছিল এমন যে চীন তো বহু দূরে, আমাদের কিছুই হবে না।
গত ৩১ ডিসেম্বর চীন রহস্যজনক ভাইরাসের সংক্রমণের তথ্য জানানোর তিন দিনের মাথায় সিঙ্গাপুর, হংকং ও তাইওয়ান সীমান্তে স্ক্রিনিং জোরদার করে। এক ধাপ এগিয়ে তাইওয়ান উহান থেকে আসা বিমানযাত্রীদের বিমানেই পরীক্ষা শুরু করে দেয়। পরে বিজ্ঞানীরা জানান, দৃশ্যমান উপসর্গ না দেখা গেলেও সংক্রমিত ব্যক্তির মাধ্যমেও করোনা ছড়াতে পারে। ফলে টেস্ট খুবই জরুরি।
দক্ষিণ এশিয়ার বড় দুই দেশে ভারত-পাকিস্তানে করোনা বিস্তৃত হল্ওে শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানে মৃত্য এখনও বেশ কম। অন্যদিকে নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ খুবই কম।
করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সাফল্য ও ব্যর্থতার কাহিনী শেষ করব আরেকটি সফল দেশের গল্প দিয়ে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে লকডাউন চললেও ব্যতিক্রম শুধু সুইডেন। এই দেশটিতে জীবনযাত্রা চলছে স্বাভাবিকভাবেই। কঠোর নিয়ম-কানুন না করে করোনাভাইরাস রোধে দেশটিতে দেওয়া হচ্ছে নানা নির্দেশনা। বলা হয়েছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে। সুইডেনের মানুষ এসব নির্দেশনা মেনেই স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে ।
সুইডেনের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ আশা করছে, কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ না করেও এ ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা যাবে। কঠোর নিয়ম না করেও দেশটিতে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। যেমন-অসুস্থ বা বয়স্ক হলে ঘরে থাকা, কিছুক্ষণ পরপর হাত ধোয়া, অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ না করা, বাড়িতে বসে কাজ করা। দেশটির বেশিরভাগ মানুষ এসব নির্দেশনা পালন করছেন। সুইডেনে সরকারি কর্তৃপক্ষের ওপর মানুষের আস্থাও অনেক বেশি।
সুইডেনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য এ ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির বেশিরভাগ বাড়িতেই একজন বাসিন্দা বাস করেন। এর ফলে পরিবারেও ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা কম। তা ছাড়া নাগরিকদের বেশিরভাগই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। সুতরাং তাদের মধ্যে ব্যাপক হারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও কম।