আক্রমণের শুরুর দিকেই কাবু হয়ে যেতে থাকে দক্ষিণ কোরিয়া। চীনের ওহান থেকে আসা করোনা ভাইরাস দ্রুত ছড়াতে থাকে দেশটিতে। স্বাভাবিক হিসাবে এতোদিনে দক্ষিণ কোরিয়ায় নরক নেমে আসার কথা! কিন্তু এই প্রতিবেদন তৈরি করা পর্যন্ত দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ৪৩২। এদের মধ্যে সুস্থ্য হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন ৬ হাজার ৯৭৩ জন। আর মৃত্যু হয়েছে মাত্র ২০৪ জনের। বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় সেখানে সংক্রমণের চাইতে মৃত্যুর হার অনেক কম।
দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার জানাচ্ছে, এর পেছনের কৃতিত্ব জং ইউন কিং নামের এক নারীর। তিনি দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের প্রধান। মহামারি করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করে সফলতার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার এই নারীকে জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই বীর কী করে লড়াই করে পরিস্থিতি উত্তরণ করেছেন। এখন দক্ষিণ কোরিয়ার কোথাও লকডাউন নেই। এর আগেও কোনো এলাকা আনুষ্ঠানিক লকডাউন করা হয়নি। অনেকটা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চলছে দেশটিতে। অনেক প্রতিষ্ঠান-ই খোলা রয়েছে। কর্মীরা সতর্ক থেকে কাজ করছেন।
আর এজন্যই দেশটির নাগরিকরা জং ইউন কিংকে জাতীয় বীর হিসেবে দেখছেন। কারণ তিনি সতর্ক ছিলেন গোড়া থেকেই। ডিসেম্বরে চীন দেশের উহানে দেখা দেয় করোনার প্রকোপ। দক্ষিণ কোরিয়ায় এই রোগটির নাম-গন্ধ তখনো নেই। কিন্তু সেই সময় থেকেই কাজে নেমে গিয়েছিলেন ইউন কিং। তিনি তখন থেকেই বৈশ্বিক পরিস্থিতির ব্যাপারে দিনে দুইবার করে ব্রিফ দিতে শুরু করেন। দেশের নাগরিকদেরকে দিতে থাকেন স্বাস্থ্য সতর্কতা।
জানুয়ারি মাসটাও কাটে শঙ্কা আর সতর্কতার মধ্য দিয়েই।
ফেব্রুয়ারিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে দ্বিতীয় মৃত্যুতে দেশটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। দক্ষিণের শহর দেয়াগো ও চেয়োংদোকে রাখা হয় বিশেষ নজরদারিতে। দেয়াগোর বিপনীবিতান, সিনেমা হল বন্ধ রাখা হয়। সীমিত করে দেওয়া হয় গণপরিবহন। এতে এই শহরদুটোর সড়ক মোটামুটি ফাঁকা হয়ে যায়। দেশের অন্যান্য শহরে চলতে থাকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
দেয়াগো ও চেয়োংদো শহরদুটোতেই প্রথমে প্রবেশ করে করোনা ভাইরাস। ওই অঞ্চলে শিনচিওঞ্জি নামে ক্ষুদ্র একটি খৃস্টান সম্প্রদায়ের বাস। তাদের শরীরেই ধরা পরে রোগটি। প্রথমে একজন, দুইজন করে কয়েকশ আক্রান্তর খোঁজ পাওয়া যায়। পরে ছড়াতে থাকে অন্য এলাকাতেও। কিন্তু তখনো এই দুই শহরে আক্রান্তর সংখ্যা অর্ধেকের চাইতেও বেশি।
শহর দুটোতে চলতে থাকে উৎসের সন্ধান। সরকারি লোকেরা অলি-গলি চষে বেড়াতে থাকেন। একজন আক্রান্ত’র খোঁজ পাওয়া গেলে তার সংস্পর্শে আসা লোকদের ওপর নজরদারি করা হয়। ধারণা করা হয়েছিলো ওই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতার ভাইয়ের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে কয়েক হাজার লোক জড়ো হয়েছিলেন। সেখান থেকেই সম্প্রদায়টি ঝুঁকির মুখে পড়ে।
এই ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেতে হলে চাই দ্রুত পদক্ষেপ। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার যে পদক্ষেপ নিলো, তা কোনো দেশকে অনুসরণ করে নয়। এমনকি চীনের দেখানো পথেও তারা হঁটেনি। দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হাঁটতে থাকে কার্যকর পথে।
শুরুর দিক থেকেই তারা আক্রান্তর তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে। আর জোর দেয় ব্যাপক পরীক্ষার ওপর। সরকার ঘোষণা দেয়, যে কেউ চাইলে পরীক্ষা করাতে পারবে, এতে কোনো খরচ বহন করতে হবে না। এই ঘোষণার পর কারো সন্দেহ হলেই পরীক্ষা করিয়ে নিতে থাকে নাগরিকরা। পরীক্ষাগুলোও চলতে থাকে দ্রুত সময়ে। করোনা শনাক্তের জন্য যেসব অস্থায়ী পরীক্ষাগার তৈরি করা হয়েছে, এগুলোতে প্রবেশ করা যায় গাড়ি নিয়ে।
গাড়িতে বসে থাকা অবস্থায় রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা যায়। ফলাফল পাওয়ার পর খুব দ্রুততার সঙ্গেই আক্রান্ত রোগিকে আলাদা করে ফেলা হচ্ছে। এসব ল্যাবে মোবাইল অপারেটররা দিচ্ছে উচ্চগতির ৫জি ব্যান্ডউইথ। সড়কে গাড়ি চালিয়ে যেতে থাকলে, তিনি নোটিফিকেশনের মাধ্যমে জেনে যাচ্ছেন আশপাশে কোথায় পরীক্ষাগার আছে। বড় দালানে কোনো করোনা আক্রান্তের আবাস বা কর্মস্থল হলে সেখানে স্থাপন করা হচ্ছে অত্যাধুনিক সব সুবিধার মোবাইল হাসপাতাল। এতে পুরো বিল্ডিংয়ে যত মানুষ থাকেন সহজে তাদের সবার করোনা পরীক্ষা করা যাচ্ছে।
অন্যদিকে সরকারি দপ্তরগুলো সক্রিয় হতে থাকে নিজেদের অবস্থান থেকে। শুরু হয় মহাকর্মযজ্ঞ। সব সেক্টর থেকে আসতে থাকে তথ্য। আক্রান্ত ব্যক্তির ক্রেডিট কার্ডের তথ্যগুলো সরবরাহ করা হতে থাকে সরকারি ওয়েবসাইটগুলোতে। এতে ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার হতে পারে শঙ্কায় শুরুর দিকে এই পদক্ষেপে অনেকের আপত্তি ছিলো। কিন্তু দ্রুত সময়ের মধ্যে ভালো ফল আসতে শুরু করায় এই আপত্তিটাও জোরালো হয়ে উঠতে পারেনি।
অল্পদিনের মধ্যেই সরকারি ওয়েবসাইটগুলো করোনাসংক্রান্ত তথ্যে ভরে উঠে। এর পর থেকে এসব তথ্যের ভিত্তিতে প্রাপ্ত সতর্কতা চলে যেতে থাকে সাধারণের কাছে। যখনই কেউ আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সেই তথ্য চলে যাচ্ছে তার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা লোকদের কাছে। আক্রান্তদের বাড়ি, অফিস, এলাকা এবং আত্মীয়রা নোটিফিকেশন পেয়ে যাচ্ছেন। এই নোটিফিকেশন পৌঁছাতে ব্যবহার করা হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় বানানো কিছু অ্যাপ্লিকেশন।
এসব অ্যাপ্লিক্যাশন ব্যক্তির ভ্রমণ ডিটেইলস, বিগত কয়েকদিনের কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করে। পরে একটি ম্যাপ তৈরি করে। অ্যাপ্লিকেশনের তৈরি করা ম্যাপ এবং এর কাছাকাছি এলাকার লোকেরা সময়ে সময়ে পেতে থাকেন সতর্কবার্তা। এই বার্তাকে এতোটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, ওই সময় কেউ যদি মোবাইল ফোনে কথা বলতে থাকেন তখন তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে এই নোটিফিকেশন পৌঁছাবে।
মোবাইল নোটিফিকেশনের মাধ্যমে সরকারি চিকিৎসা পরিসেবা সংস্থার কাছেও করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি গত দুএক সপ্তাহ কোথায়, কার সঙ্গে মিশেছেন এসব তথ্য চলে যাচ্ছে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করা বা সময় কাটানো বন্ধু-পরিজন বা সহকর্মীদেরও সহজেই পরীক্ষার আওতায় আনা যাচ্ছে।
তথ্য পর্যালোচনা করে ক্রত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বা বলে দিচ্ছে সম্ভাব্য কোন স্থানের মানুষের করোনা আক্রান্তের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। সেই অনুযায়ী এলাকাগুলোতে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে এবং সতর্কতার অংশ হিসেবে প্রতিরোধের আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
শুরুর দিকে , সেনাদস্যর শরীরেও চিহ্নিত হয় ভাইরাস। শুরু হয় দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের তোড়জোর। সেনা ঘাঁটিগুলো বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। তারপরও প্রকোপ ঠেকানো যায়নি। কয়েকদিনের মধ্যেই রোগটি ছড়িয়ে যায় শত শত লোকের শরীরে। দেশটিতে ঘোষণা করা হয় জরুরি অবস্থা। দেশজুড়ে ছড়ায় আতঙ্ক। রাজধানী সিউলে নেমে আসে নীরবতা। এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে।
মাস্ক এবং অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম বিতরণের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হচ্ছে প্রযুক্তি। শুরুর দিকে এসব ব্যবস্থাপনায় কিছু অসামঞ্জস্য দেখা দিলেও দ্রুত সময়ের মধ্যে সবকিছু সামলে ওঠে সরকার। আইডি কার্ড দিয়ে কাছের ওষুধের দোকান থেকে দুটি মাস্ক কেনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে মানুষকে। এসব ব্যবস্থাপনার কারণে গোটা করোনার সময়টাতেও দেশটির রাজধানীতে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্যের অভাব দেখা দেয়নি। এমনকি ওসবের দাম পর্যন্ত বাড়েনি।
দক্ষিণ কোরিয়ার করোনা মোকাবেলায় গোটা প্রক্রিয়া নিপুণভাবে চলতে থাকে, দেশটিতে আক্রান্তর সংখ্যা কমতে থাকে। আর আক্রান্ত হলেও তড়িৎ চিকিৎসা দেওয়া হতে থাকে। এতে মৃত্যুর হার সামলে রাখা সম্ভব হয়েছে। এর বাইরে, কারো হাঁচি-কাশিসহ অন্য কিছু উপসর্গ দেখা দিলেই তার পরীক্ষা করানো হয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার করে করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা চালিয়েছে দেশটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগীদের দ্রুত শনাক্ত করতে পারায় সংক্রমণের কেন্দ্রস্থলে নতুন সংক্রমণ ঠেকাতে পেরেছে দেশটি।
পরীক্ষার ক্ষেত্রেও চমক দেখিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। সারা দেশে পাঁচ শতাধিক পরীক্ষাগারে রোগীদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার কীট আবিষ্কার করেন নিজস্ব বিজ্ঞানীরাই। ২০১৫ সালে চীনে যখন সার্স ভাইরাসের প্রকোপ হয়, তখন পরীক্ষার কীট সঙ্কটে ভুগছিলো দক্ষিণ কোরিয়া। সেই শিক্ষা থেকে শুরুর দিকেই কিট তৈরির উপায় বের করার ওপর জোর দেয় সিউল। এতে শুরুর দিকেই সফল হন বিজ্ঞানীরা।
দেশটির সরকার আশা করছে, আগামী কিছুদিনের মধ্যেই গোটা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। ফিরিয়ে আনা যাবে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এমনকি কিছুদিনের মধ্যে স্কুল খুলে দেওয়ারও পরিকল্পনা করছেন তারা।