করোনা মহামারীর কারণে আলোচনা থেকে প্রায় -হারিয়ে গেলেও আফগানিস্তানে বিশ্ব শান্তির ক্ষেত্রে বাস্তবিকই একটি বড় পদক্ষেপ বলেই মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। এ চুক্তির ফলে একটি অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্টিত হলেও কার্যত তা বৈশ্বিক রাজনীতির ওপরই প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন তাঁরা। চলতি বছরের ২০ ফেব্রয়ারি স্বাক্ষরিত চুক্তিতে সই করেন তালিবান প্রতিনিধি আবদুল গনি বারাদার এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও।
মার্কিন যুক্তরষ্ট্রের পক্ষ থেকে যা বলা হচ্ছে , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আফগানিস্তানে চলমান সংঘাত নির্মূল করতে। সে জন্যই এ চুক্তি। দেখা যায়, চুক্তিটির রয়েছে চারটি গুরুত্বপূর্ণ দিক - প্রথমত, কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্রদের নিরাপত্তা হানিকর কাজে আফগানিস্তানের ভূখন্ড ব্যবহার করতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, চুক্তিতে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর পূর্ণ প্রত্যাহারের একটা সময়সীমা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। তৃতীয়ত, তবে বিষয়টি নির্ভর করবে আন্ত আফগান সংলাপ এবং তালিবান ও কাবুল সরকারের মধ্যে আলোচনার ফলাফলের ওপর। চতুর্থত, এর ফলে একটি স্থায়ী ও ব্যাপকভিত্তিক যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠিত হবে।
চুক্তির আগে ব্যাপক সংশয় ছিল যে বাস্তবে তালিবানের সাথে সম্পর্ক জোড়া লাগানোর লক্ষ্যে এমন একটি চুক্তি করতে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কতোটা আন্তরিক। চুক্তির চারটি বৈশিষ্ট্য ওই সংশয় নিরসন করেছে। চুক্তিতে শুধু তালিবানকে স্বীকৃতিই দেয়া হয়নি, পাশাপাশি এ-ও বলা হয়েছে যে আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহার করে সেদেশের শান্তি বিপন্ন করার মতো কোনো তৎপরতায় যুক্তরাষ্ট্র অংশগ্রহণ করবে না বা সহ্যও করবে না। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী কর্মকান্ডও মেনে নেবে না।
চুক্তিতে উভয় পক্ষের জন্য সুবিধা যেমন আছে, তেমনি আছে সীমাবদ্ধতাও। এতে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য পুরোপুরি প্রত্যাহারে ১৩ মাস সময়সীমার প্রস্তাব করা হয়েছে। আরেকটি প্রস্তাব হলো, অভ্যন্তরীণ ও বহিঃ হুমকি মোকাবিলায় আফগান সরকারি সংস্থাসমূহ ও সামরিক বাহিনীকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে তালিবান। এর মধ্য দিয়ে একটি প্রতিষ্টান বা সংস্থা হিসেবে সন্ত্রাসবাদ দমনে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে সহায়তা করার ক্ষমতা পেলো তালিবান। এই স্বীকৃতি ও ক্ষমতা আফগান রাজনীতিতে তালিবানকে দেবে এক অন্যরকম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এখন তাদের কাঁধে দায়িত্ব চাপলো শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রক্রিয়াবে এগিয়ে নেয়ার। আশা করা হচ্ছে, এ উদ্যোগ দীর্ঘ মেয়াদে আঞ্চলিক সহযোগিতায় রূপ নেবে।
একটি প্রশ্ন অবশ্য থেকেই যায় তা হলো আফগানিস্তানে মার্কিন অনুপ্রবেশ কি কোনো প্রাজ্ঞ ও কার্যকর সিদ্ধান্ত ছিল? আজ প্রায় ১৯ বছর পরে এসে তার উত্তর মিললো। উত্তরটা হলো, কেবল মধ্যস্থতা ও আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই সমস্যার সমাধান সম্ভব এবং আফগান শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাঝ দিয়ে সেই ''সম্ভব''টা সম্ভব হয়েছে।
আফগান শান্তি চুক্তির একটি বড় লক্ষ্য হলো, মার্কিন সেনা কর্মকর্তাদের ওপর সন্ত্রাসবাদীদের নতুন হামলা এড়িয়ে যাওয়া। পূর্ণ প্রত্যাহারের আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন এ লক্ষ্যে একটি নীতি প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন করে যাওয়া। এ নীতির মধ্য দিয়ে আফগান সরকার ও তালিবানের পারস্পরিক অবিশ্বাস যেমন দূর হবে তেমনি উভয় পক্ষ ভবিষ্যতে পরস্পরকে সহযোগিতা ও সহায়তার পথ খুঁজে পাবে। তবে কাজটি সহজ নয় বলেই মনে করেন কেউ কেউ। এ রকম একজন মার্কিন জয়েন্ট চীফ অব স্টাফের সাবেক উপদেষ্টা কার্টার ম্যালকাসিয়ান। তিনি মনে করেন, সবকিছু পন্ড করে দেয়ার মতো অনেকেই তালিবানের ভেতরে আছে।
শান্তি প্রক্রিয়ার মূল পক্ষগুলোর মধ্যে এই অবিশ্বাস, এর কিন্তু কোনো মীমাংসা হয়নি এবং এ কারণে পুরো প্রক্রিয়াটি ভেস্তে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর তেমন কিছু হলে লাভ হবে তাদেরই, যারা আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায় না।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই দুর্বৃত্তরা যাতে শান্তি প্রক্রিয়া ছিনতাই করতে না পারে এ জন্য প্রথম যে পদক্ষেপটি নিতে হবে তা হলো পারস্পরিক আস্থা সৃষ্টি। তা করা গেলেই একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশে শান্তি প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
শান্তি চুক্তির মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্য-সংখ্যা ৮,৬০০তে নেমে আসবে। আর বহুজাতিক বাহিনীর অন্য দেশগুলো আফগানিস্তানের পাঁচটি সামরিক ঘাঁটি থেকে তাদের সৈন্য পুরোপুরি সরিয়ে নেবে। মার্কিন সৈন্য হ্রাসের প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়নে কিছুটা সময় নেবে বটে, তবে এটাকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্টার ক্ষেত্রে একটি বিরাট উদ্যোগ বলেই মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। শান্তি চুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে রাজবন্দীদের মুক্তি। এটা প্রধানত মার্কিন অঙ্গীকার। একে পারস্পরিক আস্থা সৃষ্টির একটি বড় উপাদান বলেই মনে করা হচ্ছে। এ আস্থা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা জোরদার করবে।
এবার তাকানো যাক আফগানিস্তানের প্রতিবেশী ও বন্ধু দেশগুলোর দিকে। প্রথমে আসা যাক পাকিস্তানের কথায়। আফগানিস্তানের সাথে রয়েছে পাকিস্তানের জাতিগত, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত বন্ধন। পাকিস্তান আশ্রয় দিয়েছে সর্বাধিক সংখ্যক আফগান শরণার্থীকে। প্রায় ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করে দিয়েছে কলা অনুষদ। পাশাপাশি ২০১৯ সালে আফগান শিক্ষার্থীদের দিয়েছে তিন হাজার বৃত্তি।
আফগান শান্তি চুক্তিতে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে মতপার্থক্য নিরসনের সুবিধা দিতেও সম্মত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ কাজেও পাকিস্তানের মিত্র তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। তাঁরা মনে করছেন, মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানে একটা 'পাওয়ার ভ্যাকুয়াম' তৈরি হতে পারে, যার সুযোগ নিয়ে স্বার্থান্বেষীরা ওই দেশের শান্তি , প্রগতি ও প্রবৃদ্ধি বিঘিœত করার কাজে নেমে পড়বে। এ ক্ষেত্রে তুরস্কের উপস্থিতি একটা ইতিবাচক দিক বলে বিবেচনা করা যায়।
এখন পাকিস্তান, তুরস্ক ও আফগানিস্তানের প্রয়োজন হলো, আফগান অর্থনীতি চাঙ্গা করার কাজে নিজেদের সম্পদ বিনিয়োগ করা। এ জন্য চাই আফগান জনসাধারণের মধ্যে আস্থা সৃষ্টির মিলিত উদ্যোগ। আফগান সরকারি সংস্থাগুলোর সাথে মিলিতভাবে বিভিন্ন অবকাঠামো গড়তে হবে আর কাবুল সরকারের সাথে নতুন নতুন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে ওই দেশে নতুন অর্থনীতি গড়ার কাজে সহায়তা দিতে হবে, যাতে আফগান সরকার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।
তুরস্কের সাথে আফগানিস্তানের বোঝাপড়া ও বন্ধুত্ব ঐতিহাসিক। এর কারণ দু'টি। প্রথমত, পরস্পর সীমান্ত সংলগ্ন না হওয়ায় তাদের মধ্যে কোনো ভূমি বিরোধ নেই। দ্বিতীয়ত, উভয় দেশ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। এছাড়া আফগানিস্তানে তুরস্কের রয়েছে দারুণ ইতিবাচক ইমেজ। বলা হয়, ''তুরস্কের গুলিতে এ পর্যন্ত কোনো আফগান নিহত হয়নি'' কিংবা ''তুরস্কে ট্রেইনিং নেয়া কোনো আফগান কখনো দেশের সাথে বেঈমানী করেনি''।
শুধু তুরস্ক নয়, ভারতের সাথেও ভালো বন্ধুত্ব রয়েছে আফগানিস্তানের। তবে তালিবান-মার্কিন শান্তি চুক্তি নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে আফগানিস্তানের এই বন্ধু দেশটির ভেতরে। সেসব প্রশ্ন যে একেবারে অযৌক্তিক, তা-ও নয়। তারা জানতে চায়, যে তালিবান সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত ছিল, ক্ষমতায় এসে তারা কিভাবে দেশে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে? গোটা প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানের অবস্থান কী? আফগানিস্তান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরে কেউ ঢুকে পড়বে না তো?
এসব প্রশ্নের মধ্য দিয়ে বোঝা যায় তালিবান-মার্কিন শান্তি চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারতের উদ্বেগ এবং তালিবানের প্রতি তাদের অবিশ্বাস কতটা গভীর। এদিকে ভারতের মিডিয়া দাবি তুলছে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর ভারত যেন আফগানিস্তানের ওপর নজরদারি বজায় রাখে। কিন্তু এ মুহূর্তে ভারতের যে অভ্যন্তরীণ অবস্থা, তাতে সীমান্তের বাইরে কোনো কিছুর দিকে নজর দেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। কিন্তু আফগানিস্তনকে ভারতের প্রয়োজন। কারণ, তাদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য হলো দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হওয়া।
এমন এক অবস্থায় সম্পাদিত হয়েছে তালিবান-মার্কিন শান্তি চুক্তি। রহস্যজনক হলো, শান্তি খেলার দুই গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ের মধ্যে চুক্তি হলেও আরেক খেলোয়াড় অর্থাৎ আফগান সরকারকে দৃশ্যপটে একেবারেই দেখা যাচ্ছে না। তাই চুক্তির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অনেকের মনে সংশয় তৈরি হয়েছে।
এ সংশয় অযৌক্তিক নয়। যেমন, চুক্তিতে রাজবন্দিদের মুক্তির প্রস্তাব করেছে যুক্তরাষ্ট্র। রাজবন্দীরা আছে আফগান সরকারের কারাগারে। তারা চুক্তির অংশ নয়। তাহলে তারা কেন রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে যাবে? আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি সে কথা বলেছেনও। আর তাঁর এ কথার পরপরই সরকারি বাহিনীর ওপর নতুন করে হামলা শুরু করে তালিবান। তারা বলে, রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়া না হলে সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা চলবে। তবে বহুজাতিক বাহিনীর ওপর আর হামলা চালানো হবে না।
এমন পরিস্থিতিতে আবারও যুক্তরাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে আফগানিস্তানের দুই গুরুত্বপূর্ণ শক্তিকেএকসাথে বসিয়ে তাদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টির কাজে। মোটের ওপর বলা যায়, আফগানিস্তানে শান্তি নিশ্চয়ই আসবে, তবে পথ এখনও বহু দূর।