করোনা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ঝাঁকুনি দিয়েছে। আবার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ভাবনায়ও আমূল পরিবর্তন আনতে চলেছে। ২০১৮ সালে ‘স্বাস্থ্য পরিচর্যা’য় বৈশ্বিক বাজারের আকার ছিল সাড়ে আট ট্রিলিয়ন ডলার। ২০২২ নাগাদ এটা ১১ ট্রিলিয়ন ডলার হওয়ার কথা ছিল। করোনাভাইরাসের পর ‘স্বাস্থ্য পরিচর্যা’ বাণিজ্যের আকার কেমন হবে সেটা অনুমান করাই কঠিন।
কোভিড-১৯ এর আগে স্বাস্থ্য পরিচর্যায় যখন ৮-১০ ট্রিলিয়ন খরচ হয় তখন বৈশ্বিক সম্পদ ছিল ৩২০ ট্রিলিয়ন ডলারের মতো। গড়ে স্বাস্থ্য খাতে খরচ ছিল সম্পদের ৩ ভাগ মাত্র। সম্পদ থাকা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য ‘সকল সুখের মূল’ হিসেবে গুরুত্ব পায়নি। এখন কিছুটা পাবে বলে আশা করা যায়। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আসন্ন বাড়তি ব্যয়টা কী আমরা স্বাস্থ্য-পরিচর্যা-বাণিজ্যের হাতে তুলে দিবো? নাকি আমাদের খাদ্যাভাস ও জীবনধারায় পরিবর্তন আনবো? এ প্রশ্নের সঙ্গে মিশে আছে পরবর্তী ভাইরাসযুদ্ধের ফলও। মানুষের খাদ্যাভাসে পরিবর্তন ঘটানো একালের বড় এক রাষ্ট্রনৈতিক কাজ। করোনা সেই শিক্ষাই জানাচ্ছে রাষ্ট্র ও সমাজকে।
করোনার মোকাবেলায় এ মুহূর্তে তহবিল উজাড় করে দিয়েছে পৃথিবী। বিভিন্ন দেশের তরফ থেকে বরাদ্দ শুরু হয়ে গেছে। খরচও শুরু হবে। খরচের মূল লক্ষ্য ব্যবসা-বাণিজ্যের ‘পুনর্বাসন’ এবং ভাইরাস সংক্রমণ থামানো। কিন্তু ভাইরাসের মূল কারণগুলোর দিকে আলো পড়ছে কমই। বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই বলছেন বিশ্বে ভাইরাস বাড়ার বড় কারণ খাদ্যাভাস, তথা ‘খাদ্যশিল্প’।
মনুষ্যখাদ্য বহুদিন থেকে কর্পোরেটদের পণ্য। বিশেষ করে আমাদের আমিষের উৎস মাছ-মাংস কারখানা জগতের বিরাট ‘আইটেম’ এখন।
কেন নতুন নতুন ভাইরাস নতুন শক্তি নিয়ে হাজির হচ্ছেÑ সেটা খুঁজতে গেলে কারখানায় তৈরি এসব ‘পণ্য’-এর দিকে মনযোগ না দিয়ে উপায় নেই। কৃত্রিমভাবে মাছ, মুরগী এমন এক মুখস্থ ফর্মূলায় তৈরি হচ্ছেÑ তারা কোন ভাইরাস সামাল দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চিরস্থায়ী খাঁচায় ভ্যাকসিন, হরমোন, স্বয়ংক্রিয় খাবারযন্ত্র আর কীটনাশকের মাঝে মুরগি-মাছ-শূকর-গরু-মহিষ বেড়ে ওঠে এখন।
এগুলো দ্রুতই ভোক্তার দেহে ভাইরাস সঞ্চারিত করতে পারে। কিংবা কমাতে পারে শরীরের ভাইরাসপ্রতিরোধী ক্ষমতা। লাখ লাখ মানুষের শরীরে যে আজকাল এন্টিবায়োটিক কাজ করছে নাÑ সেটা ইতোমধ্যে সামান্যই উদ্বেগ তৈরি করছে। অথচ খবরটি ভয়ংকর। বাংলাদেশেও কোটি কোটি মানুষের দেহ এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। যা আগামীতে চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য মহা এক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে চলেছে।
মাংস উৎপাদনকারী ফার্মগুলোর পুরো প্রক্রিয়াকে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখলে আমরা বুঝতে পারবোÑ আমাদের খাবার অভ্যাসের কৃত্রিমতা। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বড় করা শিল্পজাত ‘প্রাণী’দের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ, সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থাকে না। এভাবেই বড় হয়, বিক্রি হয় সেগুলো। কারখানা ও ‘বাজারেই অনেক সময় এরা পরস্পরের দেহে ভাইরাস ছড়ায়। ভাইরাস-প্রতিরোধী ওসব অক্ষম দেহই বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের ‘খাদ্য’। করেনা সামলানো তাই এক অর্থে ‘যুদ্ধ’ নয়Ñ যেমনটি বলছে সবাই। অনেকটাই মানুষের কর্মফল।
ইটালির ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউট তথ্য দিয়েছেÑ সেখানে কোভিড-১৯ এর কারণে ১৭ মার্চ পর্যন্ত যত লোক মারা গেছে তাদের ৯৯ ভাগের অন্য স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল। কারো কারো তিনটা পর্যন্ত উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ইত্যাদি রোগ ছিল। করোনার আগে নিরোগ দেহের অধিকারী ছিলেন মাত্র শূন্য দশমিক ৮ ভাগ মৃত।
এই মানুষগুলো কেন অসুস্থ ছিল? ঘুরে-ফিরে প্রধান কারণ চারটি: ফাস্ট ফুড, দূষণ, বহুবিদ মানসিক চাপ এবং শারীরিক অসাড়তা। এসব কারণগুলো এড়ানো যেত। শিল্প ও ব্যবসার স্বার্থের বিপরীতে যদি জনস্বাস্থ্য ও প্রকৃতি নীতিনির্ধারকদের কাছে প্রাধান্য পেতো তাহলো একালের প্রধান প্রধান রোগবালাই কমে যেতো। দশকের পর দশক আমরা প্রকৃতি ও প্রতিবেশের জন্য চরম দূষণীয় শিল্পগুলো চলতে দিয়েছি। কোভিড আমাদের খুন করতে চায় বলার চেয়ে এটা বলাই যুক্তিসঙ্গতÑ নানান রোগে আক্রান্ত একটা বিশ্ব সমাজকে আমরা প্রস্তুত করে রেখেছি তার আগমনের জন্য।
ইতালির সেসব অঞ্চলে করোনা সংক্রমণ বেশি হয়েছে যেখানে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু করোনার শ্বাসকষ্ট নিয়ে লেখায় ভুলেও বিশ্বজুড়ে বায়ুদূষণের সংকটের কথা আসছে না। ঢাকায় এখন শ্বাসকষ্ট নিয়ে কথা হচ্ছে খুবÑ অথচ বায়ু দূষণ নিয়ে আলাপ হচ্ছে বেজায় কম।
একইভাবে করোনা নিয়ে প্রতিদিন যত কথা হচ্ছে তার একভাগও হয় না এর পটভূমি নিয়ে। বিশেষ করে খাদ্য ও শরীর নিয়ে। আজ স্বাস্থ্যপ্রশ্নে সবাই যতটা মনযোগী, স্বাভাবিক অবস্থায় এর শতভাগের একভাগও আগ্রহী নই আমরা খাদ্য ও কৃষি বিষয়। অথচ আমাদের দেহটা ওখানেই সঁপে দেয়া।
বাস্তবতা হলো আমরা কৃষিকে যত বেশি মুনাফামুখী করেছি ততই পাল্টিয়েছি খাদ্যাভাস। তাতেই আসতে শুরু করেছে পরাক্রমশালী ভাইরাসেরা। তবে ইচ্ছা করলেই আগামী বিশ্ব নিজেকে সুরক্ষিত করতে পারে।
মানুষের চাহিদা রয়েছে বলেই মাছ-মাংস উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগ আসছে। এতে প্রথমেই দরকার হয় জমির। যা মূলত কৃষিজমি কিংবা শেষমেষ টিকে থাকা কিছু বনাঞ্চল। এই ‘বিনিয়োগ’ শুরুতেই স্থানীয় পশুপাখি ও জনজীবনের ঐতিহাসিক সুস্বাস্থ্য নষ্ট করে দেয়। জঙ্গলের আড়ালে থাকা ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার জগতের স্থানান্তর ঘটে উন্মুক্ত লোকালয়ে। এ অবস্থার দায়ভার ভোক্তা হিসেবে আমাদের ওপরও বর্তায়।
বিশ্বের সর্বত্র ‘ফার্ম’গুলোর উৎপাদনে প্রায়ই নানান মড়ক লাগে। মড়ক থেকে বাঁচাতে ব্যবহার হয় হরেক এন্টিবায়োটিক। এভাবে শিল্পজাত মাংসের সঙ্গে পরোক্ষে এন্টিবায়োটিকও খায় ভোক্তারা।
কারখানায় তৈরি খাবারে অভ্যস্ত হলেও, আমরা আবার শখের বসে ‘বন্য’ খাবারকে বেশি দাম দিয়ে খেতে ভালোবাসি। সেই সূত্রে ছিটেফোঁটা বাকি বন ও বনের প্রাণসম্পদও উজাড় হয়। করোনার সংক্রমণের সঙ্গে চীনের নাগরিকদের বণ্যপ্রাণী খাওয়ার যোগসূত্রের কথা প্রচারমাধ্যমে দেখেছে সবাই। আসলে বহু দেশেই রয়েছে ‘বন্য’ বা ‘প্রাকৃতিক’ জীব-জন্তুর বিশাল গোপন বাজার। এভাবে খাদ্যাভাসের সূত্রে সকল উপায়ে গ্রহের প্রাকৃতিক সিস্টেমটি ধ্বংস করায় ভূমিকা রাখছি সবাই।
সাম্প্রতিক অনেকগুলো শক্তিধর ভাইরাসের উৎপত্তি বিভিন্ন অঞ্চলের শিল্প-শহরগুলো এবং সড়ক রুটের আশে-পাশের জায়গা। ‘আধুনিক’ মানুষদের প্রিয় এলাকাগুলোতে কেন পশু-পাখিবাহিত রোগ বেশি ছড়াচ্ছেÑ তার কারণ একটু গভীরভাবে ভাবলেই বোঝা যায়।
অন্য কোন প্রজাতিকেই মানুষ তাদের আবেগ-পছন্দ অনুযায়ী উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের সুযোগ দেয়নি। মানুষ তার পছন্দ চাপিয়ে দিয়েছে। আজ কোটি কোটি গাভীর প্রজনন চলছে খাঁচার ভেতর কোনদিন পুরুষ ষাড় না দেখেই যান্ত্রিক উপায়ে। একটা প্রজাতির জন্য এর চেয়ে বড় বঞ্চনা আর কী হতে পারে?
তবে এসব কেবল নৈতিক প্রশ্ন নয়। এর রয়েছে বিশাল রাজনৈতিক অর্থনীতি। ২০১৮ সালে ষাড়ের বীর্যই কেবল বিক্রি হয়েছে ১.৬ বিলিয়ন ডলারের। ২০২৬ নাগাদ তা হবে তিন বিলিয়ন ডলার সমান। মাংসের জন্য বছরে প্রায় ৮০ বিলিয়ন প্রাণী জবাই করছে ‘মানুষ’ এখন।
করোনা ছড়ানোর জন্য কেবল চীনের বন্যপ্রাণী ব্যবসার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে লাভ নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপ-আমেরিকাতেও প্রায় একই ধাঁচের অনেকগুলো ইনফ্লুয়েঞ্জা এসেছিল। কৃষিফার্মগুলোর ইমেজ বাঁচাতে সেসবের উৎস নিয়ে বেশি কথা হয়নি। কুখ্যাত সোয়াইন-ফ্লু মেক্সিকোর একটা ফ্যাক্টরি-ফার্ম থেকেই ছড়িয়েছিল। ‘এইচ৫এন২’ ভাইরাসের পূর্বাপরও একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রে কম আলোচিত।
আসলে ভাইরাসটি কোন অঞ্চল থেকে ছড়িয়েছে সেটার খোঁজ নেয়া হয় বর্ণবাদী মতলবে। মূলত যেটা জানা দরকারÑ কেন ভাইরাস ছড়াচ্ছে বারবার এবং ভাইরাস ছড়ানোর পর কী ঘটছে। এর সঙ্গে আমাদের খাদ্যাভাসের কোন সম্পর্ক আছে কি না।
বিশ্বজুড়ে প্রত্যেক দেশে বড় বড় ‘ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ফার্ম’ গড়ে উঠছে এখন। পুরানো দিনের ছড়ানো-ছিটানো খাদ্যপণ্যের বাজারসমূহ ক্রমে কর্পোরেট কৃষি বাণিজ্যের কাছে হার মেনেছে। অনেক শক্তিশালী দেশ আবার অপর দুর্বল দেশে যেয়ে কৃষিফার্ম খুলছে। কিন্তু কৃষিশিল্পের পরোক্ষ ফল হিসেবে রোগবালাই সামলাতে-সামলাতে ব্যক্তি পর্যায়ে আর্থিক প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। বহু স্থুল মানুষদের দেখা যাচ্ছে, করোনাকালে প্রতিরোধী ক্ষমতার খোঁজে আধা-রসুন-লেবু-মধু খুঁজছেন। এই খোঁজ আরও বাড়বে। কারণ মানুষকে ৩৬৫ দিনের জন্যই নতুন খাদ্যাভাস গড়ে তুলতে হবে।
বিশ্বজুড়ে করোনার সংক্রমণজনিত খরচপাতির কিছুটা রাষ্ট্রীয় তহবিল মিটিয়ে দিচ্ছে এবার। এটা কোন স্থায়ী সমাধান নয়। স্থায়ী সমাধান হলো কৃষিখাত থেকে মুনাফার চাপ কমানো। পারলে কৃষিকে মুনাফার চক্র থেকে বের করা। খাদ্য উৎপাদনের সার্বভৌমত্ব ‘খোদ কৃষক’ ও ‘স্থানীয় সমাজে’র হাতে ফিরিয়ে দেয়া জরুরি। মানুষ কী খাবে সে সিদ্ধান্তটি এবার মানুষকেই নিতে হবে এবং সেটা ফলাবে মানুষেরই ‘সমাজ’। রাষ্ট্রের জনসম্পদ সেই কৃষিসমাজকে সহায়তা দেবে মাত্র।
করোনার দুর্যোগ সামাল অর্থ বরাদ্দের যে হিড়িক পড়েছে সেটার বড় এক অংশ যাওয়া উচিত কৃষির পুনর্গঠনে। এই পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে ফসল আবাদে বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। ‘খাদ্য’ উৎপাদন হোক মানব স্বাস্থ্যের সঙ্গে মানানসই বিবেচনায়। শুধু মুনাফার লক্ষ্যে নয়। কেবল এ পথেই খাদ্য বাহিত ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমতে পারে।
চিকিৎসার চেয়ে শরীর রোগমুক্ত রাখাই উত্তম। আমাদের খাদ্যাভাসই ভাইরাসযুদ্ধ ডেকে এনেছে। এই যুদ্ধের মোড় ফেরাতে পারি আমরাই কেবল।