বিশ্বে ভ্যাকসিনের মার্কেটের আকার এখন প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলার। গত দুই দশকে এটা ছয় গুণ বেড়েছে। রোগশোক, আতংক, মৃত্যুভয় বিশ্ব পুঁজিতন্ত্রের এক মহা প্রাণভোমরার নাম ভ্যাকসিন। এর মাঝেই এলো কোভিড-১৯। ভ্যাকসিন নিয়ে চলছে নানা মুখী আলোচনা। কবে আসবে ভ্যাকসিন? কোন কোন দেশ বানাচ্ছে? এর পেছনে বিনিয়োগ কত হবে? ওয়ালস্ট্রীট জার্নাল ১৩ এপ্রিল জানাচ্ছে, ছোট-বড় প্রায় দু’ডজন কোম্পানি করোনা-ভাইরাসের ভ্যাকসিন বের করার আওয়াজ দিয়েছে এ পর্যন্ত। এই তালিকা আরও বাড়বে। বের করুক না-করুক এ ধরনের আওয়াজ শেয়ার বাজারে ভালো কাজ করে। ইতোমধ্যে সেটা কাজ করছেও। কিন্তু মানুষ রোগশোক থেকে কতটা মুক্তি পেল সেই আলাপ স্পর্শকাতর হয়ে আছে।
ভাইরাস কোটি কোটি মানুষের কাছে বাঁচা-মরার-প্রশ্ন হলেও বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর কাছে এটা মুনাফার প্রশ্ন। কোভিড-১৯ এর প্রথম কেস শনাক্ত হওয়ার ৪২ দিনের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘মর্ডানা’ ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের জন্য আবেদন করেছে যা একটা রেকর্ডই বটে। চীনও ইতোমধ্যে অন্তত তিনটি ভ্যাকসিনকে ট্রায়ালে নামিয়েছে। অন্যান্য সকল খাতের মতো চীন এখন ভ্যাকসিন বাণিজ্যেও উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের প্রতিদ্বন্দ্বি হতে চাইছে। ‘কোনভাবেই হারা যাবে না’ এমন এক মনোভাব নিয়ে তারা এই যুদ্ধে নেমেছে। চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব এ বিষয়ে বিশ্ববাসীকে বাড়তি বিপদে ফেলতে পারে।
কিছুদিন আগে জার্মান কোম্পানি কিওরভেক-এর কাছ থেকে ভ্যাকসিনের স্বত্ত্ব নিজ দেশের দখলে নিতে চেয়ে ট্্রাম্প যে বিশ্ব সংবাদের জন্ম দিয়েছিলেন সেটাও ছিল ভ্যাকসিন যুদ্ধেরই পুরানো এক নোংরা দিক।
কোভিড-১৯ এর আগ্রাসনে অর্থনৈতিক দুনিয়া তছনছ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ওষুধ কোম্পানিগুলো কমবেশি ভালোই আছে। এই ভাইরাস যেন তাদের জন্য শতাব্দির এক বড় সুযোগ। ফলে কিছু কোম্পানি তাই তাড়াতাড়ি ভ্যাকসিনের প্রথম পর্যায়ের ‘ট্রায়াল’-এ নামতে উদগ্রীব।
শেয়ার বাজার ছাড়াও বড় বড় কোম্পানিগুলোর ভ্যাকসিন ট্রায়াল ঘোষণায় লাভের আরেকটা উৎস হলো ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্টের জন্য প্রচুর তহবিল আছে দুনিয়াজুড়ে। জনস্বার্থেই এসব অর্থ বরাদ্দ হয় কিন্তু গবেষণা শেষে দেখা যায় ভ্যাকসিনগুলো কেনাবেচা চলছে প্রচলিত বাজার ব্যবস্থা দ্বারা, কোম্পানির স্বার্থে। ফলে ভ্যাকসিন বের হলেই সবাই যে সেটা পাবে তার সামান্যতম নিশ্চয়তা নেই। উচ্চমূল্যের পাশাপাশি ধনী দেশগুলো এটা মজুদ করতে পারে বলেও শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত যেসব ইঙ্গিত আসছে তাতে প্রতি কোর্স ভ্যাকসিনের দাম ৪০ থেকে ৬০০ ডলার পর্যন্ত হতে পরে। এক হিসাবে দেখা গেছে, কোভিড-১৯ এর যেখান থেকে শুরু চীনের সেই হুবেই প্রদেশের অর্ধেক মানুষকে যদি যুক্তরাষ্ট্রের কোন কোম্পানি ভ্যাকসিন দেয়ার ব্যবসা পায় তাতে ৩৭ বিলিয়ন ডলার আয়ের সম্ভাবনা। পুরো কোর্সের দাম ৬০০ ডলার ধরে এই হিসাব করা হয়েছে। এভাবে পুরো বিশ্বে কোভিডের ভ্যাকসিন ব্যবসার আয়তন আমরা হয়তো কল্পনাও করতে পারবো না।
ভ্যাকসিন দুনিয়ায় একটা কথা চালু আছে প্রতি ডলার বিনিয়োগে এখানে ৪৪ ডলার পর্যন্ত ব্যবসা হয়। বহু দেশেই ওষুধের দাম কত হবে সেটার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের কোন উদ্যোগ থাকে না। কোম্পানিগুলো ইচ্ছামতো দাম ঠিক করে নেয়।
তারপরও জীবন বাঁচাতে এই ওষুধ কোম্পানিগুলোর ওপরই মানুষকে ভরসা করতে হচ্ছে। দেশে দেশে চলতি লক-ডাউনের অবসানও অনেকখানি নির্ভর করছে কোভিড-১৯ এর প্রতিষেধকের গবেষণা, উদ্ভাবন ও বাজারজাতের ওপর।
কোন একটি রোগের প্রতিষেধক খোঁজায় বিশ্বে এত ধন্য ধন্য রব ওঠেনি যা ঘটছে এখন কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে। ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রচারমাধ্যমে দেবদূতের মতো কভারেজ পাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বহু রাষ্ট্র এই গবেষণায় জনগণের অর্থই ঢালছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতোমধ্যে এই খাতে ৫৫ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের অনেক অর্থও এতে বিনিয়োগ হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের বাজেট তৈরি হয়েছে কোভিডের ভ্যাকসিন গবেষণার জন্য। বহু বিশ্ববিদ্যালয় এই গবেষণায় শামিল আছে। গবেষকরা এই আয়োজনে এবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তা নিচ্ছেন। দেশে দেশে এতদিন বিভিন্ন ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় যেসব ওষুধপত্র ব্যবহৃত হয়েছে সেই লাখ লাখ উপাত্তকে প্রসেস করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে। এছাড়াও এইচআইভি, ম্যালেরিয়া ইত্যাদির বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিনগুলোকে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে কতটা কাজে লাগানো যায় সেই পরীক্ষাও চলছে। এসব ভ্যাকসিন ব্যবহারের উপাত্তগুলো এখন কোভিডের প্রতিষেধক খোঁজার কাজে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিপুল হারে কোভিড ভ্যাকসিন তৈরির জন্য দরকার বিশাল আয়তনের উৎপাদন কাঠামো। সেই বিনিয়োগ কে, কীভাবে, কী শর্তে করছে তার ওপরই নির্ভর করবে এর বাজার চিত্র।
বলা হচ্ছে, কোভিড-১৯ মানবপ্রজাতির একক শত্রু। এটা সত্য হলে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বের সকল বৈজ্ঞানিক তথ্য ও মেধাও একত্রিত হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু বড় বড় ফার্মাগুলো তাদের নিজস্ব হিসাবের বাইরে অন্যদের সঙ্গে উপাত্ত সহযোগিতায় যেতে সামান্যই ইচ্ছুক। নিজেদের পুরো কেমিক্যাল ল্যাব তারা সকলের জন্য খুলে দিতে উদার নয়। তারপরও সুপার কম্পিউটারগুলো এতদিনকার প্রাপ্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ইতোমধ্যে বাজারে থাকা ছয়টি ওষুধ কোভিডের বিরুদ্ধেও কাজ লাগতে পারে বলে তথ্য পেয়েছে। এসব প্রাপ্তির উপর দাঁড়িয়েই অনেক কোম্পানি কোভিডের বিরুদ্ধে তাদের পণ্য ট্রায়ালের আবেদন করছে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর এই আগ্রহের মূলে রয়েছে মার্কেট স্টাডি। কারণ এই বাজারটি অকল্পনীয়ভাবে বড়।
বিশ্বের ভ্যাকসিনের বাজারটি ক্রমাগত বাড়লেও পুরো বাজারের ৮৫ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে গ্লাক্সোস্মিথ, সানোফি, ফাইজারসহ চার-পাঁচটি কোম্পানি। এই একচেটিয়াত্ব জনস্বার্থের দিক থেকে একটা সমস্যা। ভ্যাকসিনের গবেষণায় রয়েছে বহু নৈতিক বিতর্ক। তবে সব কিছু ছাপিয়ে বড় বিষয় ওষুধের উচ্চমূল্য এবং বিপনন ব্যবস্থা। করোনার ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবে না যদি না রাষ্ট্রগুলো কিংবা জাতিসংঘ সম্ভাব্য এই ভ্যাকসিন সাধারণের কাছে পৌঁছানোর আর্থিক দায়-দায়িত্ব নেয় এবং অবিলম্বে একটা নীতিমালা তৈরি করে। কোভিড-১৯ এর সকল ধরনের ভ্যাকসিনের ‘ফেইজ-ওয়ান-ট্রায়ালে’র শুরুতেই একটা আন্তর্জাতিক চুক্তি হওয়া এখন সময়ের দাবি।
দরিদ্র দেশগুলোর জন্য ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেয়েও জরুরি হলো কারা এটি তৈরি করবে, এর দাম কত রাখা হবে এবং বিশ্বের কোটি কোটি নি¤œবিত্ত এটা কীভাবে পাবে। কোন কোন দেশ এমন আইন করার চিন্তায় আছে যা তাদের কোম্পানিগুলোকে অভ্যন্তরীণ বাজারের বাইরে ভ্যাকসিন ছাড়তে বাধা দিবে। এরকম শঙ্কা এশিয়া-আফ্রিকার জন্য উদ্বেগের। অস্ট্রেলিয়া ২০০৯-এ ইনফ্লুয়েঞ্জার একটা ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে এরকম করেছিল।
কোভিড-১৯ এর মতো ভাইরাসগুলো যেহেতু সমগ্র বিশ্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে সুতরাং এর বিরুদ্ধে লড়াইও হওয়ার দরকার সম্মিলিত। এই লড়াইয়ে মানুষ ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হতে পারে না। কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে গবেষণায় প্রাপ্ত সকল জ্ঞান মানবসমাজের যৌথ সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত হওয়া উচিত।
তবে এই দাবিটি যত সহজে তোলা গেল তা অর্জনের সংগ্রামটি তত সহজ হবে না। বাংলাদেশে সচরাচর ওষুধ কোম্পানিগুলো সম্পর্কে প্রচারমাধ্যম নিশ্চুপ থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই নিশ্চুপ থাকার কারণ জানা যায়। কেবল গত বছর ঐ দেশটিতে ওষুধ কোম্পানিগুলো ২৯৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে তাদের স্বার্থে পলিসি ইস্যুতে লবিংয়ে। সকল বড় বাজারেই ওষুধ শিল্প এভাবে ব্যবসা করছে।
প্রশ্ন হলো, কোভিড-১৯ এর আসন্ন ভ্যাকসিন নিয়েও কী ওরকম ব্যবসাই হবে? এশিয়া-আফ্রিকার কোটি কোটি মানুষের জন্য তাহলে সেই ভ্যাকসিন পাওয়া অধরা স্বপ্নের মতো হয়ে যেতে পারে। যদিও তাদের প্রতিনিয়ত ভ্যাকসিন গবেষণার সুসংবাদ দিয়ে যাওয়া হচ্ছে।