তাইওয়ান নিয়ে চীন- যুক্তরাষ্ট্র মুখোমুখি

চীন, তাইওয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রর প্রেসিডেন্ট- সংগৃহীত

  • মেহেদী হাসান
  • ২৩ এপ্রিল ২০২০, ১৩:২২

প্রশান্ত মহাসাগরে মোতায়েন ছিল পরমানু শক্তিচালিত ব্যাপক ক্ষমতাসম্পন্ন মার্কিন দুটি বিমানবাহী রণতরী। করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারনে এখন এ দুটি রণতরী মিশন পরিচালনায় অক্ষম। রাখা হয়েছে ডক করে। আর এ সুযোগ তাইওয়ান প্রণালীতে বিমানবাহী রণতরী এবং ৫টি যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছে চীন। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রানওয়েতে নামিয়েছে ১২টি বি-৫২ বম্বারসহ অনেক শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান। প্রস্তুত করা হচ্ছে আট লান্টিক মহাসাগরে মোতায়েনকৃত বিমানবাহী একটি রনতরী প্রশান্ত মহাসাগরে পাঠানোর জন্য। ফলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে করোনা দুর্যোগের মধ্যেও প্রশান্ত মহাসাগর আর তাইওয়ান নিয়ে চীন যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার।

চীনা বিমানবাহী রণতরী লিয়াওনিং এবং ৫টি রণতরী মিয়াকো প্রণালী অতিক্রম করেছে। তাইওয়ানের পূর্ব তীরের সমুদ্রসীমায় এগুলো অবস্থান নেয়। এরপর তাইওয়ানের দক্ষিনে সাগরে মহড়া পরিচালনা করে। চীনের দাবি তাইওয়ান তাদের অংশ। তাইওয়ানের অনেকে মনে করে তাইওয়ান একটি আলাদা দেশ। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে।
জাপানের মিয়াকো আর ওকিনাওয়া দ্বীপের মাঝে অবস্থিত মিয়াকো প্রণালী। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় জানায় চীনা বিমানবাহী রণতরী ও যুদ্ধ জাহাজ মিয়াকো প্রণালী অতিক্রম করে তাওয়ানের উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়। তাইওয়ানের সীমান্তের কাছে পাঠানো চীনা বিমানবাহী রণতরীতে রয়েছে অনেক শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান। এ রণতরী ২৪টি জে-১৫ যুদ্ধ বিমান বহন করতে পারে।
মার্কিন রনতরী না থাকায় পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে শুধুমাত্র চীনা বিমানবাহী রনতরী অবস্থান করছে। বিমানবাহী এ রণতরীর সাহায্যে রয়েছে ২টি মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, ২টি মিসাইল ফ্রিগেট এবং একটি সাপ্লাই জাহাজ। এসব রণতরী প্রথমে তাইওয়ানের পূর্ব উপকূলে অবস্থান নেয়। পরে তাওয়ানের দক্ষিনে সাগরে মহড়া পরিচালনা করে।

প্রশান্ত মহাসাগরে চীনা এ অগ্রযাত্রার জবাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত করেছে এক ডজন বি-৫২ বম্বার এবং অন্যান্য যুদ্ধ বিমান। । ১২টি বি-৫২ বোমারু বিমানসহ এসব যুুদ্ধ বিমান রানওয়েতে যে কোনো মুহুর্তে উড্ডয়নের জন্য সারিবদ্ধভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

বি-৫২ বম্বার আকাশে দানব নামে পরিচিত। বি-৫২ হলো সেই যুদ্ধ বিমান যেগুলো ১৯৫৭ সালে টানা ৪৫ ঘন্টা আকাশে ওড়ে বিশ্ব পরিভ্রমন করে। পরমানু বোমা বহনে সক্ষম এ বিমান দিনের পর দিন আকাশে অবস্থান করতে পারে। তাইওয়ান এবং প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের অগ্রযাত্রা রোধে যুক্তরাষ্ট্র সজ্জিত করেছে এ বিমান।
এ ছাড়া তাইওয়ান প্রণালীতে পৌছেছে মার্কিন নেভির গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার। তার আগে পাঠানো হয় ডেস্ট্রয়ার ম্যাক কম্পবেল। এর পাশপাশি হ্যারি এস ট্রুম্যান নামক বিমানবাহী রণতরী এ অঞ্চলে পাঠানোর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এটি বর্তমানে আটলান্টিক মহাসাগরে মোতায়েন রয়েছে । তবে করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষায় বর্তমানে এর সৈনিকদের কোয়ারেনটিনে রাখা হয়েছে।
তাইওয়ান জানিয়েছে তাদের পক্ষ থেকেও সম্ভাব্য সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য। চীনা পদক্ষেপের বিপরীতে মার্কিন ও তাইওয়ানের এ রণপ্রস্তুতির বিপরীতে চীনাদের পাল্টা পদক্ষেপ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কিছু বলা হয়নি।
প্রশান্ত মহাসাগরে মোতায়েন ছিল থিওডর রুজভেল্ট আর রোনাল্ড রিগ্যান বিমানাহী রণতরী। থিওডর রজভেল্টের নৌ সেনাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে করোনা ছড়িয়ে পড়ায় বর্তমানে তা গুয়াম দ্বীপে রাখা হয়েছে। আর রোনাল্ড রিগান রক্ষনাবেক্ষনের জন্য মোতায়েন করা হয়েছে জাপানের ইয়োকোসুকায়। তবে রোনাল্ড রিগানের নৌ সেনাদের মধ্যেও করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তথ্য অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বর্তমানে ২০টি বিমানবাহী রণতরী রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি পরমানু শক্তিচালিত। থিওডর রুজভেল্ট, রিগ্যান ছাড়া ওয়াশিংটনে পুগেট সাউন্ড ঘাটিতে ডক করা র্কাল ভিনসন নামক বিমানবাহী রণতরীর নৌ সেনাদের মধ্যেও করোনা ভাইরাস পাওয়া গেছে পরীক্ষায়।

বৃটেনের ডেইলি মেইলের খবরে বলা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট চারটি বিমানবাহী রণতরীতে করোনা ভাইরাস ছাড়ানোর বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে। অপর ৫টি বিমানবাহী রণতরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ঘাটিতে রক্ষনাবেক্ষনের জন্য ডক করা হয়েছে। দুটি বিমানবাহী রণতরী মোতায়েন রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে।
অপরদিকে ৯ বিলিয়ন ডলার খরচ করে চীন বর্তমানে শানডং নামে আরেকটি বিমানবাহী রণতরী নির্মানের কাজ শেষে করেছে । এটি চীনের সর্ব দক্ষিনে হাইনান দ্বীপে মোতায়েন রয়েছে।
প্রশান্ত মহাসাগরে ব্যপক শক্তিশালী ২টি রণতরীর অনুপস্থিতি আর করোনার কারনে মার্কিন নেভির বর্তমান দুর্বল অবস্থানের সুযোগে চীন বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তার রণতরীর কার্যকর চলাচল নিশ্চিত করতে পারছে।
তাইওয়ান অভিযোগ করে আসছে চীন দেশটির আশপাশে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করেছে। তাইওয়ান বলেছে চীনের উচিত তাইওয়ানের ক্ষতি না করে করোনা মোকাবেলায় মনোযোগ দেওয়া।
তাইওয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে বলা হয়েছে রুটিন মিশনের অংশ হিসেবে মার্কিন গাউডেড মিসাইল তাইওয়ান প্রণালী অতিক্রম করেছে। ফলে করোনা ভাইরাসের মধ্যে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ।
চীন তাইওয়ানকে নিজের দাবি করলেও তাইওয়ানে বর্তমানে রয়েছে নিজস্ব সংবিধান এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অনেক দেশের নিরঙ্কুশ সমর্থন রয়েছে তাদের প্রতি। চীনের কাছে সবচেয়ে স্পর্শকাতর ইস্যু হলো তাইওয়ান। চীনা সমরসজ্জার অন্যতম লক্ষ্য এ দ্বীপ।

তাইওয়ান নিয়ন্ত্রনে নেয়ার জন্য চীন কখনো শক্তি প্রয়োগ কৌশল ত্যাগ করেনি। ২৩৯ সালে চীনা রেকর্ডে তাইওয়ানের নাম রয়েছে। ১৬৮৩ থেকে ১৮৯৫ পর্যন্ত চীনা কিং রাজবংশ শাসন করত তাইওয়ান। ১৮৯৫ সালে চীন-জাপান প্রথম যুদ্ধে জাপান জয় লাভ করে। কিং রাজবংশ তাইওয়ানকে জাপানের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের সম্মতিতে তাইওয়ানকে আবার চীনের কাছে অপর্ন করা হয়।
এরপর কয়েক বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলে চীনা ন্যাশনালিস্ট পার্টির কুমিংটাং সরকার আর মাও সেতুংয়ের কমিউনিস্ট পার্টির সৈন্যদের মধ্যে। যুদ্ধে পরাজিত হয় চীনা ন্যশনালিস্ট পার্টি । পতন ঘটে কুমিংটাং সরকারের। ১৯৪৯ সালে ন্যাশনালিস্ট পার্টি নেতা চিয়াং কাই শেক কুমিংটাং সরকারের সৈন্যদের নিয়ে তাইওয়ান পালিয়ে যায় এবং সেখানে সরকার গঠন করে। তাইওয়ানে তাদের সরকারের নাম দেয় রিপাবলিক অব চায়না। তারা তাইওয়ানে বসে চীন দখলের চেষ্টা চালায়। এমনকি জাতিসংঘে তারা চীনের আসনে বসে। পশ্চিমা অনেক দেশ তাওয়াইনের এ সরকারকে চীনের একমাত্র সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তবে ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ তাইওয়ানের পরিবর্তে বেইজিং সরকারকে চীনা সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
১৯৮০ সালে চীন ওয়ান কান্ট্রি টু সিস্টেমস নীতি চালু করে। চীনের অধীনে আসার শর্তে তাইওয়ানে স্বায়ত্তশাসন দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্ত তাইওয়ান তা প্রত্যাখ্যান করে। চিয়াং কাই শেক এবং এরপর তার পুত্র চিয়াং চিং কুয়ো ২০০০ সাল পর্যন্ত তাওয়ানের ক্ষমতায় ছিল। এরপর সেখানে শুরু হয় গণতান্ত্রিক ধারা। ২০০০ সালে কুমিংটাংদের হাত থেকে ক্ষমতা চলে যায় এবং চেন সুই বিয়ান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন । তিনি প্রকাশ্যে তাইওয়ানের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেন। ২০০৪ সালে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন এবং চীনের সাথে তাইওয়ানের সম্পর্ক তিক্ততর পর্যায়ে পৌছায়।
২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মা ইং জো। তিনি চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেন। ২০১৬ সালে তাকে তৃতীয়বার নির্বাচন করতে বাধা দেয়া হয় সংবিধান বলে এবং প্রেসিডেন্ট হন স্বাধীনতাপন্থী সসাই ইং ওয়েন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পর টেলিফোনে কথা বলেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সাথে। এটা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৭৯ সালের নীতি বিরোধী। ওই বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করে।

১৯৯৬ সালে তাইওয়ানের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রনতরী পাঠায় তাইওয়ান প্রণালীতে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর এটা ছিল এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক প্রদর্শনী।
এরপর তাইওয়ান নিয়ে ক্রমাগতভাবে চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো বিভিন্ন দেশের সম্পর্ক তিক্ত হতে থাকে। চীন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চেষ্টা চালায় তাইওয়ানকে চীনের অংশ বলে স্বীকৃতি আদায়ের। অন্যথায় বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানীকে চীনে ব্যবসা বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হয়।
চীন তাইওয়ানকে নিজের দাবি করার কারনে তাইওয়ান প্রণালী দিয়ে যেকোন বিদেশী রণতরী অতিক্রমকে সে তার সাবভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসেবে মনে করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো আন্তর্জাতিক পানী সীমা হিসাবে দাবি করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রিডম অব নেভিশনের নামে এখানে নিয়মিত অপারেশন পরিচালনা করে আসছে। এ নিয়ে চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, বৃটেনসহ অনেক দেশের সাথে চীনের দ্বন্দ্ব।