করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ লোক এখন নিজ ঘরে অবরুদ্ধ। ভাইরাসের ভয়ে শঙ্কিত প্রতিটি মানুষ। এ সময়টাতে বিশ্বের অতি ধনীরা করোনা থেকে বাঁচতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন। এজন্য অভিনব সব উপায় বের করেছেন তারা। কেউ কিনেছেন সুরম্য বাংকার যা বিশ্বের যে কোনো দুর্যোগ বা মহামারি থেকে সুরক্ষা দিতে পারে। অনেকে আবার নির্জন দ্বীপে চলে গেছেন। কেউ কেউ ভূপৃষ্ঠ থেকে দূরে থাকতে বেছে নিয়েছেন বিলাসবহুল ইয়ট। অনেকে করোনা দুর্গত এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে ভাড়া করে রেখেছেন বিলাসবহুল হেলিকপ্টার। লন্ডন ও নিউইয়র্ক শহর ছেড়ে অনেক ধনী গ্রামের বাংলোতে আশ্রয় নিয়েছেন।
অনেকেই বলে থাকেন, করোনা ভাইরাসের কাছে ধনী-গরীব সবাই সমান। সে কাউকে আলাদা চোখে দেখে না। কথাটা হয়তো কিছুটা সত্য। তবে গরীবদের তুলনায় ধনীরা খুব ভালোভাবে করোনাকে চেনেন। এ কারণে তাদের সুরক্ষা প্রস্তুতিও সর্বাত্মক। আর অতি ধনী বা সুপার রিচদের ব্যাপার-সাপারই আলাদা। করোনা মোকাবিলাতেও তারা স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়েছেন।
সম্ভাব্য পরমাণু হামলা বা বিশ্বযুদ্ধ থেকে বাঁচার জন্য বাংকার কিনে থাকেন অনেক ধনী লোকেরা। এবার করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষার জন্য সেই বাংকারকেই বেছে নিয়েছেন অনেক ধনী লোক। এসব বাংকারকে ডুম্সডে বাংকারও বলা হয়। এর মানে হলো মহাপ্রলয় হলেও এখানকার বাসিন্দাদের কোনো ক্ষতি হবে না। এসব বাংকারে রয়েছে বিলাসী সব আয়োজন। যেমন এক বছরের খাবার মজুদের ব্যবস্থা। প্রয়োজনীয় ওষুধ, মুভি থিয়েটার, সুপরিসর কক্ষ, বায়ু পরিশোধন ব্যবস্থা, শরীর চর্চা ও অন্যান্য বিনোদনের সুযোগ।
আমেরিকা ও ইউরোপের বহু দেশেই এ ধরনের বহু প্রাইভেট বাংকার রয়েছে। ইসরাইলেও নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য রয়েছে অনেক বাংকার।
যুক্তরাষ্ট্রের বাংকার ও বোমা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাতা রাইজিং এস কোম্পানির সিইও ক্লাইড স্কট বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে তাদের বিক্রি চারগুণ বেড়ে গেছে। তাদের ব্যবসা মূলত আমেরিকাভিত্তিক হলেও এখন তিনি সারা বিশ্ব থেকেই ফোন পাচ্ছেন। যেসব দেশ থেকে আগে কখনো কেউ বাংকার কিনতে চায়নি তারাও এখন আগ্রহ দেখাচ্ছে। যেমন সম্প্রতি ক্রোয়েশিয়া থেকে বেশ কিছু ফোন পেয়েছেন তিনি। এখনকার ক্রেতাদের পছন্দ গড়ে দেড় লাখ ডলার বা সোয়া কোটি টাকা দামের বাংকার।
সারভাইভাল কন্ডো নামের যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংকার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের মালিক ল্যারি হল বলেন, করোনা মহামারির পর তাদের ব্যবসাও বেড়েছে। তার প্রতিষ্ঠানের রীতি হলো আগে ক্রেতাকে দেখানোর পর বিক্রির চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এখন লোকজন না দেখেই কিনে ফেলছেন। ল্যারি হল বলেন, তিনি এখন মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য, জাপান ও ফ্রান্স থেকেও ক্রেতা পাচ্ছেন। আগে তার ক্রেতা ছিল শুধু আমেরিকানরা। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার থেকে সব পেশার লোকই আছে ক্রেতার তালিকায়। তার বাংকারের মূল্য ৫ লাখ ডলার থেকে ২৪ লাখ ডলার । এতে রয়েছে ব্লাস্ট প্রুফ ডোর, ইন্ডোর পুল, জিম, রক ক্লাইমবিং ওয়ালসহ নানা সুবিধা।
বাংকার নিয়ে মজার কা- ঘটিয়েছে ইসরাইল। হামাস ও হেজবুল্লাহর মত সংগঠনের হামলা থেকে জনগণকে বাঁচাতে ইসরাইলের জেরুজালেমে রয়েছে অনেক বাংকার। এগুলোর নাম ন্যাশনাল ম্যানেজমেন্ট সেন্টার। এবার করোনাভাইরাস থেকে জনগণকে বাঁচাতে সেগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, তারা দেশে করোনায় ১০ হাজার লোকের মৃত্যু হতে পারে। প্রতিদিন দেশটিতে করোনায় বহু মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, মারাও যাচ্ছে অনেক লোক। শুধু বাংকার নয় ধনী নিয়েছেন ভিন্নপথ
করোনা থেকে বাঁচতে অনেক ধনী লোক চলে যাচ্ছেন নির্জন দ্বীপে। এই মুহূর্তে চাহিদা বেড়েছে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের উপকূলের গ্ল্যাডেন প্রাইভেট আইল্যান্ডের। এটার জনপ্রিয়তার কারণ হচ্ছে এখানে সম্পূূর্ণ গোপনীয়তা বা প্রাইভেসির সুযোগ রয়েছে। প্রাইভেট আইল্যান্ড বা ব্যক্তিগত দ্বীপ বিক্রি ও ভাড়ায় নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠানের সিইও ক্রিস ক্রোলো বলেন, যারা এই ভয়ংকর ভাইরাস থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে চান, তাদের জন্য এই দ্বীপটি বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ জায়গা। কারণ এটা মূল ভূখ- থেকে ২০ মাইল দূরে। এই দ্বীপটি দৈনিক প্রায় ৩ হাজার ডলারে ভাড়া নেওয়া যায়।
ক্যারিবীয় দ্বীপের আরেকটি জনপ্রিয় স্পট হলো। এখানে প্রাইভেট বিমানবন্দরও রয়েছে। যারা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যক্তিগত বিমান নিয়ে উড়াউড়ি করতে পারছে ব্লু আইল্যান্ডন না তাদের জন্য এটা একটা আদর্শ জায়গা। এই দ্বীপে ৭০ একর জায়গার দাম পড়ে ৭ কোটি ডলার বা প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। অনেকে স্থলভাগ থেকে সরে গিয়ে সাগরে থাকতে চাচ্ছে।
ইয়ট ভাড়ায় জড়িত বার্জেস ইয়টসের সিইও জনাথন বেকেট বলেন, তিনি একটি পরিবারের পক্ষে সাত সপ্তাহের জন্য এবং আরেকটির পক্ষে চার সপ্তাহের জন্য ইয়ট ভাড়া করে দিয়েছেন। এসব পরিবার সাগরে থেকে করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা পেতে চায়। সেখানে তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া কিভাবে ইয়ট চালানো হয়, তার কারিগরি দিক সম্পর্কেও তারা হাতেকলমে শিক্ষা নেবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিঅ্যান্ডবি ইয়ট চার্টারের প্রেসিডেন্ট জেনিফার সাইয়া বলেন, টেলিযোগাযোগ কোম্পানির একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করোনা থেকে সুরক্ষা পেতে তার পরিবারের জন্য ইতালির পর্যটন শহর ফ্লোরেন্সে একটি ভিলা ভাড়া করেছিলেন। তবে আরও অধিক সুরক্ষার কথা চিন্তা করে পরে তিনি বাহামা দ্বীপপুঞ্জে একটি ইয়ট ভাড়া করেন।
করোনাকালে প্রাইভেট বিমানের চাহিদাও তুঙ্গে উঠেছে। ফ্লাই এলিট জেটসের সিইও ক্রিস্টোফার উইলিয়ামস মার্টিন বলেন, প্রতি সপ্তাহে তারা সাধারণত ৩০টির মত ফোন পান আগ্রহীদের কাছ থেকে । তবে এবার এক সপ্তাহে ২৭০টি ফোন এসেছে। অনেকেই বড় শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রাইভেট বিমান ভাড়া করতে চান। তিনি বলেন, করোনা দুর্যোগের মধ্যে মাত্র ৩-৪ দিনে তিনি ৩০০ এর মত ফোনও পেয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রাইভেট জেট পরিচালনার জন্য ১৮০০ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে তারা এখন হিমশিম খাচ্ছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর নিউইয়র্ক ও লন্ডন শহরে পণ্যের ঘাটতি দেখা দিলে ধনী ব্যক্তিরা এসব শহর ছেড়ে তাদের সেকেন্ড হোম তথা গ্রামীণ বাংলোতে চলে যেতে শুরু করেন।
এছাড়া এসব শহর লকডাউন করা হতে পারে বলে খবর ছড়িয়ে পড়লেও ধনীরা বাংলোতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যাদের পছন্দমত সেকেন্ড হোম নেই, তারা এগুলো ভাড়া নিয়েছেন। যেমন লন্ডনের অনেক ধনী ব্যক্তি মাসে ৫০ হাজার পাউন্ড ভাড়ায় বাংলো নিয়েছেন। যেসব প্রতিষ্ঠান এ ধরনের বাংলো ভাড়ার ব্যবস্থা করে দেয়, তারা এখন আগ্রহীদেও কাছ থেকে বিপুল সংখ্যক ফোন পাচ্ছেন।
সম্প্রতি লন্ডনের একটি অভিজাত পরিবার করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে ফ্রান্সের নৈসর্গিক শহর রিভিরায় পৌছায় প্রাইভেট বিমানে। তবে লকডাউনের কারণে সেখানকার পুলিশ তাদের তাড়িয়ে দেয়।
ধনীরা আরও নানাভাবে নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে দামি স্যানিটাইজার ও মাস্ক সংগ্রহ করেছেন তারা। উন্নত মানের হাসপাতালে খ্যাতনামা চিকিৎকরের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছেন অনেকে।
যেমন নিউইয়র্কের সলিস হেলথ একটি অভিজাত চিকিৎসা কেন্দ্র। ম্যানহাটনে অবস্থিত এই কেন্দ্রের চিকিৎসা সুবিধা শুধু তাদের সদসস্যদের পরিবারের জন্য সংরক্ষিত। এখানে সদস্য হতে হলে বছরে ৮ লাখ ডলার দিতে হয়। এই হাসপাতালের পরিচালক ডা. বেন স্টেইন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে তাদের হাসপাতালে মেম্বারশিপ পেতে অনেকেই আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি জানান, একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী তাদের সদস্য। তিনি সম্প্রতি জাপানে একটি শুটিয়ে অংশ নেন। সেখানে চুম্বন দৃশ্যে অভিনয় করতে হয় তাকে। এরপর সংক্রমণ শুরু হলে তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কারণ চুমুর মাধ্যমে করোনা ছড়াতে পারে। তিনি এই হাসপাতালে একটির ভিআইপি রুমে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এতোসব উদ্যেগ নিয়েও কিন্তু অতি ধনীরা করোনার তা-ব থেকে কিন্তু রক্ষা পাচ্ছেন না। যেমন সৌদি রাজপরিবারের দেড় শতাধিক সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর দিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস।
একটি মর্মান্তিক খবর দিয়ে এ প্রতিবেদন শেষ করতে চাই। ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে দেশটির সবচেয়ে অভিজাত ক্লাবের নাম কান্ট্রি ক্লাব। শুধু অতি ধনীরাই এর সদস্য হতে পারে। এর সদস্য সংখ্যা ৮৫০। তাদের মধ্যে ৬০জনই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এই ক্লাবের সদস্য বিশিষ্ট নারী ব্যবসায়ী মিরনা বান্দেরিয়া ডি মেলো সম্প্রতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। স্বাভাবিক সময়ে হলে তার অন্তেষ্টিক্রিয়ায় লাখ লাখ মানুষ সমবেত হতেন। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, তার শেষ যাত্রায় সঙ্গী ছিলেন শুধু তার ছেলে। এটা এই শিক্ষাই দিচ্ছে যে শুধু টাকা থাকলেই জগতের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।