করোনাভাইরাস বিশ্বের প্রায় দুই লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। তবে ঘুম হারাম করে দিয়েছে পৃথিবীর ৮০০ কোটি আদম সন্তানের । মানুষ এখন এ দুঃসহ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তারা জানতে চাচ্ছে কবে শেষ হবে করোনা মহামারির। হতাশ মানবজাতির জন্য আশার বাণী শুনিয়েছেন বিশ্বখ্যাত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক। তিন বলেছেন, আগামী ৬০ দিনের মধ্যেই বিশ্ব থেকে করোনা নামের মহাবিপদ কেটে যাবে। আশার কথা হলো তার পূর্বাভাস ইতোমধ্যেই ফলতে শুরু করেছে। ওই অধ্যাপকের বিশ্লেষণ এবং করোনার গতিধারা নিয়ে আজ আমরা তুলে ধরব সর্বশেষ বৈশ্বিক পরিস্থিতি।
বিশ্বকে ল-ভ- করে দিয়ে করোনাভাইরাস দৃশ্যত শক্তি হারাতে শুরু করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত দেশগুলোতে করোনার তা-ব ইতোমধ্যেই শিখরে পৌঁছেছে। এখন সারাবিশ্বেই করোনার অদম্য গতি নিম্নমুখী।
ক্যামব্রিজের রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যাপক এবং ট্রিনিটি কলেজের ফেলো অলিভার লিন্টন এক গবেষণা নিবন্ধে বলেছেন, 'করোনা মহামারির সমাপ্তি দৃষ্টিসীমার মধ্যে চলে এসেছে। এটা সবার জন্য সুখবর।' অধ্যাপক লিন্টনের নিবন্ধটি ক্যামব্রিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
অধ্যাপক লিন্টন দেখিয়েছেন, করোনার চূড়ান্ড তা-বের দিনগুলোতে বিশ্বে দৈনিক ৮০ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হবেন আর মারা যাবেন ১০ হাজারের বেশি লোক। তবে সুখবর হচ্ছে, ১৮ এপ্রিলের আগেই সেই দুঃসময় কেটে গেছে। এখন বিশ্বে প্রতিদিনই সংক্রমণ ও মৃত্যু কমতে থাকবে।
অধ্যাপক লিন্টন বলেছেন, আগামী ২০ দিনের মধ্যে বিশ্বে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ৪০ হাজারের নিচে নেমে আসবে। ৩০ দিনের মাথায় দৈনিক আক্রান্ত হবে ২০ হাজারেরও কম লোক। এভাবে ৪০ দিনের মাথায় পাঁচ-সাত হাজার এবং ৬০ দিন পর সংক্রমণ কার্যত শূন্যে নামবে সংক্রমণ। এর মানে হচ্ছে দুই মাস পর বিশ্বে করোনার তা-ব থাকবে না। সংক্রমণের মতো মৃত্যু একই হারে কমে আসবে।
এই পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, চীনসহ বিভিন্ন দেশের করোনা রোগের তথ্য ব্যবহার করেছেন। তবে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুও তথ্য নিয়ে বিভিন্ন দেশে প্রশ্ন উঠছে। ফলে এই পূর্বাভাস একেবারে নির্ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও কম। তবে ইতোমধ্যেই তার পূর্বাভাস বহুলাংশে মিলতে শুরু করেছে। কোয়াড্রেটিক টাইম ট্রেন্ড মডেল অনুসরণ করে তিনি এই পূর্বাভাস দিয়েছেন।
অধ্যাপক লিন্টন বলেছেন, তার হিসাবে যুক্তরাজ্যে আক্রান্ত হবে এক লাখ ৬০ হাজার মানুষ আর মারা যাবে ১৯ হাজার ৮০০ জন। যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত হতে পারে ১০ লাখ লোক যাতে মৃত্যু হতে পারে এক লাখ ১২ হাজার মানুষের। তার পূর্বাভাস হলো ইতালি, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই সংক্রমণের চূড়া অতিক্রম করেছে। অন্যান্য দেশ সম্পর্কেও তিনি এভাবে পূর্বাভাস দিয়েছেন।
চীনে করোনা সংক্রান্ত উপাত্ত ও মহামারির সাধারণ তথ্য ব্যবহার করে এই পূর্বাভাস দিয়েছেন অধ্যাপক লিন্টন। তিনি বলেছেন, চীনের উহানে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয় ৩১ ডিসেম্বর আর সেখানে লকডাউন জারি করা হয় ২৩ জানুয়ারি। অর্থাৎ সংক্রমণ শনাক্তের ২৪তম দিনে লকডাউন শুরু হয়। তাদের সংক্রমণ চূড়ায় পৌঁছায় ৪২তম দিনে আর মৃত্যু সর্বোচ্চ হয় ৫০তম দিনে। এই মডেল ব্যবহার করে তিনি বাকি বিশ্বেও জন্য তিনি এই পূর্বাভাস দিচ্ছেন। তবে সামাজিক দূরত্ব ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার মতো বিষয়গুলো তড়িঘড়ি করে তুলে নিলে যে কোনো দেশে দ্বিতীয় দফায় আবার সংক্রমণ শুরু হয়ে চূড়ায় পৌঁছাতে পারে বলেও তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন।
অধ্যাপক লিন্টন তার গবেষনায় দেখিয়েছেন, করোনার সংক্রমণ কোনো দেশে চূড়ায় পৌঁছানোটা বড় বিষয় নয়, যদি তাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়। জার্মানি, তুরস্ক, কানাডা, বেলজিয়াম এর ভালো উদাহারণ। তবে চূড়ায় পৌঁছানোর পর সংক্রমণ কমতে থাকলে একপর্যায়ে আক্রান্তের সংখ্যা নগণ্য হয়ে পড়বে। তাতে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার মতো কড়াকড়ি শিথিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজতর হয়।
অধ্যাপক লিন্টনের পূর্বাভাস ইতোমধ্যেই মিলতে শুরু করেছে। সংক্রমণের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে দুটি ছাড়া সবগুলো দেশেই প্রকোপ কমেছে। এর মধ্যে আটটি দেশই হয়তো চূড়া অতিক্রম করে নিম্নমুখী হচ্ছে অথবা অবস্থা অপরিবর্তনীয় রয়েছে।
করোনা সংক্রমণে শীর্ষ ১০ দেশ হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, চীন, ইরান ও রাশিয়া। এই দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক ও রাশিয়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যুও সংখ্যা এখনও ঊর্ধ্বমুখী। তবে তুরস্ক ও রাশিয়া পরিস্থিতি বেশ দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিচ্ছে।
করোনাভাইরাসে গত দুই সপ্তাহের মধ্যে বিশ্বে সবচেয়ে কম মৃত্যু হয়েছে ১৯ এপ্রিল। এদিন মৃত্যু পাঁচ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। এ মহামারিতে এর আগের দুই সপ্তাহে রেকর্ড মৃত্যু দেখেছে বিশ্ব। এ সময়ের মধ্যে দৈনিক সাত থেকে আট হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছে প্রায় প্রতিদিনই। এক দিন তো মৃত্যু ১০ হাজারও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তবে কয়েক দিন ধরে মৃত্যু কমছে ধারাবাহিকভাবে। সংক্রমণের প্রকোপও কমে আসছে। অবশ্য কয়েকটি দেশ প্রকোপ বাড়লেও তা ততটা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়নি।
চীনের পরে করোনায় সবচেয়ে বেশি বিপন্ন ইতালি ও স্পেনে কয়েকদিন ধরে মৃত্যু কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রেও আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। এসব দেশে পরিস্থিতি অনেকাংশ নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে গত ২ এপ্রিল থেকে প্রতিদিনই ৩০ হাজারের বেশি লোক করোনায় আক্রান্ত হন। তবে ১১ এপ্রিল থেকে সংক্রমণ কমতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দুর্গত এলাকা নিউইয়র্ক রাজ্যে আক্রান্ত ও মৃত্যু কমছে। আইসিইউতে ভর্তি রোগীর সংখ্যাও কমছে এ রাজ্যে। যুক্তরাজ্যের মোট মৃত্যুর প্রায় অর্ধেকই এ রাজ্যে ঘটেছে। আসুন জেনে এ সর্ম্পকে আরো কিছু বিশ্লেষন
ভয়েস ওভার-৩
ইতালিতে মার্চের শেষার্ধে দৈনিক ছয় হাজারের মতো রোগী শনাক্ত হতো। এখণ এ হার বেশ কমেছে। গত ১০ দিনে প্রতিদিন শনাক্ত হচ্ছে তিন থেকে চার হাজার মানুষ। একই সময় মৃত্যু আট শতাধিক থেকে কমে ছয়শ’র নিচে নেমেছে। ইতালিতে মৃত্যু ও শনাক্ত কমে আসায় কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
করোনায় ল-ভ- স্পেনে মার্চের শেষ ১০ দিনে দৈনিক আট হাজারে বেশি লোক আক্রান্ত হলেও গত ১০ দিনে প্রতিদিন এই সংখ্যা পাঁচ হাজারের কাছাকাছি চলে এসেছে। স্পেনে মৃত্যুহারও কমে আসছে। ২০ এপ্রিল স্পেনে মৃত্য কমে ৪০০ এর নীচে নেমে এসেছে। এক মাসের মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে কম মৃত্যু। এক মাসের বেশি সময় পর স্পেনে শিশুদের বাইরে যাওয়ার অনুমিত দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
যুক্তরাজ্যে সংক্রমণের প্রকোপ কমে আসছে বলে জানিয়েছে সরকার। করোনায় বিধ্বস্ত ইরানে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় দোকানপাট ও মহাসড়ক খুলে দেওয়া হয়েছে। দেশটিতে কিছুদিন ধরেই করোনার প্রকোপ কমে আসছে। গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে মৃত্যু ১০০ এর নীচে নেমেছে। ইরানে লকডাউন আংশিক তুলে নেওয়া হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি কর্মীদের কাজে ফিরতে বলা হয়েছে। খুলে দেওয়া হয়েছে মহাসড়ক। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় পর্যুদস্ত ইরান করোনা সংকট মোটামুটি ভালোভাবেই সামলেছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, তার দেশ করোনা সংকট সামাল দিতে পেরেছে। সবচেয়ে সংক্রমিত দেশগুলোর অন্যতম বেলজিয়ামের সরকার বলেছে, তারা করোনায় সংক্রমণের চূড়া অতিক্রম করেছে। এখন লকডাউন শিথিল করার সময় এসেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা গত দুই মাসের মধ্যে সবচেয়ে নীচে নেমেছে। দেশটিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার আদেশ শিথিল করা হয়েছে। আয়ারল্যান্ড সরকার বলেছে, সেখানে করোনার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এখন আর সংক্রমণ বাড়ছে না। শ্রীলংকা ও ইসরায়েল সরকার কড়াকড়ি শিথিল করেছে। করোনা পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর না হওয়ায় ভারতের লকডাউন শিথিল করা হয়েছে । জার্মানিতে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় কড়াকড়ি শিথিল করা হয়েছে। দোকানপাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
করোনার প্রকোপ কমে আসায় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানিসহ অনেক দেশ অর্থনৈতিক কর্মকা- পুনরায় শুরু করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এতে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠছে বৈশ্বিক শেয়ারবাজার।