দীর্ঘকাল ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর সুপার পাওয়ার। বিশ্ব রাজনীতির নানা ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার, নিয়ন্ত্রন আর আধিপত্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান অনেকটা অপ্রতিদ্বন্দ্বী । কিন্তু শান্তিপূর্ন পৃথিবী গড়ার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই শক্তি কতটা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পেরেছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। অথচ সুন্দর শান্তিপূর্ণ পৃথিবী তৈরির ক্ষেত্রে যে ধরনের শক্তি সামর্থ্য থাকা দরকার তার সবই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। মার্কিন নেতৃত্ব পৃথিবীকে শান্তি আর সাম্যের পথে পরিচালিত করতে তাদের সে শক্তি সব সময় ব্যবহার করেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের অমিত শক্তি ব্যবহার হয়েছে কেবল মাত্র নিজের স্বার্থে। গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের কথা বললেও নিজের স্বার্থে আমেরিকা বছরের পর বছর টিকিয়ে রেখেছে অনেক জনসমর্থনহীন স্বৈর শাসকদের। আবার স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে তাদের উৎখাতের চেষ্টা করেছে। আশ্রয় নিয়েছে অনৈতিকতার। নিজের এ স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জ্বলছে আগুন, ঘটছে অনেক ধ্বংসযজ্ঞ, অকাতারে বিলিন হচ্ছে মানুষের প্রাণ। সমালোচকদের মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের ছাড়া অন্য আরেকটি দেশের প্রতি খুবই উদার আর পরার্থ। সেটি হলো ইসরাইল। এই করোনাকালেও নিজের দেশে তীব্র অভাব সত্ত্বেও ইসরাইলে ১০ লাখ মাস্ক পাঠিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন সর্বশেষ তার নজির রেখেছে।
পানামার নরিয়েগার মত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বশেষ ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ধরে আনার জন্য ১৫ মিলিয়ন ডলার পুরষ্কার ঘোষণা করেছে। ২৬ মার্চ মার্কিন এটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার এ ঘোষণা দেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ মাদুরো কোকেন মদে ভাসিয়ে দিচ্ছে আমেরিকাকে। আমেরিকানদের স্বাস্থ্য ধ্বংসের জন্য কোকেনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন মাদুরো।
এছাড়া বিশ্বব্যাপী করোনা দুর্যোগের মধ্যেও ইরানসহ বিভিন্ন দেশের ওপর মার্কিন কঠোর অবরোধ বজায় রাখা নিয়েও তীব্র সমালোচনা চলছে। বর্তমানে করোনা মোকাবেলা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং সেক্ষেত্রে দেশটিতে সামরিক শাসন জারির সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন ভেঙ্গে পড়ার সমালোচনা বা আশঙ্কা বাইরের কেউ করছে না বরং সামরিক শাসান জারির প্রস্তুরি খবর প্রকাশের পর সমালোচকরা এটি জানতে পেরেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একজন দুর্বল নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বিশেষ করে করোনা ভাইরাস মোকাবেলার ক্ষেত্রে তাকে একজন ব্যর্থ নেতা হিসেবে অভিহিত করেছেন পেলোসি। আর পেলোসি এ অভিযোগ করেছেন সরাসরি ট্রাম্পপন্থী টেলিভিশন ফক্স নিউজের কাছে।
ফক্স নিউজের সানডে অনুষ্ঠানে সাংবাদিক ক্রিস্টোফার ওয়ালেসকে দেয়া সাক্ষাতকারে ন্যান্সি পেলোসি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্পর্কে বলেন, নেতা হতে হলে তাকে দায়িত্ব নিতে হয়। আমি বলছি তিনি একজন দুর্বল নেতা। তিনি দায়িত্ব নিতে চান না। তিনি দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে চান । আর অন্যের ওপর দায় চাপান।
করোনা ভাইরাস পরীক্ষার ক্ষেত্রে নেয়া পদক্ষেপ বিষয়ে পেলোসি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ব্যর্থ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পেলোসি বলেন, ট্রাম্প বিজ্ঞানকে অস্বীকার করেছেন। তিনি করোনা ভাইরাসকে ভাওতাবাজি হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন এটা অলৌকিকভাবে চলে যাবে।
শুধু ন্যান্সি পেলোসি আর ট্রাম্প বিরোধীরা নন বরং ট্রাম্পের অনেক ভক্ত সমর্থকরাও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনায় শামিল হচ্ছেন করোনা মোকাবেলায় তার ব্যর্থতা নিয়ে। ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের অতি ঘণিষ্ট পিয়ার্স মরগান ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনা করেছেন । তিনিও অভিযোগ করেছেন করোনা ভাইরাস বিষয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত যথযথ ছিলো না। সিএনএনের সাথে এক সাক্ষাতকারে তিনি সতর্ক করে বলেন, ট্রাম্প এই মুহুর্তে আমেরিকানদের ব্যর্থ করে দিচ্ছেন। করোনা ভাইরাস মোকাবেলা নয় বরং সামনের নির্বাচনে কিভাবে জেতা যায় সেদিকেই ট্রাম্পের বেশি মনোযোগ।
মরগান বলেন, আমি প্রতিদিন প্রেসিডেন্টের ব্রিফিং দেখি আর তীব্রভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি। যে কোনো দেশের প্রেসিডেন্টের জন্য এখন যেটা দরকার সেটা হলো শান্ত থাকা। সততার পরিচয় দেয়া। সঠিক কথা বলা। পুরোপুরি তথ্যের ভিত্তিতে কথা বলা। তাদের সহাভূতি দেখানোর সক্ষমতা থাকতে হবে। কিন্তু এর প্রায় সব ক্ষেত্রেই ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকানদের জীবন ব্যর্থ করে দিচ্ছেন।
সামালোচকদের অভিযোগ আমেরিকানসহ পশ্চিমা বিশ্বের বিরাট অংশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাস্তব অবস্থা বিষয়ে অন্ধকারে রাখা হয়েছে এবং প্রপাগান্ডার মাধ্যমে মিথ্যা এবং অবাস্তব চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরের রুপটি অনেকটা প্রকাশ হয়ে পড়ছে। যেখানে নানা ধরনের সমন্বয়ের অভাব দেখা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রই সর্বোত্তম, অজেয়, ইতিহাসের সেরা অর্থনীতি, সেরা মিলিটারি, ভাইটাল লিডারশিপ, অবিশ্বাস্য সিইও, অবিশ্বাস্য রাজনীতিবিদ এমন একটা ধারনা মার্কিন জনমানসে স্থায়ী হয়ে রয়েছে। কিন্তু এখন এসব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বিশেষ করে আমেরিকান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে চিত্র প্রকাশ হয়ে পড়েছে তাতে অনেকে বিস্মিত। যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ইউরোপ এমনকি এশিয়ার অনেক দেশের স্বাস্থ্য সেবার মান ভালো হিসাবে প্রমান হয়েছে।
এছাড়া নাগরিকদের প্রতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পে দায়বদ্ধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ইস্টার সানডের আগে লকডাউন তুলে নেয়াসহ করোনা বিষয়ে এখন পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যা বলেছেন, তাতে তার ঘনিষ্ট ব্যক্তিরা পর্যন্ত মর্মাহত আর হতাশা প্রকাশ করেছেন। তা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে এ ধরনের দায়িত্বহীন আচরন আশা করেননি।
গোটা বিশ্বের কাছে এটা পরিষ্কার যে, করোনা বর্তমানে ভয়াবহ এক বিপর্যয়কর বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আরো একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে, করোনা পরিস্থিতি সুপার পাওয়ার আমেরিকার চেয়ে অনেক ছোট দেশ ভালভাবে মোকাবেলা করেছে । কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে মহামারীর বিষয়টি অনেকটা তামাশার বিষয়ে পরিনত হয়েছে। গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যাকে তিনি রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। আমেরিকানদের জীবনের বিনিময়ে হলেও তার কাছে প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়েছে নির্বাচনে জয়লাভ করা।
মার্কিন স্বাস্থ্য খাত নিয়ে ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে ওবামা প্রশাসনকে দায়ী করার পর এখন দায়ী করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে। এরপর তিনি করোনা নিয়ে চড়াও হয়েছেন বিভিন্ন রাজ্য গভর্নরদের ওপর। তাদের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য সমর্থকদের রাস্তায় নামিয়েছেন। নজিরবিহীনভাবে তার সমর্থকরা বিক্ষোভ করছেন। এমনকি তার সমর্থকরা বন্দুক নিয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন।
মার্কিন নেভিতে করোনা ছড়িয়ে পড়ার খবর প্রকাশের দায়ে বরখাস্ত করা হয়েছে রণতরীর কমান্ডারকে। বিশ্লেষকদের মতে করোনা পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে একে আর কোনো অবস্থাতেই চেপে রাখা যাবে না। করোনা সঙ্কটকে কেন্দ্র করে গোটা বিশ্ববাসীর সামনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরিন ব্যবস্থাপনার আরো অনেক দুরবস্থার চিত্র প্রকাশ হয়ে পড়বে ।
করোনা আরো একটি বিষয় পরিষ্কার করেছে যে, পুঁজিবাদ, মুক্ত বাজার, বিশ্বায়ন, ভোক্তাবাদ, চূড়ান্ত স্বতন্ত্রবাদ, সর্বোব্যাপী লোভ, করপোরেট অসততা বর্তমান এ দুর্যোাগ মোকাবেলা করতে পারছে না।
ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো সংঘবদ্ধ প্রতিরক্ষা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার আওতায় এ সঙ্কট মোকাবেলায় কর্মপরিকল্পনা প্রনয়ন করা যায়নি। বরং সঙ্কটকালে অনেক দেশ পরিচয় দিচ্ছে হীন স্বার্থপরতার। ঘটছে মাস্ক ছিনতাই ঘটনার। প্রকাশ হয়ে পড়ছে মানবতাবাদী অনেক দাবীদারদের কদর্য চিত্র। ইউরোপীয় সদস্য দেশগুলো তাদের সীমান্ত বন্ধ করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল আর রাজ্য সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর মার্কিন ফেডারেল সরকার যেনো অকেটা অকার্যকর হয়ে পড়েছে । রাজ্য সরকারগুলো ফেডারেল সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ করেছে।
একদিন হয়তো করোনার কারনে সৃষ্ট ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যাবে। পৃথিবী আবার স্বাভাবিক হবে। কিন্তু বর্তমানে আমরা যে পৃথিবীতে আছি সে পৃথিবী আর থাকবে না। আসছে নতুন এক পৃথিবী। বিশ্ব রাজনীতিতে হয়তো আসবে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন। হয়তো অবসান হবে অনেকের একচ্ছত্র অন্যায় মোড়লীপনার দিন।