বিশ্ব বরাবরই কৌতুহলী কিম জং উনকে নিয়ে। উত্তর কোরিয়ার এই একনায়ক নিজেকে লুকিয়ে রাখেন রহস্যের আড়ালে। বিশ্ব যখন করোনা নিয়ে ব্যস্ত, তখনো আলোচনার বাইরে ছিলেন না তিনি। উত্তর কোরিয়ার এই রহস্যপুরুষ নিজেকে রহস্যের চাদরে ঢেকে রাখতেই পছন্দ করেন। কেবল নিজেকে নয়, তার দেশের অনেক কিছুই আড়াল করে রাখেন তিনি। ওই দেশে কখন কী ঘটছে, বাইরে থেকে বুঝে উঠা কঠিন। এমনকি কিম জং উন বেঁচে আছেন কি মারা গেছেন সেই খবরটাও বিশ্বকে শুনতে হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে।
কিম জং উন, কখন কীভাবে থাকেন তা নিয়ে বিশ্বের মাথাব্যথার শেষ নেই। এই ব্যাথার কারণেই আমেরিকা তার পেছনে লাগিয়ে রেখেছে ডাকসাইটে গোয়েন্দা। আর পাশের দেশ দাক্ষিণ কোরিয়ার ধারালো চোখ সবসময়ই তাক করা থাকে উনের ওপর।
এর আগে একবার দেশটির সাদা পাহাড়ে সাদা ঘোড়া নিয়ে দেখা গিয়েছিলো উনকে। সাদা বরফে ঢাকা পবিত্র এই পিকতু পর্বতে উনের দাদা কিম ইল সুং-এর সমাধি রয়েছে। আবার ধারণা করা হয় ওই পাহাড়ের চ’ড়াতেই জন্মেছিলেন উনের বাবা কিম জং ইল। এসব নানা কারণে পাহাড়টি উত্তর কোরিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ।
দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেখা গেলো কিম উন সাদা ঘোড়ায় চড়ে দুলকিচালে পিকতু পাহাড়ের পাথুরে শরীর বেয়ে উঠছেন। কিছু সময় পর দেখা গেলো তার সঙ্গে আরো কয়েকজন। এরপর আরো কয়েকজন। পরে দেখা গেলো সঙ্গে আছেন তার স্ত্রী রি সোল জুও। একটি পহাড়ি ছড়ায় দু’জনের মনখোলা ছবিও দেখা গেছে।
এতটুকু ছবিকে অবলম্বন করেই তৈরি হলো গুঞ্জন। তিনি কেন গেলেন ওই পাহাড়ে? নিশ্চয়ই কোনো গোপন মিশন! কিম পরিবারের জন্য ওই সাদা পাহাড়ের অর্থ আলাদা। সেইসঙ্গে সাদা ঘোড়াও ইঙ্গিত করে কিছু একটার। কিন্তু সেই কিছু একটা কী? তা এখনো খোলাসা হয়নি। মূলত উত্তর কোরিয়ার অনেক কিছুই বাকি বিশ্বের কাছে রহস্য। কড়াকড়ি আইনের কারণে দেশটির সরকার যা চায় না, তা বাইরে প্রকাশ হয় না। এমনকি গণমাধ্যমগুলোও সরকার নিয়ন্ত্রিত।
উত্তর কোরিয়া বিষয়ে বিশ্ব থাকে অন্ধকারে। এমনকি দেশটির নেতা কিম জং উনের ব্যাপারেও। তিনি ঠিক কবে জন্মেছিলেন, এই ইতিহাসটা পর্যন্ত জানা নেই বাইরের দুনিয়ার। এই তথ্য জানার জন্যও ধরনা দিতে হয় বিশ্লেষকদের কাছে। রাজনীতির বিশ্লেষকদের কেউ মনে করেন কিম জন্মেছিলেন ১৯৮৩ সালের ৮ জানুয়ারি। কেউ মনে করেন তার জন্ম ১৯৮৪ সালের ৮ জানুয়ারি। তবে কিম নিজে তার জন্ম সাল ব্যবহার করেন ১৯৮২ সাল। কিন্তু এই তথ্যে বিশ্লেষকদের সন্দেহ রয়েছে। ১৯৮২ সালটি ছিলো তার দাদা ইল সাং-এর জন্মের ৭০ বছর এবং তার বাবা জং ইল-এর জন্মের ৪০ বছর। বাবা ও পিতার সঙ্গে মিলিয়ে রাখার স্বার্থেই কাগজে তার জন্মের সালটি লেখা হয় ১৯৮২।
কেবল জন্মের সাল নয়। তার জীবনের অনেক কিছু নিয়েই বিভ্রান্তি রয়েছে দুনিয়ায়। খুব সম্ভবত তার ও তার দেশ নিয়ে বিশ্বকে বোকা বানাতেই পছন্দ করেন তিনি। কিম জং উন বিশ্বের ক্ষমতাধর কৌতুহলীদের নিয়ে যতটা খেলছেন, তার বাবা এবং দাদার পক্ষে ততটা সম্ভব হয়নি। তার দাদা মার্ক্সবাদী সমাজতান্ত্রিক নেতা কিম ইল সাং দক্ষিণ কোরিয়া থেকে উত্তর কোরিয়াকে আলাদা করে নেন। দক্ষিণ কোরিয়ার আদর্শ হয় মার্কিন পুঁজিবাদ। আর উত্তর কোরিয়ার আদর্শ সমাজতন্ত্র। দাদার পর বাবা কিম জং ইল ২০১১ সাল পর্যন্ত ছিলেন কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা। তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী হিসেবে ক্ষমতায় বসেন কিম জং উন। তার এই ক্ষমতা নেওয়ার পেছনেও আছে এক অভিনব গল্প।
বাবা কিম জং ইলের স্ত্রী ছিলেন তিনজন। তিন ঘরে তার সন্তান ছিলো ছয়জন। ১৯৭১ সালে প্রথম স্ত্রীর ঘরে এক ছেলের জন্ম হয়। পরে স্বামীর সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তাকে নির্বাসনে যেতে হয় মস্কোতে। সেখানেই মৃত্যু হয় তার। তার ছেলে কিম জং-ন্যাম থেকে যায় বাবার সঙ্গেই। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে জন্ম হয় দুই কন্যার। জং ইলের তৃতীয় স্ত্রী কো ইয়ং-হোই এর পূর্ব পুরুষ ছিলো জাপানী। তিনি গান গাইতেন। নাচতেন। তার ঘরে জন্ম হয় দুই ছেলের। একজন কিম জং চল। অন্যজন কিম জং উন। ইয়ং হোই-এর ঘরে আসে আরো কন্যা, কিম ইয়ো জং।
এই পুত্র-কন্যাদের একজন কিম জং উন এখন উত্তর কোরিয়ার শাসক। আর তার কন্যা কিম ইয়ো জংকে ভাবা হয় দ্বিতীয় ক্ষমতার কেন্দ্র। উনের মৃত্যুর গুজব চাওর হওয়ার পর পরবর্তী নেতা হিসেবে তার বোন কিম ইয়ো জং এর নাম বিশ্লেষকদের মুখে ঘুরতে থাকে।
প্রথম স্ত্রীর সন্তান অর্থাৎ কিম জং ইলের বড় ছেলে কিম জং-ন্যামকেই ভাবা হতো বাবার উত্তরসূরি হিসেবে। কিন্তু ২০০১ সালে ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করে জাপানের টোকিওর ডিজনিল্যান্ডে যাওয়ার পথে ধরা পড়েন তিনি। এতে বাবা আস্থা হারান তার প্রতি। তাকে ম্যাকাওয়ে নির্বাসনে পাঠানো হয়। পরে মালয়েশিয়ায় গুপ্তঘাতকদের হাতে মৃত্যু হয় তার। ধারণা করা হয় এর পেছনেও হাত রয়েছে কিম জং উনের।
ভাইদের জ্যেষ্ঠতার দিক থেকে এর পর আসে কিম জং চলের নাম। কিন্তু বাবা তাকে উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে যাননি। কেন দেননি, সে বিষয়ে রয়েছে নানাজনের নানা মত। তবে কিম পরিবারের সাবেক বাবুর্চি কেনজি ফুজিমোতোর প্রকাশিত আত্মজীবনী থেকে জানা গেছে জং চলের মধ্যে কিছুটা মেয়েলি স্বভাব ছিলো। এ কারণে বাবা তাকে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পছন্দ করেননি। ফুজিমোতো ২০০১ সালে উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়েছিলেন। কিম জং উনের ভাই কিম জং চলকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিলো ২০১৫ সালে, লন্ডনে। এর পর থেকে তিনি কোথায় আছেন কেউ বলতে পারছে না।
তৃতীয় পুত্র জিম জং উন বাবার প্রিয়পাত্র ছিলেন ছোটবেলা থেকেই। তখন থেকেই তার মধ্যে আলাদা ব্যক্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। শৈশবে বাস্কেটবল খেলার সময় থেকেই বাবা বুঝতে পেরেছিলেন জং উন হারতে পছন্দ করেন না। এসব কারণেই উনের অষ্টম জন্মদিনে বাবা তাকে সেনাবাহিনীর জেনারেলদের একটি ইউনিফর্ম উপহার দেন। তখনি বিশ্ব বুঝে যায় কে হচ্ছেন পরবর্তী নায়ক। তখন থেকেই দেশটির সেনাবাহিনী সমীহ করতে থাকে তাকে। শিশু উনের সামনে মাথা নত করে শ্রদ্ধা দেখাতে থাকেন জেনারেলরা।
এরপর থেকেই কিমের রাজনৈতিক উত্থান শুরু। তবে তার শৈশবের জীবনটা ছিলো আড়ালের। বড় হয়ে উঠার আগ পর্যন্ত তিনি কেমন ছিলেন, সে নিয়েও ছিলো রহস্য। এমনকি তার ছোটবেলার ছবি খুঁজে পাওয়ায় ছিলো দুষ্কর। উত্তর কোরিয়ার সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, শৈশবে কিম উন ছিলেন দারুণ রকম মেধাবি।
কিন্তু তার সহপাঠি দাবিদার অনেকে বলছেন, ইশকুলের পড়ায় মোটেও মেধাবি ছিলেন না উন। ধারণা করা হয় ১৯৯৬ থেকে চার বছর সুইজারল্যান্ডে পড়েছেন উন। পড়ার সময় নিজের পরিচয় গোপন রেখেছেন। সহপাঠিরা তাকে জানতো উত্তর কোরিয়ার এক ক’টনীতিকের সন্তান। সুইজারল্যান্ডে লেখাপড়া করার পর বাড়ি ফেরেন উন। দেশে এসে ২০০৬ সালে কিম ইল সুং মিলিটারি ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন উন। পরে তার উত্থান শুরু হয় সামরিক বাহিনীতে।
বাবা কিম জং ইলের মৃত্যু হয় ২০১১ সালে। এর পর ক্ষমতায় বসেন জং উন। তখন অনেকেই ধারণা করেছিলেন, উনের ক্ষমতায় বসাটা প্রতীকি। মূলত দেশ চালাবেন তার চাচা জ্যাং সং থায়েক। সেনাবাহিনীতে ছিলো তার যথেষ্ট প্রভাব। শুরুর দিকে উনের সবচেয়ে কাছের পরামর্শ ছিলেন তার এই চাচাই। সঙ্গে ছিলেন চাচী কিম কিয়ং হুই। উনের বাবা এই দুইজনকে বলে গিয়েছিলেন, তারা যেন উনকে দেখে রাখেন। উনের কাছে যেন ক্ষমতা থাকে, সেদিকেও খেয়াল রাখেন।
চাচা-চাচী সেই দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু বছর দু’য়েক পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। তখন উন নিজেই বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন। সামরিক বিদ্রোহের অভিযোগে তাকে মেরে ফেলেন উন। মারা হয় তার চাচীকেও। এরপর একে একে মেরে ফেলা হয় সামরিক বাহিনীতে থাকা চাচার অনুগত কর্মকর্তাদের। ধীরে ধীরে ক্ষমতার কেন্দ্র নিয়ে আসতে থাকেন তার কাছে। এর আগে তার বাবা ও দাদা দেশ শাসন করার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। রাজনৈতিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির গুরুত্ব ছিলো কম। কিন্তু কিম জং উন ওয়ার্কার্স পার্টির ক্ষমতা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর এর মাধ্যমে নিজের একক ক্ষমতাকেও পোক্ত করেছেন। তবে সেটা করতে গিয়ে দেশকে অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছেন উন। দাদার সময়ে অর্থনীতিতে দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে শক্তিশালী ছিলো উত্তর কোরিয়া। কিন্তু এখন দক্ষিণ থেকে উত্তর অনেক পিছিয়ে।
কিম জং উন ‘সমান্তরাল উন্নয়ন’ নীতি বাস্তবায়ন করছেন। তিনি চাইছেন সমান্তরালভাবে পারমানবিক এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটুক দেশটির। সেইসঙ্গে পারমাণবিক ক্ষমতার কারণেই জাতিসংঘে উত্তরকোরিয়ার স্বীকৃতি মিলুক পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে।রাজনৈতিক বিধি-নিষেধ এবং একনায়কতন্ত্রের অভিযোগে বিশ্বে উনের সমালোচনা থাকলেও উত্তর কোরিয়ায় তার জনপ্রিয়তাকে খাটো করে দেখার মতো নয়। উনের দাদা ইলের জনপ্রিয়তা ছিলো আকাশচুম্বী। নাতি উন দেখতে অনেকটা দাদার মতোই হয়েছেন। এ কারণে ভক্তরা তাকেই দেশের ত্রাণকর্তা হিসেবেই দেখছেন।
কিম জং উনকে নিজের নীতিতেই চলতে দেখা যায়। দেখে মনে হয় তিনি সবসময় দুশ্চিন্তামুক্ত থাকেন। যখনই উনকে দেখা যায়, তখনি থাকে তার হাসিমুখ। সেইসঙ্গে নিদারুণ এক ব্যক্তিত্ব। এই ব্যক্তিত্ব ও পরিপাটি একনায়ককে ‘আবেদনময়ী’ বলেও উল্লেখ করেছে সংবাদমাধ্যম।
এই পরিপাটি রহস্যপুরুষের সঙ্গে জুটেছেন আরেক পরিপাটি নারী। সেও আরেক গল্প। রি সোল জু নামের এই গায়িকা এখন উনের স্ত্রী। অর্থাৎ উত্তর কোরিয়ার ফাস্টলেডি। কবে তাদের বিয়ে হয়েছিলো, সে বিষয়ে ঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। অনেকটা হঠাৎ করেই উনের সঙ্গে জুকে দেখা গেছে। ২০১২ সালে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম তাকে জুকে উনের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। তবে তিনি কোথাকার লোক, কোথায় বড় হয়েছেন সেসব বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। এমনকি উনের সঙ্গে কীভাবে পরিচয়, সে তথ্যও আসেনি। কেউ কেউ মনে করেন ২০০৯ সালে জুকে বিয়ে করেন উন। কারো মতে ২০১০ সালে এক ধ্রুপদি সঙ্গীতায়োজনে দুইজনের প্রথম দেখা হয়। পরে বিয়ে।
ধারণা করা হয় জু দেশটির অভিজাত পরিবারের কন্যা। তার বাবা অধ্যাপক। মা স্ত্রী রোগ বিষয়ে চিকিৎসক। দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, রি সোল জু চীনে সঙ্গীতের ওপর পড়ালেখা করেছেন। তিনি ছিলেন একজন চিয়ারলেডিও। এশিয়ান অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপের সময় উত্তর কোরিয়ার দলের পক্ষে তিনি দক্ষিণ কোরিয়া সফর করেছিলেন।
বিয়ের পর দারুণ ব্যক্তিত্বপূর্ণ এই নারী উনের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েছেন চীনেও। এর পর থেকে বিশ্বমিডিয়ায় তাকে নিয়ে শুরু হয় আলোচনায়। শুরু হয় ফাস্টলেডিদের নিয়ে তুলনামুলক বিচার। সেই বিচারে উনের রুচির প্রশংসা করতে বাধ্য হন সমালোচকরাও। উন-জু পরিবারের সন্তান কয়জন সেটাও রহস্যের চাদরে ঢাকা। ধারণা করা হয় তারা তিন সন্তানের বাবা ও মা।