সউদি আরব এক সময় ছিল দরিদ্র দেশ। মরুময় দেশটিতে সম্পদ বলতে তেমন কিছু ছিল না। কিছু শহর-নগরের বাসিন্দা ছাড়া বাদবাকি বাসিন্দারা ছিল মরুচারী বেদুঈন। পশুপালন ছিল যাদের বৃত্তি। গত শতাব্দীর শেষার্ধে এসে দেশটির মাটির নিচে আবিষ্কৃত হয় তরল সোনা - তেল। এরপর থেকে বদলে যেতে থাকে দেশটির ভাগ্য। শাঁ শাঁ করে উন্নতির শিখরে আরোহন করতে থাকে সউদি আরব। তেল বিক্রির টাকায় ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে দেশটি। সে-ইতিহাস তো সবার জানা। মাটির নিচের তেল কিন্তু অফুরন্ত নয়। তাই এক পর্যায়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে, একদিন এই তেল তো ফুরিয়ে যাবে!
বলা হচ্ছে, তখন মোহাম্মদ বিন সালমান হারাবেন আজকের মতো অনুগ্রহ বিতরণের ক্ষমতা। কিন্তু সেটাই বড় কথা নয়। বড় বিষয় হলো, সউদি অর্থনীতির বিপর্যয় গোটা অঞ্চলের জন্য হবে একটা গুরুতর দুঃসংবাদ। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সউদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএস-কে এখন আর 'তরুণ ও অনভিজ্ঞ' বলে পার পাওয়ার উপায় নেই। সময় অনেক গড়িয়ে গেছে। এখন তাকে যেমনটি দেখা যাচ্ছে, তিনি ঠিক তা-ই। যুবরাজ থাকাকালীন অপশাসন, নানা কেলেঙ্কারি ও জড়িয়ে পড়া যুদ্ধের ভার কাঁধে নিয়েই তাকে সিংহাসনে আরোহন করতে হবে।
বাদশা হিসেবে কেমন হবেন এমবিএস - তারই একটি পূর্ণ ছাপচিত্র ফুটে উঠেছে সম্প্রতি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে এমবিএসের এক টেলিফোন সংলাপে। গত মাসে ওপেক বৈঠকের আগে পুতিনকে টেলিফোনটি করেন এমবিএস। তেলের দাম নিয়ে কথা হয় দু'নেতার মধ্যে। আর তেলের দাম নিয়েই তাদের আলাপ এক পর্যায়ে তুমুল ঝগড়ায় পরিণত হয়।
এমবিএস এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, প্রেসিডেন্ট পুতিনকে টেলিফোন করার মধ্যে তার ভুলটি কোথায় ছিল। বিশ্ববাজারে তেলের দাম শূণ্যে নেমে এসেছে। তেলের মজুদ দ্রুত কমে যাচ্ছে আর কম্পানিগুলো তেলের খনি বন্ধ করে দেয়ার সম্ভাবনার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। এ-ই যদি হয় হয় অবস্থা, তাহলে কী হবে সউদি আরবের, যে দেশের জিডিপি-র ৫০ শতাংশ আর রফতানি আয়ের ৭০ শতাংশই আসে তেল ও গ্যাস খাত থেকে!
প্রেসিডেন্ট পুতিন হচ্ছেন এমন একজন মানুষ, যার সঙ্গে সবরকম দরকষাকষিই করা যায়, তা যত কঠিনই হোক না কেন। এমনকি আপনি যদি সিরিয়া ও লিবিয়া যুদ্ধে রাশিয়ার বিপক্ষ দলেও থাকেন, তবুও প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে ওয়ার্কিং রিলেশন বা কাজের সম্পর্ক নিশ্চিন্তে বজায় রাখতে পারেন, যেমন রেখেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। এক্ষেত্রে যে কাজটি করা আপনার জন্য নিষেধ, সেটি হলো, তাঁকে আপনি কথায়-কথায় একেবারে কোণঠাসা করে ফেলবেন না। প্রেসিডেন্ট পুতিনকে একের পর এক আল্টিমেটাম দিয়ে এবং তাঁর সঙ্গে চড়া গলায় কথা বলে ঠিক এ 'কাজ'টিই করেছিলেন সউদি যুবরাজ। জবাবে প্রেসিডেন্ট পুতিনও চড়া গলায়ই কথা বলেছিলেন। কারণ, তিনি বিলক্ষণ জানতেন যে পোকার গেম খেলার জন্য রাশিয়ান ব্যালান্স অব পেমেন্ট সউদির চাইতে ভালো।
এমবিএস এখন তার খেলা কার্ডগুলোর দুর্বলতা কোথায়, সেটা খোঁজার চেষ্টা করছেন। সত্যি বলতে কী, রুশ প্রেসিডেন্টের কাছে টেলিফোন করার আগে সউদি যুবরাজ তার মতোই একগুঁয়ে ও চিন্তাশক্তিহীন কারো সঙ্গেই কথা বলে নিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জামাতা ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক উপদেষ্টা জারেড কুশনার শুনেছেন এমবিএস কী করতে চেয়েছিলেন। তিনি এতে আপত্তির কিছু দেখেননি। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাতœক।
তেলের দাম একেবারে পড়ে গেলে সউদি যুবরাজ কোন উপায়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার কথা ভাবছেন, সেদিকে ছিলো সবার নজর। অতীতেও বিভিন্ন সময় তেলের দরপতন ঘটেছে, কিন্তু এবারের পতন নজিরবিহীন। অতীতের কোনো ব্যবস্থাই এবার কাজে লাগছে না। অনেকে মনে করছেন, সউদি আরবের সামনে এখন ঋণগ্রস্ত দেশে পরিণত হওয়াই অপেক্ষা করছে।
সউদি আরবের আর্থিক সঙ্গতি যে ক্রমেই নিম্নমুখী হচ্ছে, তা একটি চিত্র থেকেই বোঝা যায়। যুবরাজ মোহাম্মদের পিতা সালমান ২০১৫ সালের ২৩ জানুয়ারি যখন দেশের বাদশাহ হন, তখন সউদি আরবের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৭৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চার বছরের ব্যবধানে ২৩৩ বিলিয়ন ডলার কমে গিয়ে গত বছর ডিসেম্বরে সেটি নেমে আসে ৪৯৯ বিলিয়নে। এ হিসাব সউদি অ্যারাবিয়ান মানিটরি অথরিটি বা এসএএমএ-র। অপরদিকে বিশ্বব্যাংক বলেছে, সউদিদের মাথাপিছু আয় ২০১২ সালের ২৫ হাজার ২৪৩ মার্কিন ডলার থেকে কমে ২০১৮ সালে দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৩৩৮ মার্কিন ডলারে। টান পড়েছে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চিত অর্থে। আইএমএফ আভাস দিয়েছে, দেশটির মোট ঋণের পরিমাণ এ বছর দাঁড়াবে জিডিপি-র ১৯ শতাংশ এবং আগামী বছর ২৭ শতাংশ। আর করোনা ভাইরাস ও তেলের দরপতনে ২০২২ সালে ঋণের পরিমাণ হবে জিডিপি-র ৫০ শতাংশ বা অর্ধেক।
সউদি অর্থনীতির এ ধারাবাহিক নিম্নগামিতার পেছনে বেশ কিছু কার্যকারণ রয়েছে। এরমধ্যে আছে ইয়েমেন যুদ্ধ, মিশরে ক্যু এবং আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানাভাবে হস্তক্ষেপে জড়িয়ে পড়া, আমেরিকার কাছ থেকে সামর্থ্যরে চাইতেও বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে অস্ত্র কেনা এবং নিওম ফিউচারিস্টিক সিটি নির্মাণের মতো উচ্চ ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহন। এর বাইরে যুবরাজের ব্যক্তিগত বিলাসিতার বিষয়টি তো আছেই! তার আছে তিনটি ইয়ট বা প্রমোদতরী , অনেকগুলো প্রাসাদ এবং অসংখ্য মূল্যবান চিত্রকর্ম। এসবই সউদি অর্থনীতির ধারাবাহিক নিম্নগামিতার জন্য আংশিকভাবে দায়ী বলে ব্যাপকভাবে মনে করা হয়।
সউদি অর্থনীতির বর্তমান দুর্দশা করোনা দুর্যোগের কারণে হয়নি, এর শুরু অনেক আগে থেকেই। সেই ২০১৭ সাল থেকে দেশটির প্রবৃদ্ধির হার নামেমাত্র শূন্য দশমিক তিন শতাংশ আর নির্মাণকাজ কমে যায় ২৫ শতাংশ। এর সাথে এখন যোগ হয়েছে করোনাজনিত লকডাউন। লকডাউনের কারণে বাতিল হয়ে গেছে পবিত্র হজ্ব ও উমরাহ। এ উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় এক কোটি মানুষ সউদি আরব আসতো। এ খাত থেকে দেশটির আয় হতো অন্তত ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার। এ বছর এ আয়ের পুরোটাই হিসাবের খাতা থেকে মুছে দিতে হবে।
করোনার কারণে সৃষ্ট দুর্যোগের ভার সউদি অর্থনীতি আর বইতে পারছে না, যতটা পারছে তার উপসাগরীয় প্রতিবেশীরা। লকডাউনকালে অর্থনীতিকে প্রনোদনা দিতে সউদি আরব যেখানে ব্যয় করছে জিডিপি-র মাত্র এক শতাংশ, সেখানে কাতার ব্যয় করছে সাড়ে পাঁচ শতাংশ, বাহরাইন তিন দশমিক নয় শতাংশ আর সংযুক্ত আরব আমীরাত এক দশমিক আট শতাংশ।
সউদি সরকারের প্রনোদানার অর্থও যে সবাই সমানভাবে পাচ্ছে না, তারও অনেক প্রমান আছে। যেমন, বাদশা ফরমান জারি করেছেন যে, লকডাউনকালে কর্মীদের বেতনের ৬০ শতাংশ দেবে রাষ্ট্র। কিন্তু দেখা গেছে, দেশটির বৃহত্তম টেলিকম কম্পানি এসটিসি-কে প্রনোদনার যে অর্থ দেয়া হয়েছে, তা দিয়ে কম্পানির কর্মীরা পাচ্ছেন বেতনের মাত্র ১০ শতাংশ। কারণ হিসেবে সরকার জানালো, ওই কম্পানির অনেক কর্মী কর্মস্থলে অনুপস্থিত। তাদের বেতন সরকার দেবে কেন?
অস্থায়ী হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য সউদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনেক হোটেল অধিগ্রহন করেছে। কিন্তু এজন্য হোটেল-মালিকদের কোনো রকম ক্ষতিপূরণ দেয়া তো দূরের কথা, বরং উল্টো তাদের বাধ্য করা হয়েছে নিজ খরচে কক্ষগুলো জীবাণুমুক্ত করতে এবং অস্থায়ী হাসপাতাল পরিচালনার খরচ দিতে। সউদি বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে কমর্রত মিশরীয় ডাক্তারদের বাধ্য করা হচ্ছে কম বেতন নিতে। যারা সবেতন বার্ষিক ছুটিতে ছিলেন তাদের বেতন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
সব মিলিয়ে অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে যে ব্লুমবার্গ মন্তব্য করেছে, সউদি আরব যে একটি ঋণগ্রস্ত দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, কত তাড়াতাড়ি সেটা ঘটতে যাচ্ছে।
আই এমএফ হিসেব কষে দেখিয়েছে, তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৫০ থেকে ৫৫ ডলারে নেমে এলে ২০২৪ সাল নাগাদ সউদি আরবের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেখানে নেমে আসবে, তা দিয়ে তাদের মাত্র পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। আর এখন তো তেলের দাম জিরোতে নেমে এসেছে।
এখন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দু'টি পিলার বা খুঁটিই ধ্বসে পড়েছে, যে দু'টি খুঁটির ওপর ভর করে তিনি দেশের আধুনিকায়ন ও সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। তার পরিকল্পনা ছিল সউদি রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কম্পানি আরামকো-র পাঁচ শতাংশ শেয়ার বিদেশী স্টক এক্সচেঞ্জগুলোতে তালিকাভুক্ত করিয়ে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ আনা। এ পরিকল্পনা এখন ভেস্তে গেছে। আর তার দ্বিতীয় পরিকল্পনা ছিল পিআইএফ নামে একটি তহবিল, যা ছিল তেল-বহির্ভূত অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তার প্রধান হাতিয়ার, করোনা ঝড়ের কবলে পড়ে সেটিও এখন তছনছ হয়ে গেছে।
সউদি আরবের এ অবস্থাকে উপসাগরীয় অঞ্চলের অনেকেই যুবরাজের ব্যক্তিগত পরাজয় মনে করে উল্লাস করবে, এতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেননা, তার বিভিন্ন কাজে বহু লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিশেষ করে মিশরে।
তেল নির্ভরঅর্থনীতির দিন ফুরিয়ে গেলে তার দান-খয়রাতের ক্ষমতা হারাবেন যুবরাজ, যিনি কিনা এক মিনিটে কয়েক বিলিয়ন ডলার দান করার ক্ষমতা রাখতেন। কিন্তু যে সউদি আরবের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিগত কয়েক দশক ধরে ওই গোটা অঞ্চলের অর্থনীতির চালিকাশক্তিরূপে কাজ করে আসছিল, তা হারিয়ে গেলে শিগগিরই তার বিরূপ প্রভাব পড়বে মিশর, সুদান, জর্দান, লেবানন, সিরিয়া ও তিউনিসিয়ার ওপর। কারণ, এসব দেশের লাখ-লাখ কর্মী ও পেশাজীবী সউদি আরবে কাজ করে। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ভর দিয়ে ওসব দেশের অর্থনীতি অনেকটা এগিয়ে যেতে পেরেছে। তাই সউদি যুবরাজের ওপর যার যতই ক্ষোভ থাক, সউদি অর্থনীতির বর্তমান ও আসন্ন দুরবস্থাকে কেউ খুশিমনে স্বাগত জানাতে পারেন না।