অস্ট্রেলিয়া দখলকাহিনি

শিল্পীর তুলিতে : ক্যাপ্টেন জ্যামস কুক ১৭৭০ সালে বৃটিশ ক্রাউনের নামে নিউ সাউথ ওয়েলসের দখল নিচ্ছেন - ইন্টারনেট

  • শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
  • ১৭ জুন ২০২০, ০১:৪৭

শুরু করা যাক একটা সাপের গল্প দিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের বিশ্বাস সাপ থেকেই পৃথিবীর সৃষ্টি। ওই সাপের গায়ের রঙ রঙধনুর সাত রঙের মতো। সাপটি ঘুমিয়ে ছিলো পাতালপুরীতে। সাপের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিলো মানুষ আর পৃথিবীর অন্য প্রাণীরাও। তখন পৃথিবী বলতে কিছু ছিলো না। ছিলো না পাহাড়, সাগর, নদী। একদিন রঙধনু সাপের ঘুম ভাঙলো। হামাগুড়ি দিয়ে এলো ধূসর পৃথিবীতে। তারপর তৈরি করলো পাহাড়, সাগর, নদী আর সবুজ। পৃথিবী থেকে ধূসরতা বিদায় নিলো। রঙধনু সাপ আবার গেলো পাতালপুরীতে। ডেকে আনলো মানুষ ও প্রাণীদের। এর পর থেকে সব প্রাণীর বসবাস পৃথিবীতেই।

সেই সাপের ডেকে আনা মানুষের বংশধর অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা। শুরুর দিকে এদের বসতি ছিলো প্রাচীন ভূমি ইন্দোনেশিয়ার পাহাড়ে। তখন ইন্দোনেশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া যেতো। সরুমতো একটা স্থলপথ ছিলো। আজ থেকে ৬০ হাজার বছর আগে ওই পথ হেঁটে পাপুয়া নিউগিনি হয়ে এরা পৌঁছে অস্ট্রেলিয়ায়।
কিন্তু সেই পথ এখন কোথায়?

এখন আর নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ওই পথ সাগরে বিলীন হয়েছে। আদিবাসীরা বিচ্ছিন্ন হয়েছে বাকী পৃথিবী থেকে। আর এদের বিশ্বাস, এসবের পেছনে আছে রঙধনু সাপের অভিশাপ। পৃথিবীতে পাপ বেড়ে গেলে সাপের অভিশাপ নেমে আসে। এই সাপ যেদিন চূড়ান্ত অভিশাপ দেবে, সেদিন পৃথিবী ধ্বংশ হবে। মানুষকে ফিরে যেতে হবে পাতালপুরীতে।

কিন্তু ঘুমের পুরী পাতালে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না আদিবাসীদের। তাই রঙধনু সাপের পূজা করে আসছে। এরা নিজেদেরকে ‘কুরি’ বলে পরিচয় দেয়। কুরিদের গায়ের গড়ন হয় মোটাসোটা। রঙ কালচে বাদামী। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির মতো উচ্চতা। গাঢ় বাদামি রঙের চোখ। আর চোখের রঙের কুকড়ানো চুল। আবার কারো চুল লাল। কারোটা সাদাটে লালচে। মোটা মোটা ভ্রু। বড় চোয়াল।

এরা শিকার করতো। হাতে রাখতো বর্শা, বুমেরাং। চাষবাস জানতো না। কোনো পশুও পালতো না। তবে প্রায় সবার ঘরেই থাকতো ‘ডিংগো’ নামের বিশেষ কুকুর।

অস্ট্রেলিয়া যখন এশিয়ার ভূমি থেকে আলাদা হয়ে গেলো, পৃথিবীর মূল ভূমি থেকে দূরে সরে গেলো, তখন ওই এলাকায় ছিলো অনেক অনেক আদিবাসী। মুখের ভাষাও ছিলো অনেক। একটা হিসাবে দেখা গেছে, ওই দ্বীপদেশে পাঁচশ’ উপজাতির মুখে পাঁচশ’ রকমের ভাষা ছিলো।

ইউরোপিয়রা প্রথম যখন দ্বীপটি আক্রমণ করে, তখন ভেবেছিলো আদিবাসীরা একেবারেই অসভ্য। গুহায় থাকে। কিন্তু পরে টের পেলো, এদের আলাদা একটা সংস্কৃতি আছে। আচার-আচরণ, চিন্তা-চেতনা আছে। আর আছে নিজস্ব সমাজ ও সামাজিক প্রথা। সেইসব প্রথা টিকে আছে এতো বছর পরও। এখনো অনেক আদিবাসীর জীবনযাত্রায় ঐতিহ্য বেঁচে আছে। তবে বেশিরভাগ বদলে গেছে। অনেকে বসতি গড়েছে শহরে। আর যারা গ্রামে আছে, তাদের বড় একটা অংশ থাকে দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে মারি নদীর পারে। এরা শিকার ছেড়েছে। জমি চাষ করছে। দেশটিতে এখন আদিবাসীদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ২.৬ শতাংশ। অথচ একটা সময় গোটা এলাকা ছিলো এদের।
এরা সংখ্যায় কমলো কিভাবে?

দখলদারদের উৎপাতে। যখন বাকী পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হলো, তখন থেকেই এদের ভাগ্যে নামতে থাকলো দুর্দশা।

শিল্পীর তুলিতে : এরা নিজেদেরকে ‘কুরি’ বলে পরিচয় দেয়। কুরিদের গায়ের রঙ কালচে বাদামী -ইন্টারনেট
শিল্পীর তুলিতে : এরা নিজেদেরকে ‘কুরি’ বলে পরিচয় দেয়। কুরিদের গায়ের রঙ কালচে বাদামী -ইন্টারনেট

 

১৬০৬ সালে নেদারল্যান্ডস থেকে ডাচ বাহিনী এই ভূমির খোঁজ পেলো। এরা নাম দিলো নিউ হল্যান্ড। ব্যাস, এতটুকুই। বিচ্ছিন্ন এই বিশাল ভূমি যেমন ছিলো, তেমনটিই রেখে দিলো ডাচরা। কিন্তু বৃটিশরা যখন এলো, তখন থেকে সব তোলপাড় হতে থাকলো। ১৬৮৮ সালে বৃটিশরা ওই ভূমিতে পা রাখে। বৃটেনের নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন জেমস কুকের অস্ট্রেলিয়া অভিযানের পর ওখানে বৃটিশ উপনিবেশ স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। নিউ সাউথ ওয়েলসে অনেক জাহাজ নোঙর করে। জাহাজের ভেতরে করে নেওয়া হয় বৃটিশ কারাবন্দীদের। তারপর ছেড়ে দেওয়া হয় দ্বীপদেশে।

এইসব অপরাধীরা অস্ট্রেলিয়া চষে বেড়াতে থাকে। শুরুর দিকে আদিবাসীরাও মেনে নিয়েছিলো এদের। কিন্তু এতে ক্ষান্ত হয়নি দখলদাররা। এরা আদিবাসীদের ওপর চড়াও হতে থাকে। শুরু হয় সঙ্ঘাত। বৃটিশ অপরাধীদের হাতে আধুনিক অস্ত্র। এর বিপরীতে আদিবাসীদের হাতে বর্শা আর বুমেরাঙ। অসম এই লড়াইয়ে আদিবাসীর সংখ্যা কমতে থাকে। নিষ্ঠুরভাবে এদের হত্যা করা হয়। আবার বাইরে থেকে বয়ে নেয়া রোগের প্রকোপেও মৃত্যু হয়। যারা বেঁচে থাকে, তারা নিজেদের ভূমিতেই পালিয়ে বাঁচে। প্রতাপ নিয়েই দ্বীপ শাসন করতে থাকে বৃটিশ অপরাধীরা। এখনকার অধিকাংশ অস্ট্রেলিয় সেইসব অপরাধীদের উত্তরসূরী।

১৭৮৮ সালের ২৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশরাজ অস্ট্রেলিয়ায় যান। সেই থেকে এই দিনটিকে অস্ট্রেলিয়া দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কিন্তু বৃটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে ওই দেশে মানবতা আসেনি। ১৮২৪ সাল থেকে ১৮৩১ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের তাসমানিয়ায় চলে ‘কালো যুদ্ধ’। এই যুদ্ধে মারা যায় এক হাজার আদিবাসী।

বৃটিশ ও আদিবাসীদের লড়াইটা ছিলো নিয়মিত। বৃটিশদের এসব লড়াইয়ের কোনোটাই বিরোচিত ছিলো না। ছিলো দুর্বলের ওপর সবলের হামলা। এমনকি সরল আদিবাসীদেরকে বিষমাখা খাবার উপহার পাঠিয়ে হত্যা করার অভিযোগ পর্যন্ত রয়েছে বৃটিশদের বিরুদ্ধে। ১৮৫৭ সালে কয়েক আদিবাসী এক দখলদারের পরিবারসহ ১২ জনকে হত্যা করে। এর প্রতিশোধ নিতে প্রায় ৩০০ থেকে ৫০০ আদিবাসীকে ভয়াবহভাবে হত্যা করা হয়। ইতিহাসে এটি হর্নেট ব্যাঙ্ক হত্যাকান্ড হিসেবে পরিচিত। ১৮০০ সালের শেষ দিকে একজন ইউরোপিয়ান হত্যার জের ধরে ২০০ জন আদিবাসীকে হত্যা করা হয়।

শিল্পীর তুলিতে : ১৮০০ সালের শেষ দিকে একজন ইউরোপিয়ান হত্যার জের ধরে ২০০ আদিবাসীকে হত্যা করা হয়
শিল্পীর তুলিতে : ১৮০০ সালের শেষ দিকে একজন ইউরোপিয়ান হত্যার জের ধরে ২০০ আদিবাসীকে হত্যা করা হয়- ইন্টারনেট

 

পরিকল্পিতভাবে ওদের মধ্যে কিছু রোগও ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আদিবাসীদের বড় একটি অংশের মৃত্যু হয়েছে বসন্ত রোগে। আধুনিক বিশ্বের চোখ রাঙানি সহ্য করেই বহুবছর অবরুদ্ধ থাকতে হয় আদিবাসীদের। ১৯৩০ সালে এরা ঐক্যবদ্ধ হয়, আন্দোলন শুরু করে অস্ট্রেলিয় সরকারের বিরুদ্ধে। দশ বছর আন্দোলন করার পর কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৃটিশদের মতোই সম অধিকার পায়। ১৯৬৭ সালে পায় ভোট দেওয়ার অধিকার। সেই থেকে বৃটিশদের সঙ্গে এদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার কথা। কিন্তু বাস্তব দেখাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। রাজনীতিতে এদেরকে রাখা হয়েছে কোণঠাসা করে। যদিও সেইসব অপরাধী বৃটিশদের প্রজন্ম এখন সভ্য। দেশটিকেও গড়ে তুলেছে সভ্যতায় ভরপুর করে। তবে রাজনীতি থেকে বৈষম্য দূর করতে পারেনি। এখনো অস্ট্রেলিয়া দিবস এলে আদিবাসীরা প্রতিবাদে নামে। প্লেকার্ডে লেখা থাকে ‘দখল দিবস’। জড়ো হয় দক্ষিণ-পূর্ব উপক’লের শহর সিডনিতে। এই উপকূলেই বৃটিশ অপরাধীরা নোঙর ফেলতো। সেই স্মৃতি এখনো আছে। তবে সিডনি বদলে গেছে। আধুনিক শহর সিডনির বাইরেরটা সৈকত, আর ভেতরে ঝাঁ চকচকে দালান। সিডনি টাওয়ারের মাথায় জ্বল জ্বল করে মুকুট। এর আশপাশে অপেরা হাউজ। একপাশে হারবার সেতু। অন্যপাশে প্রশান্ত মহাসাগরের মোহনা।

অপেরা থেকে একটু দূরে হাইড পার্ক। পাহাড় আর সাগরের মিলন হয়েছে লা-পেরোজে। খাড়া পাহাড়ের পায়ে ফেনা তুলে আছড়ে পড়ছে প্রশান্ত মহাসাগর। আর পাহাড়ের গায়ে আছে বসতি।

পুরো অস্ট্রেলিয়াই এমন। বিশাল দেশটিতে সৈকতের সংখ্যা কত হবে, সেটা ঠিক করে বলা মুশকিল। একেক সৈকত একেক রকম। আপনি যদি ঠিক করেন সবগুলো সৈকতে ঘুরবেন, তাহলে বছর দশেক সময় লেগে যেতে পারে।

সাগরকে নীরবে পেতে হলে লর্ড হাও দ্বীপের সৈকত সেরা। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মাঝামাঝি এই দ্বীপ তাসমানিয়া সাগরে। দ্বীপভর্তি সবুজ বন, বন্য প্রাণী। ওখানে আছে মহাসাগরীয় আগ্নেয়শীলা, প্রবাল প্রাচীর, সাগরপাখির বাসা।

অস্ট্রেলিয়ায় আছে রোমাঞ্চকর মরুভ’মি ওলগাস। আয়ারস পর্বতের পশ্চিমের এই পাথুরে মরু পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ শুকনো এলাকা। এটি আয়ারস পর্বত থেকে ১২০০ ফফু উঁচুতে একটি সমতল মরুভূমি।

দেশটির উত্তর অংশে ‘কাকাডু’ পার্ক। ওখানে গাছ ও প্রাণীর অভাব নেই। আছে জলপ্রপাতও।
উপকূলীয় শহর কুইন্সল্যান্ডের প্রবাল সাগরে আছে বড় প্রবাল প্রাচীর। যাকে ডাকা হয় ‘গ্রেট বেরিয়ার রিফ’ নামে।
দেশটিতে আছে চুনাপাথরের স্ত’প। ভিক্টোরিয়ান উপক’লের এই স্ত’পকে ডাকা হয় ‘টুয়েলভ অ্যাপসটেলস’ নামে। এর চূড়া ছিলো ৯টি। সাম্প্রতিক পতনের ফলে ৮টি টিকে আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বছরে দুই সেন্টিমিটার করে ক্ষয় হচ্ছে এই স্তূপ।

জলবায়ু পরিবর্তন বদলে দিচ্ছে অনেক কিছু-ই। পরিবর্তন আনছে ভূগোলে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ধারণা, পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে রঙধনু সাপের চূড়ান্ত অভিশাপের দিকে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে