হাইব্রিড এয়ারক্রাফটকে বলা হচ্ছে আগামী দিনের বিমান। বিমানশিল্পে রীতিমতো বিপ্লব এনে দেবে এই প্রযুক্তি- এমনটাই ধারণা এভিয়েশন এক্সপার্টদের। এক্ষেত্রে অবশ্য অন্যদের চেয়ে এগিয়ে আছে অ্যাম্পায়ার ইনকর্পোরেশন। খুব শীঘ্রই যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিষ্ঠানটি বিমানের হাইব্রিড ইঞ্জিন তৈরি করতে যাচ্ছে এবং সেটি শুধু পরীক্ষামূলক নয়, ছোট সাইজের বিমানেও স্থাপন করা যাবে। আর এ লক্ষ্যে একটি বিমান কোম্পানির সাথে চুক্তিও হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
হাইব্রিড বিমান বলা হয় সেই বিমানকে, যেটি তরল জ্বালানির পাশাপাশি চলবে বিদ্যুৎশক্তির সহায়তায়ও। জ্বালানি খরচ বাচাতেই বিমানে বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হবে বিদ্যুৎ শক্তি। বিমানে স্থাপিত লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিতে চার্জ হবে বিমান চলা অবস্থায়ই এবং এই ব্যাটারির শক্তি কাজ করবে বিমানটির জ্বালানি খরচ বাঁচাতে। পাশাপাশি এই বিমান থেকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো পদার্থ নির্গত হবে না।
বিমান পরিবহন নিয়ে এই ধারণাটি আবিস্কারের পর ২০১৮ সালের আগ পর্যন্ত এটিকে বাস্তবে রূপ দিতে কমপক্ষে ৩২টি প্রকল্প শুরু হয়েছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাসও সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে হাইব্রিড বিমান তৈরির। অবশ্য কবে নাগাদ এয়ারবাসের হাইব্রিড বিমান প্রকল্প আলোর মুখ দেখবে সেটি জানায়নি প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে এম্পায়ার ইতোমধ্যেই একটি এয়ারলাইন্সের সাথে চুক্তি করেছে। সব কিছু ঠিক থাকলে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক সার্ফ এয়ারই হতে যাচ্ছে হাইব্রিড বিমান ব্যবস্থার পথপ্রদর্শক। এই কোম্পানির একটি বিমানেই বসনো হবে হাইব্রিড ইঞ্জিন।
সার্ফ এয়ারের মালিক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুধীন শাহানির জন্য এটি ছিলো একটি উচ্চাভিলাসি পদক্ষেপ। ২০১৪ সাল থেকে তিনি তার কোম্পানিতে নেটফ্লিক্স স্টাইলে সাবস্ক্রিপশনের জন্য কাষ্টমার আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন। যাতে যাত্রীরা প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট ফি দিয়ে যতবার খুশি ছোট বিমানে ক্যালিফোর্নিয়া ও টেক্সাসের প্রাইভেট এয়ারপোর্টগুলো থেকে যাতায়াত করবে । ওই অঞ্চলেছোট ছোট রুটে নিয়মিত যাতায়াতের ক্ষেত্রে এই বিমান কোম্পানিটির জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
এই জায়গাটিতে বড় কোম্পানিগুলোর সাথে পাল্লা দিতে তিনি রীতিমতো জুয়া খেলছেন, তার কোম্পানির ছোট বিমানগুলো হাইব্রিড বিমানে রূপান্তরিত হলে তাতে খরচ কমবে। এতে ৫০ থেকে ৫০০ মাইল পর্যন্ত যাত্রায় বড় কোম্পানিগুলোর চেয়ে বেশি সুবিধা দিতে পারবে তার কোম্পানি । একই সাথে নতুন নতুন রুটেও বিমান চালনা শুরু করতে পারবে। সুধীন শাহানি বলেন, আমরা মনে করছি এসব সমস্যার একটি বড় সমাধান হয়ে আসতে পারে হাইব্রিড বিমান।
অ্যাম্পায়ারের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কেভিন নর্টকার বলছেন, তাদের হাইব্রিড প্রজেক্টের প্রাথমিক ধাপের বিমানগুলো জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেবে। বিশেষ করে সেসনা ক্যারাভ্যান ও টুইন অটারের মতো ছোট আকারের বিমানগুলোর ক্ষেত্রে এমনটি হবে বলে আশা নির্মাতাদের। এই বিমানগুলো সাধারণত ৯ থেকে ১৯ জন পর্যন্ত যাত্রী বহন করতে পারে। কিন্তু হাইব্রিড পদ্ধতি এলেও এসব বিমানের ফ্লাইট রেঞ্জ মোটেই কমবে না।
ইতোমধ্যেই একটি টুইন অটার বিমানকে হাইব্রিডে রূপান্তরিত করার বিষয়ে নাসার সাথে চুক্তিবদ্ধও হয়েছে অ্যাম্পায়ার। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাছ থেকে প্রথম বিমান হাইব্রিডে কনভার্ট করার কৃতিত্বের স্বীকৃতি আদায় করার টার্গেট নিয়ে নামছে প্রতিষ্টানটি। ২০২৪ সাল নাগাদ এই বিমানটি যাত্রী পরিবহনের সার্ভিসে যুক্ত করা। এখন পর্যন্ত সে লক্ষ্যে ভালোভাবেই এগিয়ে চলছে অ্যাম্পায়ার ইনকর্পোরেশন।
একটি টার্বেপ্রোপ ইঞ্জিনের সংস্কারের যা ব্যয় হয় অ্যাম্পায়ারের সিস্টেম অনুযায়ী কোন বিমানকে হাইব্রিডে রূপান্তরিত করলে তার চেয়ে খুব বেশি খরচ হবে না। আর সাধারণত প্রতি তিন থেকে ৫ বছর পরপর এই কাজটি করতেই হয় বিমান কোম্পানিগুলোকে। যে কারণে হাইব্রিড বিমানের প্রজেক্টটি সাহসের সাথেই গ্রহণ করছে সার্ফ এয়ার। হাইব্রিড বিমানে যাত্রী পরিবহনকে বাস্তবে রূপ দিতে অ্যাম্পায়ার ও সার্ফ এয়ারের যৌথ ভিশনের অংশ হিসেবেই প্রতিষ্ঠান দুটি এ বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বলে জানিয়েছেন অ্যাম্পয়ার প্রধান।
তবে সম্ভাবনাময় এই সেক্টরটিতে এখনো বড় আকারের বিনিয়োগ না আশায় অনেকেই হতাশ। যে প্রযুক্তিটি সার্ফ এয়ারের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে যাচ্ছে, কেন সেখানে আরো বিনিয়োগকারীরা আসছে না সেটি অবাক করার মতো বিষয়? সম্ভাবনাময় এই খাতটিতে আরো বেশি বিনিয়োগ আসা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সার্ফ এয়ারের এই সাহসী পদক্ষেপের পর অবশ্য প্রশ্ন উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি বিশাল প্রকল্পের খরচ যোগাতে পারবে কিনা? কারণ তাদেরকে অ্যাম্পায়ারের এই প্রযুক্তিটির উন্নয়নের পাশাপাশি নিজস্ব এয়ার ট্রাভেল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতেও প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে।
অ্যাম্পায়ারের প্রধান কেভিন নর্টকার ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সনদের মাধ্যমে তাদের প্রথম হাইব্রিড সিস্টেমটি পেতে খরচ করতে হবে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অবশ্য সংস্করণ যত উন্নত হবে, এই খরচ তত কমবে। তবে ছোট কোম্পানিটির জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ অবশ্যই।
সার্ফ এয়ার সাম্প্রতিক সময়ে তাদের ব্যবসায়ের পরিধি বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ছিলো স্বল্প মেয়াদে ইউরোপে ব্যবসার গন্ডি বাড়ানো। এছাড়া ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেয় অ্যাপভিত্তিক মার্কেটপ্লেস ব্ল্যাকবার্ড। এই মার্কেটপ্লেসে অ্যাপের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ফ্লাইট ছাড়াও বিমান ভাড়া দেয়া ও সাব কন্ট্রাকটে যাত্রী পরিবহনের বিষয়েও কাজ করা যায়।
এই মার্কেটপ্লেসের অধীনে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার বিমান রয়েছে, যেগুলো চাওয়া মাত্র পাওয়া যায়। সার্ফ এয়ারের পক্ষ থেকে এসব বিমানের মালিকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে অ্যাম্পায়ারের প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের বিমানগুলোতে হাইব্রিডে রূপান্তরিত করতে। সার্ফ এয়ার তার সবগুলো রুটেই মুনাফা করার মতো অবস্থায় রয়েছে, তবে বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এই ব্যবসায় তাদের জন্য ঝুকিও রয়েছে।
সার্ফ এয়ারের সাবস্ক্রাইবার মডেলটি প্রচলিত বিমান সংস্থার চেয়ে অনেক বেশি লাভজনক হয়েছে তাদের জন্য। এমনকি করোনাভাইারাসের মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী বিমান চলাচল স্থবির হয়ে গেলেও তারা টিকে আছেন ভালো ভাবেই। কারণ প্রতিষ্ঠানটির ছোট ছোট রুট এবং প্রাইভেট এয়ারপোর্ট ব্যবহারের কারণে অনেকেই জনসমাগম এড়াতে এই বিমান সার্ভিস বেছে নিয়েছেন।
অনেক মানুষের আগ্রহ বেড়েছে নতুন ধারার এই বিমান সেবার প্রতি। কাজেই এই ধরণের বিমান সার্ভিসে হাইব্রিড বিমান যুক্ত হলে সেটি তাদের ব্যবসায়কে আরো সমৃদ্ধ করবে। এবং আরো অনেক কোম্পানি তাদের ছোট বিমানগুলোকে হাইব্রিডে রূপান্তরিত করতে আগ্রহী হবে।
অনেকে বলছেন, সার্ফ এয়ারের মতো আঞ্চলিক এই বিমান সেবাগুলোর জন্য হাইব্রিড বিমান সেবা কতটা সুবিধা বয়ে নিয়ে আসবে সেটি নিয়ে আগে ভাগেই ধারণা পাওয়া কঠিন। যদিও আশা করা হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ জ্বালানি খরচ কমাবে হাইব্রিড বিমান, কোন কোন ক্ষেত্রে সেটি ৫০ শতাংশে গিয়ে পৌছবে বলেও অনেকে আশাবাদী।
জ্বালানি খরচ বিমান সার্ভিসের একটি ছোট অংশ মাত্র। এই সেক্টরের আরো অনেক বড় বড় খরচের খাত রয়েছে। যেমন কর্মীদের বেতন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সবচেয়ে বড় বিনিয়োগের খাতটি হচ্ছে এয়ারক্রাফট কেনা বা নির্মাণ খরচ।
২০১৯ সালের এক হিসেবে দেখা গেছে ওই বছর আমেরিকান এয়ারলাইন্সের লেবার কস্ট বা কর্মীদের পারিশ্রমিকের পেছনে খরচ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির সর্বমোট ব্যয়ের ৩২ শতাংশের বেশি। সেখানে ওই বছর এয়ারলাইন্সটি জ্বালানি খাতে খরচ করেছে ১৮ শতাংশের কিছু কম। অবশ্য অত্যাধুনিক সফটওয়ার নির্ভর হওয়ার কারণে এই এয়ারলাইন্সটির কর্মী ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনার খরচ পৃথিবীর বড় বড় এয়ারলাইন্সগুলোর তুলনায় অনেককাংশে কম। যেটি সার্ফ এয়ারের জন্য ইতিবাচক হয়ে উঠবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
কাজেই হাইব্রিড বিমানের নতুন জগতে বিশ্ব যদি এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে প্রবেশ করে, সেটি সার্ফ এয়ারকে বিশ্বব্যাপী নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবে এভিয়েশন জগতে। তবে তার চেয়েও বড় কথা বিমানের যাত্রী পরিবহণে সৃষ্টি হবে নতুন দিগন্তের। কম খরচ ও পরিবেশ বান্ধব হিসেবে পরিচিত হাইব্রিড বিমান এভিয়েশন সেক্টরে যোগ করবে নতুন মাত্রা।