বাধা ডিঙিয়ে সবাই পথ তৈরি করে নিতে পারে না, যারা পারে তারাই অনুকরণীয়। পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলেও যারা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, তাদের কথা আলাদা করেই বলতে হয়। রক্ষণশীল আরব সমাজব্যবস্থা অনেকভাবেই নারীদের জন্য প্রতিকূলতা তৈরি করে রেখেছে। সেখানে একজন চাইলেই যেকোনো পেশা বেছে নিতে পারেন না; কিন্তু সেই জায়গা থেকেও নানা অঙ্গনে আলো ছড়িয়েছেন এমন কয়েকজন আরব নারীকে নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন। নানান সীমাবদ্ধতার মাঝখান থেকেও তাদের কেউ ফাইটার জেটের পাইলট, কেউ চিত্র পরিচালক, কেউ খেলাধূলায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে নারীর ক্ষমতায়ন আর এগিয়ে চলার বড় উদাহরণ সৌদি ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, মানবিক সহায়তা কর্মী প্রিন্সেস রিমা বিনতে বন্দর। সৌদি রাজপরিবারের এই সদস্য বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত। সৌদি আরবের ইতিহাসে প্রথম নারী রাষ্ট্রদূত তিনি।
কিংডম অব সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে সৌদি ছিলেন প্রিন্সেস রিমার দাদার বাবা। আর বাদশাহ ফয়সাল ছিলেন তার নানা। অর্থাৎ মা ও বাবা দুজনের দিক থেকেই তিনি রাজ পরিবারের সদস্য। অনেক বছর ধরেই সৌদি আরবে নারীদের সমাজের সব সেক্টরে ভূমিকা রাখার সুযোগের পক্ষে কাজ করছেন তিনি। যার পুরস্কার হিসেবে সৌদি ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নারী বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন এবং ২০২০ সালের জুলাইয়ে প্রথম সৌদি নারী হিসেবে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন প্রিন্সেস রিমা। উপসাগরীয় দেশগুলোর স্পেশাল অলিম্পিক ফেডারেশনের প্রধানও তিনি।
লেবাননি পরিচালক নাদিন লাবাকির কাফরানিয়াম ছবিটি ২০১৮ সালে স্থান পেয়েছে ফ্রান্সের বিখ্যাত কান চলচ্চিত্র উৎসবে। এটি ছিলো অভিনয় থেকে পরিচালনায় আসা লাবাকির পরিচালিত তৃতীয় ফিচার ফিল্ম। নিজেই লিখেছেন অসাধারণ এক গল্প, যেখানে সহিংস ঘটনার দায়ে কারাদণ্ড ভোগ করা একটি ১২ বছরের শিশু তার পিতা মাতার বিরুদ্ধে মামলা করে অবহেলা আর তার বিপথ গামীতার জন্য দায়ী করে।
এই গল্প, অসাধারণ নির্মাণ আর শিশু শিল্পীর দুর্দন্ত অভিনয়ই ছবিটিকে নিয়ে গেছে বিশ্ব দরবারে। কান চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মানজনক জুড়ি প্রাইজ লাভ করে ছবিটি।এর মাধ্যমে প্রথম আরব নারী হিসেবে এই পুরস্কার জেতেন তিনি। আর লেবানিজ নাগরিক হিেেসব দ্বিতীয়। ছবিটি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের সেরা বিদেশী ভাষার ছবিসহ একাধিক ক্যাটাগরিতে মনোনয়নও পায়।এছাড়া ২০১৯ গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডে সমালোচকদের দৃষ্টিতে সেরা সিনেমা হিসেবে নির্বাচিত হয় ছবিটি। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই লেবাননে যুদ্ধ, দারিদ্রতা, বৈষম্যসহ অনেক বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ নাদিন লাবাকি। সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারীদের পিছিয়ে পড়া থেকে বের করে আনতেও কাজ করছেন তিনি।
২০১৯ সালে নিউ ইয়র্কে ওয়ার্ল্ড নাম্বার ওয়ানরানিম এল ওয়েলিলিকে পরাজিত করে মিসরীয় স্কোয়াশ তারকা নুর আল শেরবিনি তৃতীয়বারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন, অথচ তখনও তার বয়স ত্রিশ পেরোয়নি। আল শেরবিনি যেন খেলার জগতে এসেছেনই ইতিহাস গড়তে। ২০০৯ সালে তিনি মাত্র ৯ বছর বয়সে ওয়ার্ল্ড জুনিয়র স্কোয়াশে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। যেটি ছিলো সবচেয়ে কম বয়সে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড। ২০১৫ সালে নারীদের স্কোয়াশেও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন সবচেয়ে কম বয়সে শিরোপা জেতার রেডর্ক গড়ে।
সব মিলে ছয় বার ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন শিপের ফাইনাল খেলেছেন, শিরোপা জিতেছেন চার বার। তিন বার উঠেছেন ব্রিটিশ ওপেনের ফাইনালে, যার দুবারই শিরোপা নিয়ে দেশে ফিরেছেন।
মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় জন্ম নেয়া নুর আল শেরবিনি মাত্র ছয় বছর বয়সে স্কোয়াশ খেলতে শুরু করেন। বয়স ৮ হওয়ার আগেই খেলতে শুরু করেন টুর্নামেন্টে। যার কারণে আরব বিশ্বের প্রতিনিধি হয়ে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে দাপট দেখাতে কোন বেগ পেতে হয়নি তাকে।
প্রথম মুসলিম নারী এমপি হিসেবেযুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে ইতিহাস গড়েছেন রাশিদা তালিব। ফিলিস্তিনি অভিবাসীর কন্যা রাশিদা মিশিগান অঙ্গরাষ্ট্রের থার্টিনথ ডিস্ট্রিক্ট থেকে মার্কিন পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।২০১৮ সালের নভেম্বরের উপ নির্বাচনে তার বিরুদ্ধে রিপাবলিকনাদের প্রার্থী না থাকায় অনেকটা সহজেই জয় পান তিনি। এর আগে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মিশিগান অঙ্গরাষ্ট্রের আইনসভার সদস্য ছিলেন রাশিদা।
মিশিগানের ডেট্রয়েটে জন্ম নেয়া রাশিদার বাবা মা ফিলিস্তিন থেকে নিকারাগুয়া হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী হন। ১৪ ভাইবোনের সবার বড় রাশিদা ওয়াইন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে রাজনীতির ওপর ডিগ্রি নিয়ে নাম লেখান রাজনীতিতে।
ডেমোক্র্যাট দলীয় এই রাজনীতিক পিতৃভূমি ফিলিস্তিনের অধিকার আদায়ে সব সময় স্বোচ্চার। ইসরাইলি বিরোধী ক্যাম্পেইন গ্রুপ বিডিএসের জোরালো সমর্থক তিনি। এছাড়া বিভিন্ন সময় সৌদি আরবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনাও করেছেন তিনি। ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি পার্লামেন্টে যোগ দেয়ার প্রথম দিন থেকেই তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইমপিচমিন্টের পক্ষে কাজ করেছেন। ইতোমধ্যেই হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের আগামী নির্বাচনের জন্যও দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করেছেন রাশিদা।
২০১০ সালে আলজেরিয়ার সেনাবাহিনীর জেনারেল পদে উন্নীত হনফাতিমা জোহরা আরদজৌনে। আরব বিশ্বের প্রথম নারী জেনারেল তিনি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডিগ্রি নেয়া ফাতিমা একজন রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ১৯৮০’র দশকে আলজেরিয়ার রক্তবিজ্ঞান গবেষণার পথিকৃত। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার দীর্ঘ স্বাধীনতার যুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন তিনি।
ফাতিমা জোহরার দেখানো পথ ধরেই আলজেরিয়ার সামরিক বাহিনীতে নারীদের যোগদান বাড়তে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে আরো তিনজন নারী কর্মকর্তা জেনারেল ব্যাজ পরেছেন। বর্তমানে আলজেরিয়ার আর্মি সেন্ট্রাল হাসপাতলের ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জেনারেল ফাতিমা। তার স্বামীও সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের একজন কর্মকর্তা।
বাহরাইনের রাজ পরিবারের প্রথম নারী সদস্য হিসেবে ফাইটার জেটের পাইলট হয়েছেন শেখ আয়শা বিনতে রশিদ আল খলিফা। ব্রিটেনের বিখ্যাত রয়াল মিলিটারি অ্যাকডেমি থেকে পড়াশোনা শেষ করে ২০১৮ সালে একটি বিএই হক যুদ্ধ বিমান নিয়ে আকাশে উড়ে ইতিহাস গড়েন আয়শা।
বর্তমানে রয়াল বাহরাইন এয়ার ফোর্সের পাইলট অফিসার হিসেবে কাজ করছেন আয়শা।২০২০ সালের নভেম্বরে মৃত্যুবরণকারী দেশটির দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী খলিফা বিন সালমান ছিলেন তারা দাদা।
অবশ্য আয়শার সাথে এই তালিকায় আরব বিশ্বের আরো দুজনকে রাখতে হবে। তারা হলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুই বোন আয়শা আল মানসৌরি ও মরিয়ম আল মানসৌরি। আয়শা মানসৌরিপ্রথম আমিরাতি নারী হিসেবে ইতিহাদ এয়ারওয়েজের যাত্রীবাহী এয়ারবাস এ-৩৮০ ফ্লাইট নিয়ে উড়াল দেন। আর তার ছোট বোন মরিয়ম আবুধাবির খলিফা বিন জায়েদ এয়ার কলেজ থেকে পাস করে আমিরাত এয়ারফোর্সের ফাইটার পাইলট হিসেবে যোগ দেন।
২০১৭ সালে এই দলে যোগ দিয়েছেন দুবাইয়ের রাজপরিবারের সদস্য শেখ মোজাহ আল মাখতুম। ২০১৬ সালে অক্সফোর্ড এভিয়েশন অ্যাকাডেমি থেকে পাস করা প্রিন্সেস মোজাহ বাণিজ্যিক বিমান চালান। ২০১৮ সালে ভোগ ম্যাগাজিনকে তিনি বলেছিলেন, ছোট বেলায় পরিবারের সাথে যখন বিমানে চরতাম, আমি সব সময় ককপিটে বসতে চাইতাম। সেখানে বসে পাইলটদের কাছে নানা প্রশ্ন করে কৌতুহল মেটাতাম। আমার ভয় করতো না, বরং সব সময়ই চাইতাম নিজে বিমান চালাতে।
তিউনিসিয়ান মডেল ও ফ্যাশন ডিজাইনার কেনজা ফারুতির নাম আরব সফল নারীদের তালিকায় অবশ্যই রাখতে হবে। দীর্ঘ ১৮ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি আরমানি, সেলিন, ভ্যালেন্তিনোসহ সব নামীদামী ফ্যাশন হাউজের পোশাক পরে র্যাম্পে হেটেছেন। মডেল হয়েছেন বিখ্যাত ফ্যাশন ম্যাগাজিন ভোগের পাতায়ও।
২০১১ সালে প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে স্পোর্টস ইলস্ট্রেটরের সুইম স্যুটের মডেল হয়েছেন ফারুতি। পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তন ও নারীর ক্ষমতায়নেও কাজ করেছেন এই মডেল। মডেলদের অধিকার নিয়ে নিউ ইয়র্কে তার ক্যাম্পেইন বেশ আলোচিত ছিলো।
সৌদি চলচ্চিত্র পরিচালক হাইফা আল মানসুর অনেক বড় বাধা ডিঙিয়েছেন কর্মক্ষেত্রে। ২০১২ সালে প্রথম সৌদি নারী পরিচালক হিসেবে তিনি ইতিহাস গড়েন। ওই বছর হাইফা নির্মাণ করেন ওয়াদজদা নামের একটি চলচ্চিত্র। যেখানে একটি কিশোরী সাইকেল চালানো শিখতে চায়; কিন্তু তার দেশে সেটি করার অনুমতি নেই। পুরোপুরি সৌদি আরবে চিত্রায়িত প্রথম ফিচার ফিল্মও ছিলো সেটি। ওই বছর সিনেমাটি সৌদি আরবের প্রথম সিনেমা হিসেবে বিদেশী ভাষার ক্যাটাগরিতে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য জমা দেয়া হয়।
অস্কার জিততে না পারলেও সেটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কিছু পুরস্কার জিতেছে, যার মধ্যে ছিলো দুবাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মুহর আরব অ্যাওয়ার্ড।
ওয়াদজদা সিনেমাটির সফলতার পর হাইফা আল মনসুর আরো দুটি ফিচার ফিল্ম নির্মাণ করেন যার একটি ছিলো ইংলিশ লেখক মেরি শেলির বায়েপিক ও অন্যটি ত্রিশা আর থমাসের উপন্যাসের আলোকে আলোচিত রোমান্টিক কমেডি সিনেমা ন্যাপিলি এভার আফটার।