প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ একটি দেশের ক্ষমতা ও রাজনীতির কেন্দ্র। আবার বহির্বিশ্বের কাছে কখনও এটি দেশটির প্রভাব-প্রতিপত্তি কিংবা শৌর্যবীর্যের প্রতীক। সেই প্রাচীনকাল থেকেই রাজা বাদশাহরা এসব কথা মাথায় রেখে প্রাসাদ বানাতেন। আধুনিক যুগেও সেটি হারিয়ে যায়নি। ওয়াশিংটন ডিসির হোয়াইট হাউজ কিংবা মস্কোর ক্রেমলিনের নাম শুনলেই যেমন চোখে ভাসে সৌন্দর্য আর আভিজাত্যের মিশ্রণে তৈরি বিশাল এক বাড়ি। এক সময়ের প্রতাপশালী ওসমানীয় সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার আজকের তুরস্কেও রয়েছে তেমনি এক প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ। রাজধানী আঙ্কারায় পাহাড়ের চূড়ায় সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি বিশাল এই প্রাসাদ।
রাজধানী আঙ্কারায় বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে আতাতুর্ক ফরেস্ট ফার্ম। উদ্যান, পার্ক, বেশকিছু কৃষি খামার, গ্রিনহাউজ, ডেইরি ফার্মসহ অনেক কিছুই রয়েছে সবুজে ঘেরা বিশাল এ এলাকায়। এ ফার্মে আছে একটি চিড়িয়াখানাও। বিশাল এ ফার্ম এলাকার ভেতরেই একটি পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ। চারপাশে সবুজ বনভূমি, তার মাঝখানে পাহাড়ের ওপর সাদা রঙের প্রাসাদটি দেখতে সত্যিই অপূর্ব। অফিশিয়াল নাম প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস হলেও সাধারণভাবে এটি ‘আক সারায়’ নামে পরিচিত, যার বাংলা অর্থ সাদা প্রাসাদ।
প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ানের নতুন তুরস্ক ধারণার অংশ হিসেবেই প্রেসিডেন্ট প্রাসাদটি তৈরি করা হয়েছে। এরদোয়ান তুরস্কের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর প্রথম দিকে মনোযোগী ছিলেন অর্থনৈতিক অবস্থা মজবুত করা, প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা আনা এবং নাগরিক অধিকারগুলো যথাযথভাবে জনগনের কাছে পৌছে দেয়ার।
এরপর শুরু হয় তুরস্ককে রাজনীতি ও সামরিক শক্তিতে বিশে^র সেরা দেশগুলোর তালিকায় নেয়ার মহাপরিকল্পনা। তুরস্ককে নতুনভাবে বিশ^বাসীর কাছে তুলে ধরাই ছিলো তার নিউ তুর্কি ধারণার গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। নেয়া হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিও।
এ সময়ই বিশে^র মাঝে উল্লেখযোগ্য একটি প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া তুরস্কের সরকার। জায়গা হিসেবে বাছাই করা হয় আতাতুর্ক ফরেস্ট ফার্মের সবুজে ঘেরা মনোরোম পরিবেশকে। দীর্ঘ নির্মাণ কাজ শেষে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর ভবনটি উদ্বোধন করা হয়। দিনটি ছিলো তুরস্কের প্রজাতন্ত্র দিবস।
ভ্যাটিক্যানের রাষ্টপ্রধান ও খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস প্রথম রাষ্টপ্রধান হিসেবে ২০১৪ সালের ২৮ নভেম্বর নতুন এই প্রাসাদে আসেন। তিন দিন পরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে এই প্রসাদে আতিথিয়েতা দেন রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। ২০১৬ সালের ১৫ জানুয়ারি তুরস্কের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সময় এই প্রাসাদে বোমা ফেলেছিল বিদ্রোহী সেনারা। যদিও সে সময় এরদোয়ান ছুটিতে আঙ্কারার বাইরে ছিলেন।
প্যালেসটিতে মূল রেসিডেন্স ভবন ছাড়াও রয়েছে দুটি সাপোর্ট বিল্ডিং। মূলত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অতিথিদের সংবর্ধনা, গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের কাজে এ ভবন দুটি ব্যবহৃত হয়। দ্বাদ্বশ শতাব্দীর সেলজুক সম্রাজ্যযুগীয় স্থাপত্যশৈলীতে এই প্রাসাদের নকশা করেছেন তুর্কি আর্কিটেক্ট শফিক বিরকিয়ে। পাশাপাশি ওসমানীয় ও তুর্কি স্থাপত্যশেলীর ছোয়াও আছে ভবনটিতে।
সব মিলে এই প্রাসাদের ফ্লোর স্পেস ৩ লাখ বর্গমিটার বা ৩২ লাখ বর্গফুট। আয়তনের দিক থেকে প্রাসাদটি যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজ, রাশিয়ার ক্রেমলিন কিংবা ফ্রান্সের ভার্সেই প্যালেসের চেয়েও বড়। শুধু আয়তনই নয়, ভেতরের সাজসজ্জা, নির্মাণশৈলৗ ও সৌন্দর্যের দিক থেকেও এটি বিশে^র কোন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের চেয়ে কম নয়। কক্ষ আছে ১১৫০টি। এছাড়া গেস্টহাউজ, কমিউনিকেশন রুম, সিচুয়েশন রুম, বাঙ্কার, কংগ্রেস সেন্টার আছে এখানে। আছে প্রেসিডেন্টের অফিস রুম, মিটিং রুম, কনফারেন্স রুম, ব্রিফিং রুম।
এই প্রাসাদে আছে বড় ও কারুকার্জ খচিত একটি মসজিদ, যাতে এক সাথে নামাজ পড়তে পারবে ৪ হাজার মুসল্লি। ভবনের বাইরে রয়েছে বিশাল এক চত্বর, বোটানিক্যাল গার্ডেন ফোয়ারা।
এর ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই উন্নতমানের। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবহার করা হয়েছে উন্নতমানের সেন্সর। এমন কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে যাতে এই ভবনটিতে কোন গুপ্তচর সংস্থা টেলিফোনে আড়ি পাততে না পারে। শত্রুরা যাতে গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য কোন যন্ত্র স্থাপন করতে না পারে সে জন্য এই ভবনে এমন একটি অফিস রয়েছে যেখানে কোন ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী রাখা হয়নি।
প্রেসিডেন্ট কমপ্লেক্সের রয়েছে উন্নতমানের নিজস্ব একটি ল্যাবরেটরি, সেখানে কাজ করেন অভিজ্ঞ কর্মীরা। যাতে প্রেসিডেন্টের জন্য ক্ষতিকর এমন কোন পারমাণবিক, জীবানু ও রাসায়নিক আক্রমণ দ্রুত সনাক্ত করা যায়।
এই প্রাসাদের অত্যন্ত সুরক্ষিত একটি বাঙ্কারে রয়েছে অত্যন্ত গোপনীয় স্পেশাল অপারেশন কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সেন্টার। সেন্টারটিতে রয়েছে ১৪৩টি স্ক্রিনযুক্ত ভিজ্যুয়াল কমান্ড সিস্টেম যেখানে ড্রোন, সিসিটিভি, টেলিভিশন, ও ৩জি ট্রান্সমিশনের মাধ্য তুরস্কের ৮১ প্রদেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। যে কোন সঙ্কটময় মুহূর্তে এই সেন্টার থেকে দুর্যোগ ও জরুরী ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি অথরিটি, সশস্ত্র বাহিনীসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো দফতরকে নির্দেশনা দিতে পারবেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট।
এখানে জমা হওয়া সব তথ্য সংরক্ষণ করা হয় দুটি বিশেষ সুপার কম্পিউটারে, যেগুলো গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সহায়তা করে নিরপত্তা সংক্রান্ত খুটিনাটি তথ্য পেতে। এই কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সেন্টার থেকে যে কোন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা কিংবা অনুসরণ করা যায় বায়োমেট্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে। প্রেসিডেন্টের সুরক্ষার পাশাপাশি সাধারন মানুষের সাথে এই প্রাসাদের সংযোগের দিকটিকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
এই প্রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সে রয়েছে বিশাল একটি লাইব্রেরি। যেখানে বইয়ের সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি। মোট ১৩৪টি ভাষার বিভিন্ন ধরণের বই রয়েছে এখানে, এছাড়া আছে কয়েক লাখ প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও নানান ধরণের পান্ডুলিপি। ১০৭২ সালে সংকলিত তুর্কি ভাষার প্রথম ডিকশনারিসহ অনেক বিরল সংগ্রহ রয়েছে এখানে। বিভিন্ন দেশ থেকে তুর্কি সরকার ও প্রেসিডেন্টের উপহার হিসেবে পাওয়া বইগুলোও রাখা হয় এই লাইব্রেরিতে। এছাড়া তুর্কি সরকার নিজস্ব উদ্যোগেও বিশে^র বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বই সংগ্রহ করে।
তুরস্কের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি এটি। ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি এই লাইব্রেরির উদ্বোধন করে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। ১ লাখ ২৫ হাজার বর্গমিটার জায়গা জুড়ে এই লাইব্রেরিতে এক সাথে ৫ হাজার লোক অধ্যায়ন করতে পারে। সাদা ও গোলাপি রংয়ের পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে লাইব্রেরি ভবনটি। ২০১৬ সালে এই লাইব্রেরিটি স্থাপনের উদ্যোগ নেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। এরপর তিনি এ বিষয়ে দেশটির স্কলার, লাইব্রেরিয়ান ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে সহযোগিতা ও পরামর্শ নেন। তুরস্কের কবি, সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষকসহ অনেকেই নিজস্ব সংগ্রহশালা থেকে এখানে বই উপহার দিয়েছেন। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের উপহার দেয়া বইও রয়েছে প্রচুর।
লাইব্রেরিটির প্রবেশদ্বার ও ভেতরের ব্যবস্থা এমন রাখা হয়েছে যাতে একজন হুইল চেয়ার নিয়েও সর্বত্র যেতে পারেন। দুটি প্রযুক্তি কোম্পানির তত্ত্বাবধানে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্যও রাখা হয়েছে অধ্যায়নের ব্যবস্থা। আছে বুক কনভেয়ার সিস্টেম, যার মাধ্যমে পাঠকরা কোন বইয়ের বিষয়ে চাহিদার কথা জানালে, লাইব্রেরিয়ানরা সেটি খুজে এই কনভেয়ার বেল্টে করে পাঠিয়ে দেবে তার টেবিলে।
লাইব্রেরিতে রয়েছে চিহানুমা নামের একটি হল যেখানে বইয়ের ১৬টি কলাম রাখা হয়েছে ১৬টি তুর্কি সম্রাজ্যের স্মরণে। সাড়ে ৩ হাজার বর্গমিটারের এই হলে রয়েছে ২ লাখের বেশি বই, আর এখানে এক সাথে বসতে পারবেন ২২৪ জন পাঠক। বিভিন্ন দেশ ও দেশের দূতাবাস থেকে উপহার পাওয়া বইগুলো রাখা হয়েছে এই হলে।
চিহানুমা হলে রয়েছে ৩২ মিটার উচু একটি গম্ভুজ। যার গায়ে খচিত আছে পবিত্র কোরআনের সুরা আলাকের ৪ ও ৫ নম্বর আয়াত। যার অর্থ- ‘যিনি কলমের মাধ্যমে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন এমন জ্ঞান যা মানুষ জানতো না।’
এই লাইব্রেরিতে গবেষকদের জন্য আবার আছে পৃথক একটি রিসার্চ লাইব্রেরি। যার সংগ্রহ ২০ হাজার বই। রিসার্চ লাইব্রেরিতে রয়েছে গ্রুপ স্টাডির জন্য ২০টি আলাদা কক্ষ। রয়েছে নাসিরউদ্দিন হোজ্জা চিলড্রেনস কর্নার। আরো আছে ইয়ুথ কর্নার, মাল্টিমিডিয়া কর্নার, ম্যাগাজিন কর্নার এবং আন্তর্জাতিক মানের একটি কনফারেন্স রুম।
এরদোয়ানের বিশাল এই প্রাসাদ তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অবশ্য এই খরচের পরিমাণ নিয়ে দেশটির বিরোধী মতের রাজনীতিকরা সমালোচনাও করেছেন। পশ্চিমা গনমাধ্যমেও এই ভবন নির্মানের নানা সমালোচনা হয়েছে। এই ভবন নির্মাণের মাঝপথে বাজেট বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে বিরোধীরা আপত্তি তুলেছিলো। একবার আঙ্কারার প্রশাসনিক আদালত এটির নির্মাণ বন্ধেরও নির্দেশ দিয়েছিল। ফার্ম এলাকায় প্রাসাদ নির্মাণের কারণে পরিবেশের ক্ষতি হবে বলেও দাবি করে পরিবেশবাদীরা। তবে তাদের এসব দাবি ২০১৫ সালের নির্বাচনে ধোপে টেকেনি। ক্ষমতাসীন জাস্টিস এন্ড ডেভেলপেমন্ট পার্টি বলছে, তাদের দীর্ঘ শাসনামলে তুরস্ককে নতুন করে চিনছে বিশ^। যে কারণে তুরস্কের একটি সেরা প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেস মোটেও অপ্রোয়জনীয় কোন স্থাপনা নয়।