প্রথম বিমান কোম্পানি বোয়িং


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ১১ মার্চ ২০২১, ১৬:৪৫

বেসামরিক বিমান চলাচলের প্রসঙ্গ উঠলে যে নামটি সবার আগে মনে আসে সেটি বোয়িং। বিলাসবহুল আর বিশাল সব বিমান তৈরি করে বিমান নির্মাণ শিল্পের সবচেয়ে বড় এই প্রতিষ্ঠানটি। তবে শুধু যাত্রীবাহী বিমানই নয়, সামরিক বিমান, বিমানের যন্ত্রাংশ, স্যাটেলাইট, ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণসহ অনেক ক্ষেত্রেই সাফল্যের সাথে ব্যবসা করছে একজন কাঠ ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠা করা কোম্পানিটি।

বিশ্বের সেরা যাত্রীবাহী বিমানগুলোর তালিকা করলে বেশির ভাগ মানুষই বোয়িং ৭৮৭ কে এক নম্বরে রাখেন। ড্রিমলাইনার নামেই বেশি পরিচিত এই বিমানটি এখন সার্ভিসে আছে বিশ্বের সেরা তিন বিমান পরিবহন সংস্থা কাতার এয়ারওয়েজ, এয়ার কানাডা ও ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে। চমৎকার ভেন্টিলেশন সিস্টেম,কম শব্দ এবং বিলাসবহুল ও আরামদায়ক কেবিনের সব সুবিধাই রয়েছে এতে, যা যাত্রাকে করে উপভোগ্য।কম জ¦ালানি খরচের কারণে বিমানটি মালিক পক্ষের জন্যও সুবিধাজনক।

এই কোম্পানির রয়েছে ৭০০ যাত্রী নিয়ে উড্ডয়নে সক্ষম বোয়িং ৭৪৭-৮ এর মতো দানবাকৃতির বিমান। কিংবা এফ ফিফটিন স্ট্রাইক ইগল ফাইটার জেট।এসব বিমানের নির্মাতা দ্যা বোয়িং কোম্পানি। বিমান শিল্পে বিশ্বের সেরা দুটি কোম্পানির একটি বোয়িং। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানিটির হেড অফিস শিকাগো শহরে। যাত্রীবাহী বিমান ছাড়াও সামরিক বিমান, হেলিকপ্টার, রকেট, স্যাটেলাইট, টেলিকমিউনিকেশন সামগ্রী এমনকি মিসাইলও প্রস্তুত করে কোম্পানিটি।

১৯১৬ সালের জুলাইয়ে দ্য বোয়িং কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন অঙ্গরাষ্ট্রের শিয়াটলের এক কাঠ ব্যবসায়ী। নাম তার উইলিয়াম বোয়িং। কাঠ ব্যবসায়ী থেকে উইলিয়াম বোয়িং কিভাবে বিমান নির্মাণের ব্যবসায় শুরু করেছিলেন সেটি নিয়ে চমৎকার একটি গল্প রয়েছে। তার পুরো নাম ছিলো উইলিয়াম ই বোয়িং। জার্মান বাবা ও অস্ট্রিয় মায়ের সংসারে জন্ম তার যুক্তরাষ্ট্রেই। তার অভিবাসী বাবা ছিলেন একজন শ্রমিক। ৮ বছর বয়সে বাবার মৃত্যু আর মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের কারণে তার জীবনে নেমে আসে অনিশ্চয়তা। কিন্তু বোয়িং ছিলেন সাহসী আর উদ্যোমী। সেটাই তাকে শেষ পর্যন্ত সফল হতে সহায়তা করেছে।

উইলিয়াম বোয়িং কানেক্টিকাট অঙ্গরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলেও গ্রাজুয়েশন শেষ করার আগেই শুরু করেন ব্যবসা। ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে বেশ কিছু বনভুমি কিনে কাঠ ব্যবাসায় বিনিয়োগ করেন নিজের জমানো অর্থ। পশ্চিম উপকূল থেকে কাঠ কেটে নৌপথে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলীয় এলাকায় এনে বিক্রি করতেন উইলিয়াম বোয়িং। এই ব্যবসায় অল্প সময়ে প্রচুর মুনাফা করতে থাকেন। প্রতিষ্ঠা করেন গ্রিনউড টিম্বার কোম্পানি। ব্যবসার সুবিধার্থে নিজেই নৌকা তৈরির পরিকল্পনা করছিলেন বোয়িং। সে সময় শিয়াটলে একটি মেলায় গিয়ে তিনি জীবনে প্রথমবারের মতো বিমান দেখতে পান। এরপর বদলে যায় তার জীবনের গল্প।

উড়ন্ত এই যানটি দেখে বোয়িং এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে কিছুদিন পর লস এঞ্জেলেসে যুক্তরাষ্ট্রের এভিয়েশন জগতের প্রবাদ পুরুষ গ্লেন এল মার্টিনের ফ্লাইং স্কুলে ভর্তি হয়ে যান। সেখান থেকে একটি বিমান কিনেও নেন। সেই প্রতিষ্ঠানের একজন পালইটকে নিয়ে নিজের বিমানে চড়ে শিয়াটলে ফিরে আসেন বোয়িং। সেই পাইলটের কাছ থেকে বিমান চালনা শিখতে থাকেন।

এর কিছুদিন পর বিমানটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে এল মার্টিন তাকে জানান, এর মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতে কয়েক মাস সময় লাগবে।এতে অধৈর্য হয়ে বোয়িং তার বন্ধু ও মার্কিন নৌ বাহিনীর কমান্ডার জর্জ ওয়েস্টারভেল্টকে প্রস্তাব দেন যৌথভাবে বিমান নির্মাণ কারখানা প্রতিষ্ঠার। যেই ভাবা সেই কাজ। দ্রুতই তাদের কারাখানায় একটি সি-প্লেন তৈরি হয়, যেটির পারফরম্যান্স ছিলো চমৎকার।

বিমান তৈরির এই প্রাথমিক সাফল্যই উইলিয়াম বোয়িংকে বাণিজ্যিকভাবে বিমান নির্মাণে আগ্রহী করে। এবং দ্রুতই কাঠের ব্যবসা বাদ দিয়ে বিমান নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। কোম্পানির নাম দেয়া হয় প্যাসিফিক অ্যারো প্রোডাক্ট কোম্পানি। সেটি ছিলো ১৯১৬ সালের জুন মাস।

কয়েক মাস পরে প্রতিষ্ঠানের নাম পাল্টে রাখেন বোয়িং এয়ারপ্লেন কোম্পানি। ১৯১৭ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে বিমানের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং মার্কিন নৌ বাহিনীর কাছ থেকে ৫০টি বিমানের অর্ডার পায় তার কোম্পানি। এতেই পাল্টে যায় প্রতিষ্ঠানটির ভাগ্য। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি উইলিয়াম বোয়িংকে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ডাক সার্ভিসের ইজারা নেয় তার প্রতিষ্ঠান। কয়েকদিন পর ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স নামে যাত্রী পরিবহন সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।১৯৫৬ সালে আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এই সফল শিল্প উদ্যোক্তা। কিন্তু তার গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান আজো দাপিয়ে বেড়ায়ে এভিয়েশন সেক্টরে।

গত শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠিত হলেও বোয়িং সফল প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত পেতে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরপর। ১৯৬০ এর দশকে কোম্পানিটি কিনে নিয়েছিল ভেটরোল কর্পোরেশন নামের একটি হেলিকপ্টার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। এরপর তারা মনোযোগ দেয় মহাশূন্য যান নির্মাণে। এছাড়া নৌযান, কৃষি যন্ত্রপাতি, জ¦ালানি উৎপাদন খাতেও ব্যবসায় সম্প্রসারণ করে প্রতিষ্ঠানটি।

১৯৯৫ সালে রাশিয়া, ইউক্রেন ও নরওয়ের কোম্পানির সাথে যৌথভাবে ভাসমান স্যাটেলাইট লঞ্চপ্যাড নির্মাণ করে বোয়িং। এরপর তারা কিনে নেয় স্যাটেলাইট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিউজেস ইলেকট্রনিক্স।১৯৯৭ সালে এসে বোয়িংয়ের সাথে একীভূত হয় ম্যাকডোনেল ডগলাস নামের আরেকটি কোম্পানি।

বর্তমানে বিশ্বে বিভিন্ন বিমান পরিবহন সংস্থায় ১০ হাজারে বেশি বোয়িংয়ের তৈরি এয়ারক্রাফট সার্ভিসে যুক্ত রয়েছে। এছাড়া প্রাইভেট বিমান রয়েছে আরো কয়েক হাজার। বর্তমানে কোম্পানিটির হাতে প্রায় ৬ হাজার বিমান নির্মাণের অর্ডার রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নয়টি অঙ্গরাষ্ট্রে রয়েছে এর কারখানা ও অফিস। ২০১৮ সালে কোম্পানিটি ইউরোপে তাদের প্রথম কারখানা প্রতিষ্ঠা করে। এছাড়া বোয়িংয়ের শাখা রয়েছে কানাডা, জাপান ও ভারতে। ২০১৯ সালে কোম্পানিটি ৩৮০টি বাণিজ্যিক বিমান, ২২৯টি সামরিক বিমান ২টি স্যাটেলাইট নির্মাণ করেছে।

বর্তমানে বোয়িংয়ের ৫টি মূল বিভাগ রয়েছে। এগুলো হলো- বোয়িং কমার্শিয়াল এয়ারপ্লেনস, বোয়িং ডিফেন্স-স্পেস এন্ড সিকিউরিটি, বোয়িং ক্যাপিটাল, বোয়িং শেয়ার্ড সার্ভিস গ্রুপ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং-অপারেশন্স এন্ড টেকনোলজি।

বোয়িং ডিফেন্স স্পেস এন্ড সিকিউরিটি কোম্পানিটি উন্নত মানের সামরিক যান প্রস্তুত করে। এর মধ্যে রয়েছে বোমারু বিমান, সামরিক হেলিকপ্টার, ফাইটার জেট, নজরদারি বিমান, প্রশিক্ষণ বিমান ইত্যাদি। কোম্পানিটির তৈরি এফ-ফিফটিন স্ট্রাইক ইগল ও সাইলেন্ট ইগল ফাইটার ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, ইসরাইল, দক্ষিণ কোরিয়াসহ কয়েকটি দেশের বিমান বাহিনী। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রভান্ডারে থাকা শক্তিশালী মিনিটম্যান ব্যালেস্টিক মিসাইল তৈরি করেছে বোয়িং। ১১ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে আঘাত হানতে সক্ষম মিসাইলটি পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে পারে। এছাড়া বেশ কয়েক ধরনের ক্রুজ মিসাইলও তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি।

ড্রোন নির্মাণেও বেশ সফলতা দেখিয়েছেবোয়িং ডিফেন্স স্পেস এন্ড সিকিউরিটি কোম্পানি। অন্তত ২০টি মডেলের অ্যাটাক, সার্ভেইল্যান্স ও সাধারণ ড্রোন তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে এক্স-ফোরটি ফাইভ প্যানথম রে কমব্যাট ড্রোন উল্লেখযোগ্য। মহাশূন্যযান নির্মাণেও প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়দের একটি।

বোয়িংয়ের বর্তমান কর্র্মী সংখ্যা১ লাখ ৪১ হাজারের কিছু বেশি। করোনা ভাইরাসের মহামারীরর পর প্রতিষ্ঠানটি তাদের ১২ হাজার কর্মী ছাটাই করেছে,তবে এই সংখ্যা ৩০ হাজারে পৌছেতে পারে। করোনার ধকলে ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা কমে দাড়িয়েছে ৫৮ দশমিক ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটিপণ্য বিক্রি করে আয় করেছে প্রায় ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফরচুন ম্যাগাজিনের হিসেবে ২০১৯ সালের বিশ্বের সেরা ৫০০ কোম্পানির তালিকায় এটির অবস্থান ছিলো ৪০ নম্বরে। আর ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটি নেমে গেছে তালিকার ১২১ নম্বরে।

এর আরেকটি কারণ বোয়িংয়ের ৭৩৭ ম্যাক্স এয়ারপ্লেন প্রত্যাহার করে নেয়া। ২০১৮ সালের শেষ দিকে ও ২০১৯ সালের শুরুতে মাত্র ৬ মাসের মধ্যে এই মডেলের দুটি বিমান প্রায় একই কারণে দুর্ঘটনায় পড়ার পর এই মডেলের ৩৮৭টি বিমান প্রত্যাহার করে নেয়া বোয়িং কোম্পানি। যা তাদের বিরাট আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখী করে। ইন্দোনেশিয়া ও ইথিওপিয়ায় ওই দুটি দুর্ঘটনায় মারা যায় ৩৪৬ জন আরোহী।

এই ঘটনার পরই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি এয়ারবাসের কাছে মার্কেট শেয়ারের শ্রেষ্ঠত্ব হারায় বোয়িং। এছাড়া করোনা মহামারীতেও বড় আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখী হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সব কিছু মিলিয়ে ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো কোম্পানিটিকে টপকে যায় ইউরোপীয় বিমান নির্মাতা কোম্পানি এয়ারবাস। তবে বোয়িংয়ের কর্মী ও কারখানার সংখ্যা এয়ারবাসের চেয়ে বেশি।