হাশিম আমলাকে বলা হয় দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের সবচেয়ে ক্লাসিক, সবচেয়ে শান্ত ব্যটসম্যান। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে একজন অশ্বেতাঙ্গ হয়ে জায়গা করে নিতে তাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে ক্যারিয়ারের অনেকটা সময়। তার ওপর মুসলিম হওয়ার কারণে ইসলামফোবিয়ার চাপ তো ছিলই। তবু তিনি সব কিছু মোকাবিলা করেছেন ব্যাট হাতে। কখনও মুখে টু শব্দটি করেননি। ব্যাটকে তলোয়ার বানিয়েই লড়াই করেছেন সব কিছুর বিরুদ্ধে।
ক্রিকেটে ঠাণ্ডা মাথার খুনি বলতে একটি প্রবাদ রয়েছে, যারা মোটেই আগ্রাসী ভাব না দেখিয়ে ধীরে ধীরে প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হন। সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের খেলাগুলোতেও তাদের কখনো তাড়াহুড়ো কিংবা বলে বলে চারছক্কা হাকানোর চেষ্টা করতে দেখা যায় না। তবু রানের চাকা সচল থাকে, স্ট্রাইক রেটও কখনো কমে না। হাশিম আমলা ছিলেন এমন ক্রিকেটারের যুতসই উদহারন। ব্যক্তিগত জীবনে যেমন শান্ত, চুপচাপ স্বভাবের- ব্যাট হাতে মাঠেও ছিলেন ঠিক তারই প্রতিচ্ছবি। শৈল্পিক ক্রিকেটের এক ফেরিওয়ালা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক এই ওপেনার। ব্যাটিং যদি হয় উপভোগের কোন বস্তু‘, হাশিম আমলা যেন ছিলেন তার নিরুপম শিল্পী।
টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটেই তিনি ছিলেন সমান তালে খেলার যোগ্যতা রাখতেন। পঞ্চাশের নিচে স্ট্রাইক রেট নিয়ে যখন টেস্ট ম্যাচে ব্যাটিং করতেন, মনে হতো এমন শান্ত ক্রিকেটার দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া কষ্ট। আবার ওয়ানডেত রান তুলতেন বলের সাথে পাল্লা দিয়ে, যেখানে তার স্ট্রাইক রেট নব্বুয়ের কাছাকাছি। তবুও শুরুর দিকে অনেকে হাশিম আমলাকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার হিসেবে মানতে চাইতেন না; কিন্তু সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের ক্রিকেটেও তার সেঞ্চুরি রয়েছে দুটি।
বিশ্বের সবচেয়ে জমজমাট ফ্রাঞ্চাইটি টি-টোয়েন্টি লিগ আইপিএলে খেলেছেন দাপটের সাথে। যে কারণে ব্যাটিংয়ের একটি কমপ্লিট প্যাকেজ হিসেবে বিবেচনা করা হতো এই প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানকে। কব্জির মোচড়ে লেগ সাইট ফ্লিক কিংবা দৃষ্টিনন্দন ড্রাইভ- দর্শকদের চোখে প্রশান্তি এনে দিত।
যখন সেরা ফর্মে ছিলেন, পাল্লা দিয়ে রান করেছেন বর্তমান সময়ের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন বিরাট কোহলির সাথে। অনেক ক্ষেত্রে তো কোহলির চেয়েও এগিয়ে ছিলেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে দ্রুততম ২ হাজার, ৫ হাজার ও ৭ হাজার রানের রেকর্ড গড়েন। এসব রেকর্ডে তিনি পেছনে ফেলেছেন ভিভ রিচার্ডস ও বিরাট কোহলিকেও।
ওয়ানডেতে সবচেয়ে কম ইনিংসে ১০টি সেঞ্চুরিতে পৌছানোর কৃতিত্বও হাশিম আমলার। ওয়ানডেতে সব মিলে ১৮১ ম্যাচে প্রায় পঞ্চাশ গড়ে রান করেছেন ৮ হাজারের বেশি। সেঞ্চুরি করেছেন ২৭টি। ১২৪ টেস্টে ২৮ সেঞ্চুরিতে রান করেছেন ৯ হাজারের বেশি। টেস্টে হাশিম আমলার গড় ৪৭ প্রায়। যে কারণে তাকে ক্রিকেটের বড় বড় নামগুলোর পাশে দেখা যাবে এমন আশাই করা হচ্ছিল ; কিন্তু ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের পরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেন। টেস্ট খেলা ছেড়েছেন ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে।
হাশিম আমলার সাফল্যের যাত্রাটা সহজ ছিলো না। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট এখনো বর্ণবাদী যুগ থেকে পুরোপুরি বের হতে পারেনি। দেশটির ক্রিকেটে এখনো শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য। সরকার আইন করে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য কোটা পদ্ধতি চালু করলেও বিভিন্ন সময়ই বর্ণবিদ্বেষী অনেক ঘটনা মিডিয়ায় এসেছে। অশ্বেতাঙ্গ হওয়ার কারণে এই ধকলটা সইতে হয়েছে হাশিম আমলাকেও।
ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো পারফর্ম করে জাতীয় দলে এলেও প্রায়ই বর্ণবেষম্যের শিকার হতে হয়েছে তাকে। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে যখন ভালো করতে পারছিলেন না, তখন অনেকেই তাকে কোটার খেলোয়াড় হিসেবে কটুক্তি করতো। তবে শান্ত আর চুপচাপ স্বভাবে হাশিম আমলা এসবের জবাব দিয়েছেন ব্যাট হাতেই। প্রমাণ করেছেন, কোটা নয়, যোগ্যতা দিয়েই তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রেট ক্রিকেটারের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে শ্বেতাঙ্গ স্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে আমলার পুরো ক্যারিয়ারই ছিলো একটি প্রতিবাদ। অশ্বেতাঙ্গ হয়েও দক্ষিণ আফ্রিকা দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০১২ সালে টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে ওঠে দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই সাথে তারা প্রথম দল দল হিসেবে তিন ফরম্যাটেই এক নম্বর দলের জায়গা নেয়ার গৌরব অর্জন করে। এই অর্জনে বড় ভুমিকা ছিলো হাশিম আমলার।
২০১২ সালের সেই ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট সিরিজটি ছিলো উত্তেজনা আর রোমাঞ্চে ভরা। কারণ পয়েন্ট টেবিলের অবস্থা এমন ছিলো যে, এই সিরিজে যারাই জিতবে তারাই উঠে যাবে আইসিসি টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বরে। এমন সমীকরণ নিয়ে লন্ডনের কেনিনংটন ওভালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে নেমে প্রথম ইনিংসেই ৩১১ রানের নান্দনিক এক ইনিংস খেলে ইতিহাস গড়েন আমলা। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সেটিই একমাত্র ট্রিপল সেঞ্চুরি। লর্ডসে তৃতীয় টেস্টে আবারো ১২১ রানের ইনিংস খেলে দক্ষিণ আফ্রিকার সিরিজ নিশ্চিত করতে ভুমিকা রাখেন আমলা।
বর্ণবাদী আচরণ শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও সইতে হয়েছে এই তারকা ক্রিকেটারকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার যখন অভিষেক সে সময় ইরাক যুদ্ধ চলছিলো। বিশ্বযুদ্ধে ইসলামফোবিয়া চরম আকার ধারণ করেছে, মুসলিমদের গায়ে সন্ত্রাসী ট্যাগ লাগনোর চেষ্টা চলছিলো সর্বত্র। তেমনি একটি সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলে এক দাড়িওয়ালা এক মুসলিম ক্রিকেটারের খেলে যাওয়া সহজ ছিলো না। বিভিন্ন দেশে খেলতে গিয়ে দর্শকদের কটুক্তি সইতে হয়েছে তাকে।
২০০৬ সালের আগস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে কুমার সাঙ্গাকারার ক্যাচ নেয়ার পর অস্ট্রেলিয় ধারাভাষ্যকার ডিন জোনস আমলাকে টেরোরিস্ট হিসেবে কটুক্তি করেন। একে তো ধার্মিক মুসলিম, তার ওপরে অশ্বেতাঙ্গ : দুটি কারণে প্রতিকূলতার মধ্যেই তাকে পথ চলতে হয়েছে।
ডারবানে গুজরাটি অভিবাসী পরিবারে হাশিম আমলার জন্ম ১৯৮৩ সালের ৩১ মার্চ। পুরো নাম হাশিম মোহাম্মাদ আমলা। তার পরিবার ছিলো মধ্যবিত্ত আর ধার্মিক পরিবার। বিখ্যাত ডারবান হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছেন। একই স্কুলের ছাত্র ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক দুই ক্রিকেটার ল্যান্স ক্লুজনার ও ব্যারি রিচার্ডস। বড় ভাই আহমেদ আমলাও ছিলেন ক্রিকেটার।
ডারবান হাইস্কুলের পাঠ শেষ করার পরই কাওয়াজুলু নাটাল প্রাদেশিক দলে সুযোগ পান হাশিম আমলা। ২০০২ যুব বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা দলকে নেতৃত্ব দেন, ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজিত হয় তার দল।। মাত্র ২১ বছর বয়সে প্রাদেশিক দলের অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পান। তখন থেকেই তার মাঝে ভবিষ্যত দক্ষিণ আফ্রিকা দলের নেতৃত্বের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন কর্মকর্তারা। তবে জাতীয় দলের নির্বাচকরা তখনো তার দিকে দৃষ্টি দেননি।
২০০৪-০৫ মৌসুমের ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথম ৮ ম্যাচে ৪টি সেঞ্চুরি করেন। এরপর আর তাকে অপেক্ষায় রাখেননি নির্বাচকরা। ২০০৪ সালের নভেম্বরে ভারত সফরের টেস্ট দলে জায়গা হয় এবং কলকাতায় সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টেই পা রাখেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। এরপরও কিছুদিন সংগ্রাম করতে হয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকতে। ২০০৭ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে পরপর দুই টেস্টে অপরাজিত ১৭৬ ও ১০৩ রানের ইনিংস খেলার পর শুরু হয় অন্য এক আমলার যাত্রা। এরপরের গল্পটা ব্যাট হাতে দাপিয়ে বেড়ানোর।
২০১০ সালটা ছিলো তার ক্যারিয়ারের সেরা বছর। ভারত সফরে মাত্র তিন ইনিংসে একটি ডাবল সেঞ্চুরিসহ করেন ৪৯০ রান। বছর জুড়ে ১৫ ওয়ানডেতে ৫ সেঞ্চুরি আর ৪ হাফ সেঞ্চুরি আসে তার ব্যাট থেকে। ওই বছর টেস্টেও করেন ৫ সেঞ্চুরি। ক্যালেন্ডার ইয়ারে দুই ফরম্যাটেই এক হাজার করে রান করেন। ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষেও উঠে আসেন একই সাথে।
২০১৪ সালের জুনে প্রথম অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার স্থায়ী টেস্ট ক্যাপটেনের দায়িত্ব পান। ১৪ টেস্ট ও ৯ ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েছেন দলকে। তবে অধিনায়কত্বের চেয়ে ব্যাটিংয়ে মনোনিবেশ করতেই তার আগ্রহ ছিলো বেশি। যে কারণে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে স্বেচ্ছায় নেতৃত্ব ছেড়ে দেন।
ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসেবে হাশিম আমলা বরাবরই পরিচিত। সব সময়ই চেষ্টা করতেন ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে। দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সিতে স্পন্সর হিসেবে একটি বিয়ার কোম্পানির লোগো ছিলো; কিন্তু আমলা কোন অ্যালকোহল কোম্পানির প্রচারণা নিজের জার্সিতে রাখতে চাননি। এক পর্যায়ে অবশ্য আমলার দাবি মেনে তার জন্য ওই লোগো বাদ দিয়ে জার্সি তৈরি করতে শুরু করে প্রোটিয়া বোর্ড। ম্যাচ জয়ের পর দলের অন্য সদস্যরা যখন শ্যাম্পেইন ছিটিয়ে পার্টি করতেন, হাশিম আমলা চুপচাপ নিজেকে সরিয়ে নিতেন সেসব থেকে।
অনুশীলনের ফাঁকে কিংবা বিমান যাত্রায় তাকে প্রায়ই দেখা যেত কোরআন পড়তে। বিশ্বের যে প্রান্তেই যেতেন কোরআন আর জায়নামাজ দুটি ছিলো তার সঙ্গী। কখনোই প্রথাগত আধুনিকতায় গা ভাসাননি। নিজের স্বকীয়তা আর সংস্কৃতি ধরে রেখেও যে সব কিছু করা যায় হাশিম আমলা ছিলেন তার উৎকৃষ্ট উদারহরণ।
২০১৯ সালের বিশ্বকাপের পর এই তারকা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেন। সে আসরটা ভালো কাটেনি প্রোটিয়াদের জন্য। প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে। তবু জীবনের শেষ ম্যাচটায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৮০ রানের অপরাজিত এক ইনিংস খেলে দলকে এনে দিয়েছেন স্বান্তনার জয়।
বিশ্লেষকদের মতে, দুটি কারণে হাশিম আমলার ওয়ানডে ক্যারিয়ার আরো বেশি সমৃদ্ধ হয়নি। তা হলে কিছুটা দেরিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সুযোগ পাওয়া এবং ক্যারিয়ারের প্রথম কয়েক বছরে প্রতিভা ঠিক মতো তুলে ধরতে না পারা। প্রায় ২২ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেক, আর ওয়ানডে অভিষেক আরো চার বছর পরে। বয়স ৩৫ হয়ে যাওয়ার পরে নিজেকে স্চ্ছোয় সরিয়ে নিয়েছেন জাতীয় দল থেকে।