হোয়াইট হাউস। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির বাসভবন ও অফিস। অনেকে বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই ঠিকানা থেকেই ঠিক করা হয় বিশ্ববাসীর ভাগ্য। ২২০ বছর আগে নির্মিত এই বাড়িটি দেখতে কেমন? ওভাল অফিস, সিচুয়েশন রুমের মতো আর কী কী আছে এখানে? এই বাড়ির নিরাপত্তা ব্যবস্থাই বা কেমন?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের সময় ওয়াশিংটন ডিসিতে রাজধানী স্থাপনের জন্য যে বিশাল প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, তার অধীনেই শুরু হয় হোয়াইট হাউসের নির্মাণকাজ। দিনটি ছিলো ১৭৯২ সালের ১৩ অক্টোবর। এর নির্মাণকাজের জন্য বেলে পাথর আনা হয়েছিল ক্রোয়েশিয়া থেকে। অবশ্য এ বিষয়ে ভিন্নমতও আছে। ভবনটির নকশা করেছিলেন আইরিশ স্থপতি জেমস হোবান।এর আগের বছর সাউথ ক্যারোলিনা সফরে গিয়ে হোবানের একটি নির্মাণকাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটন। এরপর তিনি ওই স্থপতিকে ডেকে পাঠান এবং তার নকশাই পছন্দ করেন।
২২০ বছর আগের সেই সময় এর নির্মাণ খরচ ছিলো২ লাখ ৩২ হাজার ৩৭১ মার্কিন ডলার। এই বিশাল নির্মাণকাজের শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছে আফ্রিকান আমেরিকান শ্রমিকরা, তাদের সাথে ছিলো কিছু ইউরোপীয় অভিবাসী শ্রমিক। এই বাড়িতে মোট ফ্লোর স্পেস ৫৫ হাজার বর্গফুট। আরো পুরো হোয়াইট হাউস কম্পাউন্ডের আয়তন ১৮ একর।
নির্মাণকাজ শুরু করলেও জর্জ ওয়াশিংটন হোয়াউট হাউসে থাকতে পারেননি। তার সময়ে ওয়াশিংটনে রাজধানীর অবকাঠামো নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ী রাজধানী ছিলো পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াতে।১৮০০ সালে নির্মাণকাজ শেষ হয় হোয়াইট হাউসের। ওই বছর ১ নভেম্বর প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে ওঠেন জন অ্যাডামস। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট।
১৮১২ সালের যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনারা ভবনটি পুড়িয়ে দেয়। ওই আগুনে এর বাইরের কাঠামো ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না। এরপর ১৮১৪ সালে এটিকে আবার বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। দেয়ালে আগুন ও ধোঁয়ার দাগ ঢাকতে সাদা রং করা হয়। সেই থেকেই মূলত এটি হোয়াইট হাউস নামে পরিচিতি হয়ে ওঠে। ১৮১৭ সালে প্রেসিডেন্ট জেমস মনরো এক্সিকিউটিভ রেসিডেন্স নামে পরিচিত প্রধান ভবনটিতে ওঠেন। তবে তখনো নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি।
প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের সময় হোয়াইট হাউসের ওয়েস্ট উইং তৈরি করা হয় এবং সেখানে প্রেসিডেন্টের অফিস রুম স্থানান্তরিত করা হয়। পূর্ব দিকে সীমানা প্রাচীরের কাছে একটি ভবন এটি। আর ওভাল অফিস হিসেবে খ্যাত প্রেসিডেন্টের অফিস কক্ষ প্রতিষ্ঠা করেন প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম হাওয়ার্ড ট্যাফট। তবে বর্তমানে যেখানে ওভাল অফিস অবস্থিত সৈটি তৈরি হয়েছে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের সময়। ওয়েস্ট উইংয়ের দ্বিতীয় তলায় এক পাশে এই অফিসটি তৈরি করা হয়। এর জানালার ঠিক নিচেই গোলাপের বাগান। এরপর থেকে এই ওভাল অফিস প্রেসিডেন্টের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ডিম্বাকৃতির হওয়ার কারণেই অফিসটির এমন নাম।
হোয়াইট হাউস কম্পাউন্ডের মধ্যে মোট তিনটি ভবন। মূল ভবনটির নাম এক্সিকিউটিভ রেসিডেন্স। আর আছে দুই পাশে ইস্ট উইং ও ওয়েস্ট উইং নামের দুটি পৃথক ভবন। ইস্ট উইং একটি দোতালা ভবন। যার পাশ দিয়েও রয়েছে হোয়াইট হাউসের গেস্ট এন্ট্রান্স বা অতিথিদের প্রবেশের গেট। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিরা এই গেট দিয়েই হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেন। ইস্ট উইংয়ের দ্বিতীয় তলায় ফার্স্ট লেডির অফিস। এই ফ্লোরের অন্যান্য রুমগুলোও তার স্টাফদের জন্য নির্ধারিত। গোয়েন্দা বিভাগের জন্যও একটি রুম রয়েছে এখানে।
নিচ তলায় মাঝখানে বড় একটি লবি ও তার পাশেই গার্ডেন রুম। আরো কিছু ছোট ও মাঝারি আকারের রুম রয়েছে এখানে। ইস্ট উইং থেকে এক্সিকিউটিভ রেসিডেন্স ভবনে যাওয়ার পথে রয়েছে ফ্যামিলি থিয়েটার ও ভিজিটর্স ফয়ার। এখান থেকেই অতিথিরা বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা সেরে মূল ভবনে প্রবেশের অনুমতি পান।
মূল ভবন অর্থাৎ এক্সিকিউটিভ রেসিডেন্সের উত্তর ও দক্ষিণ পাশের প্রবেশ দ্বারে রয়েছে অনেকটা একই ধরনের কয়েকটি পিলারযুক্ত বারান্দা। উত্তর ও দক্ষিণ পাশকে যথাক্রমে সাউথ প্রটিকো ও নর্থ প্রোটিকো নামে ডাকা হয়। সাউথ প্রোটিকোর দুই পাশ দিয়ে নেমে গেছে দুটি সিড়ি। এই ভবনের বেসমেন্টে রয়েছে কয়েকটি স্টোর রুম, লন্ড্রি, বৈদ্যুতিক ও এয়ার কন্ডিশন কন্ট্রোল রুম। আরেকটি সাব বেসমেন্টেও রয়েছে একই ধরণের কিছু রুম।
প্রথম তলাটি দুই দিক থেকে সংযুক্ত রয়েছে ইস্ট উইং ও ওয়েস্ট উইংয়ের সাথে। এই ফ্লোরের মাঝখানে লম্বা একটি করিডোর যেটি সেন্টার হল নামে পরিচিত। দুই পাশের সবগুলো রুম থেকে বের হওয়া যায় এই সেন্টার হলে। সাউথ প্রোটিকো দিয়ে ঢুকলেই সবার আগে পড়বে ডিপ্লোম্যাটিক রিসিপশন রুম। বিদেশী অতিথিদের স্বাগত জানানো হয় এখানে। এই রুমের ডান দিকে আছে চায়না রুম ও ভারমেইল রুম। ভারমেইল রুমে ফার্স্টলেডিদের প্রোট্রেট টানানো থাকে। চায়না রুমটি ফার্স্টলেডির টি-পার্টি কিংবা ছোটখাট আড্ডার জন্যও ব্যবহৃত হয়।
ডিপ্লেম্যাটিক রিসিপশন রুমের বাম দিকে ম্যাপ রুম, চিকিৎসক ও গৃহকর্মীদের রুম। প্রেসিডেন্টের বেশির ভাগ টিভি ইন্টারভিউ ধারণ করা হয় ম্যাপ রুমে। আরো আছে লাইব্রেরি, কিউরেটরের রুম, গোয়েন্দা সংস্থার রুম ও রান্নাঘর। এছাড়া ফ্লাওয়ার শপ, কার্পেন্টারদের রুম ও লম্বা একটি লন রয়েছে একেবারে নর্থ প্রোটিকোর কাছাকাছি।
দ্বিতীয় তলায় পূর্ব দিকের পুরোটা জুড়ে ইস্ট রুম, যেখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় সবাই জমায়েত হয়। এছাড়া রয়েছে ব্লু রুম, রেড রুম ও গ্রিন রুম। রুমগুলো যে রং দিয়ে সাজানো হয়েছে সে অনযায়ী রাখা হয়েছে এগুলোর নাম। এই রুমগুলো দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ পাশে। এই ফ্লোরেই আছে বিশাল আকারের স্টেট ডাইনিং রুম, যেখানে এক সাথে অনেক অতিথি খাবার গ্রহণ করতে পারেন। আর এর পাশে রয়েছে প্রেসিডেন্টের ফ্যামিলি ডাইনিং রুম।
তৃতীয় তলাটি মূলত প্রেসিডেন্টের বাসস্থান। এই ফ্লোরের রুম বিন্যাস গত ২০০ বছরে অনেকবার পরিবর্তিত হয়েছে প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্টলেডিদের পছন্দ মতো। এখানে প্রেসিডেন্টের বেডরুমসহ রয়েছে মোট ৫টি বেড রুম। এছাড়া একাধিক সিটিং রুম, ডাইনিং রুম, কিচেন, প্রেসিডেন্টের প্রাইভেট রুম ও স্টাডি রুম আছে। ফ্লোরের মাঝখানে আছে একটি সেন্টার হল, যেটিতে সবগুলো রুম থেকে বের হওয়া যায়।
হোয়াইট হাউসের রেসিডেন্ট ভবনের চতুর্থ তলাটি প্রেসিডেন্টের পরিবারের সদস্যদের বিনোদন ও অবসর কাটানোর জন্য। দক্ষিণ দিকে বিশাল বারান্দা যেটিকে বলা হয় সান রুম। এখান থেকে ওয়াশিংটন ডিসির বড় একটি অংশ দেখা যায়। এছাড়া মিউজিক রুম, সিটিং রুম, গেম রুমসহ কয়েকটি বেড রুমও আছে এখানে।
হোয়াইট হাউজের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ওয়েস্ট উইং, যেখানে অবস্থিত প্রেসিডেন্ট ও তার স্টাফদের অফিস। পশ্চিম দিকের দেয়াল ঘেষে থাকা ভবনটি বাইরে থেকে দেখে দোতালা মনে হলেও এটি আসলে তিন তলা। নিচ তলাটি অনেকটা বেজমেন্টের মতো। নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে অত্যন্ত সুরক্ষিত করে এটি বানানো হয়েছে। এখানে ব্রিফিং রুম, ভিডিও কনফারেন্স রুম ছাড়াও রয়েছে সিক্রেট সার্ভিস, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, নৌ বাহিনীর রুম। এছাড়া এক কোনায় রয়েছে জন এফ কেনেডি কনফারেন্স রুম। তবে এই রুমটি সিচুয়েশন রুম হিসেবেই পরিচিত। এই রুম থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশে^র যে কোন প্রান্তে থাকা তার সেনাবাহিনীকে আদেশ দিতে পারেন।
ওয়েস্ট উইংয়ের দ্বিতীয় তলাটিমূলত যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের হেডকোয়ার্টার। এখানে রয়েছে মন্ত্রীসভার বৈঠক রুম। দক্ষিণ পশ্চিম কোনায় প্রেসিডেন্টের অফিস রুম, যেটি ওভাল অফিস নামে খ্যাত। এছাড়া ভাইস প্রেসিডেন্ট, ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার, চিফ অব স্টাফ, প্রেস সেক্রেটারির রুমও এখানে। ওয়েস্ট উইংয়ের দ্বিতীয় তলাটিরেসিডেন্স ভবনের সাথে যুক্ত। দুই ভবনের সংযোগস্থলে রয়েছে প্রেস ব্রিফিং রুম। তৃতীয় তলায়ও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কর্মকর্তার অফিস।
হোয়াইট হাউসকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুরক্ষিত বাড়ি। এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আক্ষরিক অর্থেই নিশ্চিদ্র। জানালা গুলোতে অত্যন্ত উন্নতমানের ব্যালেস্টিক গ্লাস ব্যবহার করা হয়েছে। যা বুলেট প্রুফই শুধু নয়, ধারণা করা হয় বিশে^র সবচেয়ে মজবুত কাচ সেগুলো। ২০১১ সালে হোয়াইট হাউসে এক অস্ত্রধারী সেমি অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে গুলি চালানোর পর বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে সবার কাছে।
এই বাড়ির আশপাশের এলাকাকে নো ফ্লাই জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে ২০০১ সালের নাইন ইলেভেন হামলার পর। কোন আকাশ যান ওই এলাকা থেকে উড়তে পারবে না।তবে ২০১৯ সালের নভেম্বরে একটি বিমান ওই এলাকায় ঢুকে পড়ার পর হোয়াইট হাউসেফুল স্কেল এলার্ট জারি করা হয়। আর তখনই জানা যায়, হোয়াইট হাউসের নিরাপত্তার জন্য এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন রয়েছে। অনেকে বলছেন সেটি অ্যাভেঞ্জার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, যাতে রয়েছে ৮টি স্ট্রিঞ্জার মিসাইল ও একটি এম থ্রি মেশিন গান।
এছাড়া হোয়াইট হাউসের চারপাশে আরো অনেকগুলো সারফেস টু এয়ার মিসাইল লঞ্চার মোতায়েন রয়েছে লোক চক্ষুর আড়ালে। এই বাড়ির প্রতি ইঞ্জি জায়গায় লাগনো রয়েছে উন্নত মানের ইনফ্রারেড সেন্সর, যা নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সামান্যতম গড়মিলও ধড়িয়ে দেয়। কোন হ্যাকার এই সেন্সর অকার্যকর করার চেষ্টা করলেও বেজে উঠবে অ্যালার্ম।
আর পুরো ভবনের চারদিকে রয়েছে লোহার বেড়া যা ১১ ফুট উচু। এটা এত মজবুত লোহা দিয়ে তৈরি যে, বিস্ফোরণ সহ্য করেও টিকে থাকতে পারবে। এর ভেতরে রয়েছে একটি কংক্রিটের দেয়াল। এছাড়াহোয়াইট হাউজে কয়েকশো অস্ত্রধারী নিরাপত্তা কর্মী, সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট প্রতি মূহুর্তে পাহাড়া দেয়। আর আছে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর প্রশিক্ষিত কুকুর। হোয়াইট হাউসে আছে বেলজিয়ান মেলিনয়েজ প্রজাতির অনেকগুলো কুকুর।এর বাইরে চারপাশে বিশাল এলাকা জুড়ে সারাক্ষণ চোখ রাখে সিক্রেট সার্ভিসের সদস্যরা। হোয়াইট হাউজের ভবনগুলো কিংবা চারপাশের অনেক ভবনের ছাদে অবস্থান নিয়ে থাকে নিরাপত্তা বাহিনীর স্নাইপাররা।
ধারণা করা হয় এসবের বাইরেও হোয়াইট হাউসের নিরাপত্তায় এমন কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে যেগুলোর কথা বাইরের দুনিয়া জানে না। যেমন মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের কথাই আগে অজানা ছিলো সবার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বাসভবনটিকে যে নিরাপত্তার সম্ভব সব উপকরণ দিয়েই সুরক্ষিত রাখা হবে সেটি আর বিস্ময়কর কী!