বলা হয়, প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনে একজন নারীর অনুপ্রেরণা থাকে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের আকাশচুম্বি সাফল্যের পেছনে একজন নারী মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি এমিনি এরদোয়ান, তুরস্কের ফার্স্ট লেডি। নানা কারনে এই নারী বিশ্বজুড়ে আলোচিত ব্যক্তিত্ব।
নিপুণ ব্যক্তিত্ব, মানবিকতা, আদর্শের প্রতি অবিচল মনোভাব, পরিচ্ছন্ন রাজনীতিÑ এসব কারণে তার পরিচিতি শুধু এরদোয়ানের স্ত্রী হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি হয়ে উঠেছেন বিশে^র নারী সমাজের আদর্শ। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির প্রতি অকৃত্রিম মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এ অঞ্চলেও বেশ জনপ্রিয় তিনি। নারীর ক্ষমতায়ন, জলবায়ু ও পরিবেশ সুরক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি ও সামাজিক সচেতনতার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও রয়েছে তার। পাকিস্তানের প্রতি উদারতা, বলিউড অভিনেতা আমির খানের সঙ্গে সাক্ষাৎÑ এ রকম কিছু বিষয় তাকে বিতর্কের কেন্দ্রেও নিয়ে এসেছে। এজন্য অবশ্য তিনি একটি মহলে প্রশংসার পাত্রও হয়েছেন।
এমিনি এরদোয়ানের জন্ম ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, তুরস্কের ইস্তানবুলের ইউকাদারে। জন্মের পর নাম রাখা হয় এমিনি গালবারেন। তিনি আমিনা নামেও পরিচিত। জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি সংক্ষেপে একে পার্টির সক্রিয় কর্মী ও নারী মুখপাত্র। তিনি আরব বংশোদ্ভূত, তার পরিবার তুরস্কের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় সিরত প্রদেশ থেকে ইস্তানবুলে এসেছিল। এমিনি পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। মিহাত পাশা আকসাম আর্ট স্কুলে পড়াশোনা শুরু করলেও স্নাতক সম্পন্ন করার আগেই এ প্রতিষ্ঠান ছেড়ে গিয়েছিলেন তিনি। এরপর তার গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করা হয়নি; তরুণ বয়সেই জড়িয়ে পড়েন সামাজিক আন্দোলনে।
এমিনি ‘আইডিয়ালিস্ট উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এ সংগঠনের সদস্য থাকাকালীন এক সম্মেলনে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে তার দেখা হয়। এরদোয়ান ও এমিনি গালবারেন ১৯৭৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের চারটি ছেলেমেয়ে রয়েছে; আহমেদ বুরান এরদোয়ান, সামিয়ে, নেকমিতিন বিলাল ও এশরা।
তুরস্কের রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের পথ উন্মুক্ত করতে পাইওনিয়র হিসেবে কাজ করেছেন এমিনি। তার শুরু করা নারী আন্দোলন ১৯৯৪-এর নির্বাচনে রেফাহ পার্টিকে সাফল্য এনে দিতে অবদান রাখে। এরদোয়ান যখন পার্টির ইস্তাম্বুলের প্রাদেশিক প্রধান ছিলেন, এমিনি তখন দলের প্রাদেশিক মাহিলা শাখার প্রশাসনিক বোর্ডের সদস্য।
স্বামী যখন ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন, তিনি জনপ্রিয় বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় অবদান রাখেন। ইফতারের টেবিলকে ধনী-গরিবের সম্মিলনকেন্দ্র বানানোর ঐতিহ্য প্রচলন করেন এমিনি।
নারী ও শিশুশিক্ষা এগিয়ে নিতে তিনি ২০০৫ সালে ‘সেন্টার ফর সোশাল ডেভেলপমেন্ট’ নামে একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। তুরস্কের সব প্রদেশের গভর্নরের স্ত্রীদের নিয়ে নারী, প্রবীণ ও শহিদ পরিবারের জীবনমান উন্নয়নে নেতৃত্ব দেন। এ প্রকল্প ‘গোল্ডেন কম্পাস’ পুরস্কারে ভূষিত হয়। ২০০৯ সালে গাজায় ভয়াবহ ইসরাইলি হামলার পর এমিনি পশ্চিমা ও আরব নেতাদের স্ত্রীদের নিয়ে সম্মেলন করে যুদ্ধ থামাতে বিশ^কে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
পরিবারের কারণে যেসব শিশু স্কুলে যেতে পারে না, তাদের জন্য দেশব্যাপী সর্বাত্মক প্রচারাভিযান শুরু করেছিলেন এমিনি। ‘কাম অন গার্লস, লেট্স গৌ টু স্কুল’ প্রকল্প সাড়া জাগায় দেশটিতে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে শিক্ষাবঞ্চিত পরিবারের মা ও কন্যাশিশুকে একসঙ্গে স্কুলে নিতে তিনি ২০০৮ সালে ‘মাদার্স অ্যান্ড ডটার্স অ্যাট স্কুল’ প্রকল্প পরিচালনা করেন। শূন্য থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের প্রি-স্কুল শিক্ষার আওতায় আনতে তিনি ‘সেভেন ইজ টু লেইট’ প্রকল্পে নেতৃত্ব দেন।
এছাড়াও, সবুজায়নের লক্ষ্যে ‘প্রলিফিক ফরেস্ট’; মাটি, বীজ ও গাছের প্রতি সচেতনতা বাড়াতে ‘আই প্রটেক্ট মাই ফিউচার’; আফ্রিকান নারীদের জীবনমান উন্নয়নে ‘আফ্রিকান হ্যান্ডিক্রাফট মার্কেট অ্যান্ড কালচার হাউজ’ খাদ্যপণ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নষ্ট না করতে এবং বর্জ্য রিসাইক্লিংকে উৎসাহিত করতে ‘জিরো ওয়েস্ট’ প্রকল্প পরিচালনা করেন তিনি। বাল্যবিয়ে প্রতিহত করতে তার কঠোর ভূমিকা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। কোভিড মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন এমিনি।
এমিনি ২০১৬ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে বিশ্ব নেতাদের স্ত্রীদের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। তুরস্কের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমদ দাভুতোগলুকে সঙ্গে নিয়ে তিনি রোহিঙ্গাদের খোঁজ-খবর নিতে বাংলাদেশে আসেন এবং নিজ হাতে ত্রাণ বিতরণ করেন। রোহিঙ্গাদের মানবেতর অবস্থা দেখে কান্না করেছিলেন তিনি। সে ছবি সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয়।
রোহিঙ্গাদের প্রতি ভালোবাসা তাকে এ অঞ্চলে তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। এমিনি ন্যাটো সম্মেলনে এক বৈঠকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতন ও তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অধিকার নিয়ে কথা বলেন। অন্য দেশের ফার্স্ট লেডিদের সঙ্গে বৈঠকে এমিলি এরদোয়ান বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর নিয়ে কথা বলেন। তিনি রোহিঙ্গাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তুরস্ক সব সময় রোহিঙ্গাদের পাশে আছে। তুরস্কের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা রোহিঙ্গাদের সহায়তা করে যাচ্ছে। তিনি রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষায় জোর দাবি তুলে ধরেন এবং রোহিঙ্গাদের সহায়তায় অন্য রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
২০১০ সালের অক্টোবরে এমিনি পাকিস্তানের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য পাকিস্তান সফর করেন এবং ভয়াবহ সে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এমিনি তুরস্কসহ বিভিন্ন মহলে পাকিস্তানের বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালান। এমনকি, পাকিস্তান সফরকালে তার নিজের গলার হার বন্যায় দুর্গতদের সাহায্যে দান করেন।
২০১৫ সালে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ ইউসুফ রাজা গিলানি এমিনি এরদোয়ানকে পাকিস্তানের বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘নিশান-ই-পাকিস্তান’ প্রদান করেন। ২০১৮ সালে মানবতার সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব মুসলিম ফিলানথ্রপিস্ট কর্তৃক গ্লোবাল ডোনারস ফোরামের সম্মাননা পদক লাভ করেন।
সম্প্র্রতি বিশ্বের প্রভাবশালী মুসলিম ব্যক্তিত্বের তালিকায় প্রথম স্থান লাভ করেন তুরস্কের ফাস্ট লেডি। আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এ তালিকা প্রকাশ করে। প্রভাবশালী মুসলিমদের বিশেষ সম্মাননা স্বরূপ এমিনিসহ ১০ মুসলিম ব্যক্তিত্বকে ‘আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার ২০২০’-এর জন্য মনোনীত করা হয়। পাকিস্তান ও বেলজিয়াম থেকে যৌথভাবে পরিচালিত আন্তর্জাতিক এ সংস্থা প্রতিবছর মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী ১০ জন মুসলিমকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য শান্তি পুরস্কার দিয়ে থাকে। বিভিন্ন দেশে সংস্থার পাঁচ হাজার শান্তিদূত ও ১২ হাজার সদস্য রয়েছেন, যারা প্রতিবছর শান্তি পুরস্কারের জন্য নাম প্রস্তাব করে থাকেন।
সম্প্রতি বলিউড অভিনেতা আমির খানের সঙ্গে এমিনির সাক্ষাতের বিষয়টি ভারতে বড় বিতর্কের জন্ম দেয়। নিজের নতুন ছবি ‘লাল সিং চাড্ডা’র শুটিং করতে তুরস্কের ইস্তানবুলে গিয়েছিলেন এ বলিউড অভিনেতা। বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় এ অভিনেতাকে হাতের কাছে পেয়ে একটু সাক্ষাতের সুযোগ যেন মিস করতে চাননি দেশটির ফার্স্ট লেডি। তার পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয় আমিরকে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য। সম্মানিত এ আমন্ত্রণ পেয়ে ছুটে যান আমির খানও। টুইটারে পোস্ট করা তুরস্কের ফার্স্ট লেডি ও আমির খানের ছবি নিমিষেই ভাইরাল হয়ে যায়।
আমির খানের সাথে সাক্ষাতের ছবির ক্যাপশনে এমিনি লিখেছেন, ‘ইস্তানবুলে আমির খানের সাক্ষাৎ পেয়ে খুব ভালো লাগল। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় অভিনেতা, প্রযোজক ও নির্মাতা। তিনি ‘লাল সিং চাড্ডা’ ছবির শেষ অংশের শুটিং করবেন তুরস্কের বিভিন্ন অঞ্চলে। এটা জানতে পেরে খুব খুশি হয়েছি আমি। এ ছবিটি দেখার জন্য তর সইছে না।’ ভাইরাল হওয়া ছবিগুলো নিয়ে ভারতীয়রা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেতে ছিলেন। হয়েছে তর্ক-বিতর্কও। অনেকে আমির খানকে ধন্যবাদ জানান আন্তর্জাতিকভাবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য।
অনেকে আবার এ সাক্ষাত নিয়ে কটু মন্তব্য করেছেন। নিন্দাও জানিয়েছেন। তাদের মতে, ‘আমিরের উচিত ছিল এ সাক্ষাতের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেওয়া। দেশের শত্রুর অতিথি হওয়াটা শোভনীয় নয়।’ এখন তুরস্ক ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। ভারত আর পাকিস্তানের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের পাশে আছে তুরস্ক। বিশেষ করে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সরিয়ে নেওয়ায় ভারতের সমালোচনাও করেছে তুরস্ক। এসব কারণে তুরস্ককে শত্রুরাষ্ট্র বলেই মনে করেন ভারতীয়রা।
এ সাক্ষাতের পেছনে এমিনি এরদোয়ানের যে মহৎ উদ্দেশ্য ছিল, সেটা ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে তেমন আসেনি। এমিনি কন্যাশিশু মৃত্যুর হার কমানো ও শিক্ষার হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমিরের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তারকাখ্যাতিকে আমির খান যেভাবে ইতিবাচক ভূমিকায় ব্যবহার করছেন, তা অত্যন্ত প্রেরণার বলে উল্লেখ করে এ অভিনেতাকে ধন্যবাদও জানান তিনি। আমির খানের সিনেমা যে একইসঙ্গে ব্যবসাসফল ও শিক্ষামূলক, এ কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
তার জীবনে ‘হারমেস কন্ট্রোভার্সি’ নামে আরও একটি বিতর্ক রয়েছে। ২০২০ সালের জুনে এমিনির হাতে ফ্রান্সের হারমেস কোম্পানির তৈরি প্রায় ৫০ হাজার ডলার দামের হ্যান্ডব্যাগ দেখা যায়। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৪২ লাখ টাকার সমান। একটি ধনী দেশের ফার্স্ট লেডির জন্য এ দামের হ্যান্ডব্যাগ বহন আহামরি কিছু না হলেও একটি আদর্শবাহী রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর হাতে এ লাক্সারি পণ্য মানায়নি বলে মনে করেন অনেকে। পরে হুররিয়াতের খবরে বলা হয়, ‘এটি হারমেসের লাক্সারি ব্যাগ ছিল না, ছিল হারমেসের আদলে তৈরি কম দামের হ্যান্ডব্যাগ। ফার্স্ট লেডি এত দামি পণ্য ব্যবহার করেন না।’
ছোটখাট এসব বিতর্ক এমিনির মহৎ ব্যক্তিত্বকে ম্লান করতে পারেনি। নিজের দেশ তো বটেই, বিশে^র নির্যাতিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির কল্যাণেই তিনি জীবনের সিংহভাগ সময় ব্যয় করেছেন। প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন মানবতা ও আদর্শের প্রতীক হিসেবে।