প্রাইভেট জেট বা ব্যক্তিগত বিমান ধারণাটি বিশ্বে নতুন নয়। অনেক ধনী ব্যক্তিই প্রাইভেট জেট ব্যবহার করেন। এটি কখনও নিজের পছন্দমতো যাতায়াতের সুবিধার জন্য, আবার কখনও বা বিলাসিতা হিসেবে। প্রেক্ষাপট যাই হোক, বিশ্বে প্রাইভেট জেটের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছেই। সাধারণত ছোট বা মাঝারি আকারের বিমানগুলোকেই বেছে নেওয়া হয় প্রাইভেট জেট হিসেবে; কিন্তু বিশ্বে এমন কয়েকজন ধনী ব্যক্তি রয়েছেন, যারা বিশাল একটি বাণিজ্যিক বিমানকেই প্রাইভেট জেট বানিয়েছেন। বাড়ি কিংবা পাঁচ তারকা হোটেলের মতো সাজিয়েছেন বিমানকে।
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বিলাসবহুল ও ব্যয়বহুল প্রাইভেট জেটটি হলো এয়ারবাস এ-৩৮০ মডেলের দানবাকৃতির একটি বিমান।একই মডেলের বিমান যাত্রী পরিবহনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স ও এমিরেটস এয়ারলাইন্সে। সেগুলো প্রতিটি ফ্লাইটে ৮০০ যাত্রী বহন করতে পারে। সাজসজ্জাসহ বিমানটির নির্মাণ খরচ ছিল ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি মার্কিন ডলার।
আরাম আয়েশের সম্ভব সব রকম উপকরণ দিয়ে সাজানো হয়েছে বিমানটিকে। ২০০৭ সালে এয়ারবাস কোম্পানির সাথে এই বিমানটিকে ব্যক্তিগত চাহিদা অনুযায়ী ডেকরেশনের চুক্তি করেছিলেন সৌদি ধনকুবের প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিন তালাল।
প্রিন্সরা রাজপ্রাসাদে থাকতে অভ্যস্ত, সে কারণেই হয়তো আকাশ যাত্রাতেও প্রাসাদের আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত নেন আল ওয়ালিদ। বিমানটিকে তাই ফ্লাইং প্যালেস বা উড়ন্ত প্রাসাদ নামে ডাকা শুরু হয়। প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনী ব্যক্তিদের একজন। যাকে বলা হয় মধ্যপ্রাচ্যের ওয়ারেন বাফেট। আর তার মতো মানুষ এমন বিমান কিনলেও তাই অবাক হওয়ার কিছু থাকে না।
৫০০ মিলিয়ন ডলার যে বিমানের দাম তার ভেতরে কী আছে সেই প্রশ্ন না করে বরং বলা উচিত কী নেই সেই বিমানে। যা আছে শুনলে মাথা ঘুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এমনকি প্রিন্সের ব্যক্তিগত রোলস রয়েস গাড়িটির জন্য একটি গ্যারেজ রাখা হয় বিমানে। যাতে প্রিন্স কোথাও গেলে সাথে নিজের প্রিয় গাড়িটিও নিয়ে যেতে পারেন। বিমানটির ভেতরটি সাজানো হয়েছে তিন তলা বিশিষ্ট করে। রয়েছে একটি লিফট, বিমানের নিচ বরারর যেটি নেমে আসবে মাটিতে। এই লিফটে করেই আরোহীরা যেতে পারেন প্রতিটি ফ্লোরে।
বিমানের নিচতলাটি সাজানো হয়েছেকয়েক সেট সোফা ও টি টেবিল দিয়ে। দেয়ালে রয়েছে বেশ কয়েকটি বিশাল স্ক্রিনের এলইডি টিভি। আবার এসব টিভিতে শক্তিশালী ক্যামেরার সাহায্যে বিমানটি যে এলাকার উপর দিয়ে উড়ে যাবে তার দৃশ্যও দেখার ব্যবস্থা রয়েছে।আছে হাম্মাম খানা বা টার্কিশ বাথ। দি¦তীয় তলা বা মেইন ডেকটিকে সাজানো হয়েছে বিজনেস সেন্টার বা অফিশিয়াল ডেকরেশনে। এই ফ্লোরেই সামনের দিকে ককপিট ও ক্রুদের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু। বাকি অংশ জুড়ে বিশাল লবি, দুটি কনফারেন্স রুম। কনফারেন্স রুমের প্রতিটি টেবিলের সাথে যুক্ত রয়েছে হলোগ্রাফিক স্ক্রিন। এর পাশেই রয়েছে কনসার্ট রুম। যেখানে একটি মঞ্চের সামনে ১০টি সিট দর্শক-শ্রোতাদের জন্য।
এই বিমানে আছে ২০টি আলাদা ভিআইপি স্যুট। আছে চমৎকার একটি নামাজের ঘর। নামাজ ঘরের মেঝেতে বিছানো কাপের্টটি ইলেট্রনিক্স নিয়ন্ত্রিতি। যে কারণে বিমান যেদিকেই চলুক কার্পেটটি সব সময় পবিত্র মক্কার দিকে ঘুরে থাকবে। নামাজ চলা অবস্থায় বিমানের দিক পরিবর্তন হলে, কার্পেট ঘুরে গিয়ে নামাজিদের কেবলামুখী করে দেবে। বিমানের তৃতীয় তলাটিতে রয়েছে ৫টি মাস্টার বেডরুম। প্রতিটির ভেতরে রয়েছে একটি করে বাথরুম। এই ফ্লোরেও রয়েছে একটি ছোট লাউঞ্জ, বেড রুম থেকে বের হয়ে চাইলে এখানে বসে সময় কাটানো যাবে।
বিমানটিতে মালিক ছাড়াও অন্তত ৫০ জন অতিথির জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।সবগুলো তলার ফ্লোরে দামী মার্বেল পাথর আর দেয়ালে চমৎকার টাইলস বসানো। দেয়ালে দেয়ালে টানানো হয়েছে দামীসব চিত্রকর্ম।একটানা ১৭ হাজার ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে বিমানটি। যেটি একই মডেলের বাণিজ্যিক বিমানের চেয়ে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার বেশি।
তবে শেষ পর্যন্ত এয়ারবাস কোম্পানির কাছ থেকে বিমানটি ডেলিভারি নেননি প্রিন্স আল ওয়ালিদ। ২০১৩ সালে ডেলিভারি দেয়ার কথা থাকলেও তার আগে অজ্ঞাত এক ক্রেতার কাছে তিনি বিমানটি বিক্রি করে দেন। বিমানটি কেউ ব্যক্তিগতভাবেই কিনেছে নাকি আবার এর ডেকরেশন পরিবতর্ন করে বাণিজ্যিক বিমানে রূপ দেয়া হয়েছে সেটি নিয়েও রয়েছে রহস্য।
শেষ পর্যন্ত এই বিমানটি ব্যবহার না করলেও প্রিন্স ওয়ালিদ বর্তমানে যে বিমানটি ব্যবহার করছেন সেটিও কিন্তু কম বিলাসবহুল নয়।২০০৩ সালে ২২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বোয়িং-৭৪৭ মডেলের একটি বিমান কেনেন তিনি। আর সেটি তার চাহিদা মতোই সাজানো হয়। বিমানটিতে বিলাসবহুল একাধিক বেড রুম, ১৪ জনের একটি ডাইনিং রুম, মিটিং রুমসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই রয়েছে সেখানে। যাত্রীদের সেবার জন্য বিমানটিতে রয়েছে ১১ জন ফ্লাইট অ্যাটেনড্যাটস।
বিলাসবহুল প্রাইভেট জেট তালিকার দ্বিতীয় বিমানটির মালিক রুশ ধনকুবের আলীশের উসমানোভ। উজবেকিস্তানে জন্ম হলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর তিনি রাশিয়ায় স্থায়ী হয়েছেন। রাশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজন তিনি। উসমানোভের প্রাইভেট জেটটির নির্মাতাও এয়ারবাস কোম্পানি। এটি এ-৩৪০-৩০০ মডেলের একটি বিশাল বিমান। ব্লুমবার্গের তথ্য মতে বিমানটির দাম ২৩৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, তবে মালিকের চাহিদা মতো এটির সাজসজ্জা করতে গিয়ে দাম পড়েছে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এ ধরনের একটি বিমান সাধারণত ৩০০ যাত্রী বহন করতে পারে, আর ছুটতে পারে ঘণ্টায় ৫৬৭ মাইল বেগে। আর একটানা উড়তে পারে ১০ হাজার ৩০০ মাইল।২০৯ ফুট লম্বা বিমানটির রাশিয়ার সবচেয়ে বড় প্রাইভেট জেট, এমনকি প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ইলুশিন-নাইনটি সিক্সের চেয়েও বড় উসমানভের বিমানটি।চারটি শক্তিশালী ইঞ্জিন বিশাল এই বিমানটিকে আকাশে উড়ায়।উসমানভের বাবার নামে বিমানটির নাম রাখা হয়েছে বুরখান।বিমানটিতে ব্যবহৃত হয়েছে অত্যন্ত উন্নত মানের সব প্রযুক্তি।তবে এটির ভেতরের সাজসজ্জা সম্পর্কে বিস্তাতির তথ্য বা ছবি কখনোই প্রকাশ করা হয় না। জানা না গেলেও এই ধনকুবেরের বিমানের ভেতরে যে আরাম আয়েশ আর প্রয়োজনীয় সব কিছুই রয়েছে তা বুঝতে কারো বাকি নেই।
প্রিন্স ওয়ালিদ বিন তালালের কেনা এয়ারবাসের বিমানটি যেহেতু এখন আর ব্যক্তিগত বিমান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে না, তাই এখন উসমানভের বিমানটিকেইসবচেয়ে ব্যয়বহুল ব্যক্তিগত বিমান হিসেবে আখ্যায়িত করেন অনেকে।
তালিকার পরের বিমানটি যুক্তরাষ্ট্রের বিমান প্রস্তুতকারী সংস্থা বোয়িংয়ের তৈরি‘৭৪৭-৮ ভিআইপি’ মডেলের একটি বিমান। এটি দৈর্ঘ্য বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম যাত্রীবাহী বিমান। চার ইঞ্জিনের এই বিমানটি প্রস্তুত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অফিশিয়াল আকাশযান এয়ারফোর্স ওয়ানের জন্য। বর্তমানে এয়ারফোর্স ওয়ান হিসেবে যে বিমানটি ব্যবহৃত হচ্ছে সেটি বোয়িং ৭৪৭-২০০ মডেলের। এর বদলে নতুন এই বিমানটি প্রস্তুত করা হচ্ছে।
প্রেসিডেন্টের জন্য প্রয়োজনীয় সাজসজ্জা ছাড়াই বিমানটির দাম ৩৬৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর সাথে এগুলো যুক্ত হলে বিমানটির দাম৫০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যেতে পারে। রাশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য বিমানটি নির্মাণ শুরু করেছি বোয়িং; কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানটি আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় তারা বিমানটি কিনতে পারেনি। পরে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী এটি কেনার সিদ্ধান্ত নেয়।
দুটি লাউঞ্চ, ডাইনিং রুম, স্টেট রুম, কনফারেন্স রুম, অফিস রুমসহ অনেক কিছু রয়েছে বিমানটিতে। এছাড়া প্রাইভেট টি রুম, কয়েক সেট সোফাসহ লিভিং রুম, মাস্টার স্যুট, মিটিং রুম আছে। আছে বেশ কয়েকটি গেস্ট কেবিন। ডাইনিং রুমে এক সাথে ১৪ জন খাবার গ্রহণ করতে পারবেন।
এছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিমান হিসেবে এটিতে যুক্ত করা হচ্ছে যোগাযোগ ও নিরাপত্তার সব উন্নত প্রযুক্তি। মিসাইল হামলা, আড়ি পাতা, ইত্যাদি ঠেকানোর জন্যও সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বিমানে।প্রেসিডেন্ট বিমানে বসেই তার প্রয়োজনীয় দাফতরিক কাজ সারতে পারবেন। এছাড়া একটিঅপারেশন থিয়েটারসহ আছে জরুরী চিকিৎসার সব ব্যবস্থা।
ইন্টারনেট, টেলিফোন, রেডিও যোগাযোগসহ সব ব্যবস্থাই রয়েছে এতে। সব মিলে ১০০ জন সঙ্গী ও ২৬ জন ক্রু নিয়ে উড়তে পারবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। বর্তমানে টেক্সাসের একটি কারখানায় বিমানটির সাজসজ্জার কাজ চলছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর নাগাদ এটির গায়ে এয়ারফোর্স ওয়ানের সাইনবোর্ড লাগবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ব্রুনাইয়ের সুলতানের ব্যক্তিগত বিমানটিকেও এই তালিকায় রাখতে হবে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী শাসক ব্রুনাইয়ের হাসানাল বলকিয়া। বোয়িংয়ের তৈরি ৭৪৭-৪৩০ মডেলের বিশাল বিমানটি ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনে সেটির সাজসজ্জার পেছনে আরো একশো মিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেছেন এই ধনকুবের। সব মিলে বিমানটির দাম পড়েছে ২৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ভেতরের সাজসজ্জায় প্রচুর স্বর্ণ ও ক্রিস্টাল ব্যবহার করা হয়েছে। হাত ধোয়ার একটি বেসিন রয়েছে সম্পূর্ণ স্বর্ণের তৈরি। বিশাল লিভিং রুম, বেড রুম, মিটিং রুম, লাউঞ্জ রয়েছে বিমানটির ভেতরে। দেয়ালে ঝোলানো হয়েছে অনেক মূল্যবান ক্যালিগ্রাফি। যার ফলে সত্যিকারের এক উড়ন্ত প্রাসাদে রূপ নিয়েছে বিমানটি।
বিশেষভাবে বাড়তি ফুয়েল ট্যাংক যুক্ত করা হয়েছে এবং এর একটানা উড়তে পারার ক্ষমতা বাড়িয়ে ১৪ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত করা হয়েছে। ব্রুনাই থেকে যাতে কোন বিরতি ছাড়াই ইউরোপ বা আমেরিকায় যাওয়া যায় সেটি মাথায় রেখে বিমানটিকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। বিমানটির সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১ হাজার কিলোমিটার।ব্রুনাইয়ের সুলতানের আরো কয়েকটি প্রাইভেট জেট থাকলেও এই বিমানটিই সবচেয়ে বিলাসবহুল।