পৃথিবীর বিখ্যাত নগরীগুলোর সাথে নদীর একটি সম্পর্ক রয়েছে। লন্ডনের টেমস, মস্কোর মস্কোভা কিংবা ফ্রান্সের সেইন নদী নিজ নিজ পাড়ের নগরীগুলোর সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। তুরস্কের ইস্তাম্বুল নগরীর বুক চিরে বয়ে গেছে বিখ্যাত বসফরাস প্রণালী। তবে টেমস কিংবা মস্কোভার সাথে বসফরাসের পার্থক্য হচ্ছে এটি একই সাথে সাংস্কৃতিক গুরুত্বের পাশাপাশি অর্থনৈতিক গুরুত্বও বহন করে। বিশ^ বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি রুট বসফরাস। এটি এমন এক নদী যার এক পাশে ইউরোপ ও অন্য পাশে এশিয়া মহদেশ।
কেতাবি সংজ্ঞায় বসফরাস একটি প্রণালী। প্রণালী তাকেই বলা হয়, যা দুই পাশের দুটি বড় পানির উৎসকে যুক্ত করে এবং নৌযান চলাচলের মতো যথেষ্ট গভীরতা থাকে। ভূমধ্যসগারের সাথে মারামারা সাগরের সংযোগ স্থাপনের কারণেই বসফরাস একটি প্রণালী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সাধারণ দৃষ্টিতে নদীর সাথে এর তেমন কোনো পার্থক্য নেই।
ইতিহাসের অনেক সমৃদ্ধ সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু তুরস্কের ইস্তাম্বুল। সেই ইস্তাম্বুল নগরীর বুক চিড়েই বয়ে গেছে বসফরাস প্রণালী। ইস্তাম্বুলের এশীয় অংশ ও ইউরোপীয় অংশকে জোড়া লাগিয়েছে এটি। বসফরাস শব্দটি এসেছে থ্রেসিয়ান একটি শব্দ থেকে যার অর্থ গরুর যাত্রাপথ। বসফরাসের নামকরণ নিয়ে রয়েছে একটি পৌরাণিক গল্প। গ্রিক দেবতা জিউসের প্রেমিকা আইও’র একটি গল্প থেকে নামটি এসেছে। জিউসের স্ত্রী হিরা তার স্বামীর কর্মকাণ্ডে সন্দেহ পোষণ করতেন, এরপর একদিন মাউন্ট অলিম্পাস থেকে নেমে আসেন স্বামী কী করছে সেটি দেখার জন্য। পরকীয়া লুকাতে জিউস দ্রুত আইও’কে একটি সাদা গরুতে রূপান্তরিত করেন বলে বিশ^াস করেন গ্রিকরা।
হলিউডসহ বিভিন্ন দেশের অসংখ্য সিনেমা, মিউজিক ভিডিওতে ধরা দিয়েছে বসফরাসের পানি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কতশত শেয়ার হয়েছে এর নীল স্বচ্ছপানির ছবি তার ইয়ত্তা নেই। দুই পাড়ে মৎস শিকারিদের ভীড়, পানিতে ভেসে বেড়ায় হাস, চলে গাঙচিলেদের রৌদ্রস্নান। তারই মাঝে রিভার ক্রুজে পর্যটকদের হইহুল্লোড়।তবে এই সাংস্কৃতিক গুরুত্বের বিপরীতেও বসফরাসের রয়েছে অর্থনৈতিক ও কৌশগত গুরুত্ব।
কয়েকশো বছর ধরে বিশ^ বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বসফরাস প্রণালী। এটি যুক্ত করেছে কৃষ্ণসাগরের সাথে মারমারা সাগরকে। মারমারা সাগর থেকে দার্দেনেলস প্রণালী হয়ে যাওয়া যায় ভূমধ্যসাগরে। তাই বিশ^ বাণিজ্যের পণ্য পরিবহনে কৃষ্ণসাগরের সাথে ভূমধ্যসাগরের সংযোগের রুট হিসেবেই ব্যবহৃত হয় বসফরাস।প্রতি বছর এই প্রণালী দিয়ে প্রায় ৪৮ হাজার মালবাহী জাহাজ যাতায়াত করে। যার ফলে অঞ্চলটি বিশে^র ব্যস্ততম নৌপথের একটি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।
বুলগেরিয়া, জর্জিয়া, রোমানিয়া, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মতো দেশগুলোর জন্য ভূমাধ্যসাগরে প্রবেশের একমাত্র পথ এই প্রণালী। ইস্তাম্বুল নগরীর মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা এই প্রণালীর পুরোটাই তুরস্কের সীমানার মধ্যে, যার কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই জলসীমায় তুরস্কের একক কর্তৃত্ব।যে কারণে ভূরাজনৈতিক কারণে এই প্রণালী তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধিতে বড় ভুমিকা রাখছে।
ইস্তাম্বুলের জীবন ও সংস্কৃতির ওপরও রয়েছে বসফরাসের প্রভাব। বাইজেন্টাইন সম্রাজ্যের অধীনে যখন এই নগরীর নাম ছিলো কনস্টান্টিনোপল তখন থেকেই এই নগরীর বাসিন্দাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে বসফরাস।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে ওসমানীয় খিলাফতের অধীনে আসার পর এর গুরুত্ব আরো বেড়েছে।এই প্রণালীর পাড়েই স্বগর্বে দাড়িয়ে আছে ওসমানীয় সুলতানদের প্রাসাদ তোপকাপি প্যালেস। ৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজপ্রাসাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এটি। ইউনেস্কোর বিশ^ ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত প্রাসাদটি বর্তমানে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এছাড়া রুমেলী দুর্গ, ডোলমাবাচ প্যালেস, মেইডেন টাওয়ারসহ আরো ছয় শতাধিক ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে এর দুই পাড়ে।
বলা হয়ে থাকে আমেরিকা আবিস্কারের পথও খুলে দিয়েছিল এই প্রণালীটি। ওসমানীয় শাসকরা ইস্তাম্বুল বিজয় করার পর এই বাণিজ্য রুটের ওপর তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। যার ফলে ইউরোপীয় বনিকরা বসফরাসের বিকল্প বাণিজ্য রুট খুঁজতে শুরু করেন। সেটি খুঁজতে গিয়েই আটলান্টিকের ওপারের আমেরিকা খুঁজে পাওয়া গেেেছ বলে অনেকে মনে করেন।
বসফরাসের দুই পাড়ের ইস্তাম্বুলকে এক করতে এর ওপর এখন পর্যন্ততিনটি সেতু নির্মাণ করেছে তুরস্ক। ১৯৭৩ সালে চালু হওয়া প্রথমটির নাম বসফরাস ব্রিজ। যদিও ২০১৬ সালে অভ্যুত্থান চেষ্টার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিহতদের নামে ব্রিজটির নতুন করে নামকরণ করা হয়েছে জুলাই ফিফটিন মার্টেয়ার ব্রিজ।
বসফরাস প্রণালীর দৈর্ঘ ৩০ কিলোমিটার বা ১৯ মাইল। উত্তর প্রবেশ মুখে সবচেয়ে প্রশস্ত স্থানটি ৩.৭ কিলোমিটার আর সর্বনিম্ন প্রস্ত ৭৫০ মিটার। যেখানে বসফরাসের দুই পাড়ে রয়েছে ওসমানীয় যুগের দুটি দুর্গ রুমেলি ও আনাদোলু হিসারি। স্থানভেদে এর পানির গভীরতা সর্বনিম্ন ৩৬ মিটার ও সর্বোচ্চ ১২৪ মিটার। মৌসুমভেদে এই প্রণালীর স্রোতের বেগ বিভিন্নরকম থাকে। তবে সব সময়ই এর পানিতে প্রচুর মাছের দেখা মেলে।
সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের জন্য মূলত দ্বিমুখী চলাচল পথ হয়ে আছে বসফরারস। ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগরের সামুদ্রিক প্রাণীদের এক পাশ থেকে অন্য পাশে যাওয়ার পথ এটি। যে কারণে বিশে^র অনতম একটি মৎস্য আহরন কেন্দ্র ইস্তাম্বুল। প্রায়ই দেখা যাবে বসফরাসের দুই পাড়ে মাছ ধরছে শৌখিন মৎস শিকারিরা। বেশির ভাগ সময় ঝুড়ি ভর্তি করেই তারা বাড়ি ফেরেন। আবার পেশাদার মৎসজীবীদের আনাগোনাও আছে এই প্রণালীতে।
সাধারণত দুই ধরনের মাছ দেখা যায় এর পানিতে। পরিযায়ী- অর্থাৎ যারা এক সাগর থেকে আরেক সাগরে যায় এই পথ দিয়ে। আর দ্বিতীয়টি বসফরাসের হালকা লবনাক্ত পানির স্থায়ী বাসিন্দা মাছ। বিভিন্ন মৌসুমে ব্লুফিশ, ইউরোপীয়ান পাইলচার্ড, আটলান্টিকো বোনিটো এবং নিডলফিশ এই প্রণালীর পানি দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করতে গিয়ে ধরা পড়ে মৎসজীবীদের হাতে। আর সারা বছরই পাওয়া যায় হর্স ম্যাকরেল, সী বাস, রেড গার্নার্ড, ব্ল্যাক স্করপিয়ন প্রভৃতি মাছ।
নৌ পথে বৈশি^ক তেল বাণিজ্যের বড় একটি রুট বসফরাস। প্রতিদিন গড়ে ৩ মিলিয়ন বার ৩০ লাখ ব্যারেল তেল নিয়ে জাহাজ চলাচল করে এই প্রণালী দিয়ে। যা বিশে^র মোট তেল বাণিজ্যের ৩ শতাংশ। প্রধানত রাশিয়া থেকে এবং কাস্পিয়ান সাগরের উপকূলীয় দেশগুলো থেকেও প্রতিদিন তেলবোঝাই জাহাজ যায় বিশে^র বিভিন্ন গন্তব্যে। এছাড়া রাশিয়া, ইউক্রেন, কাজাখস্তান থেকে বিভিন্ন দেশে শস্য পাঠানো হয় একই রুটে।
ইতিহাসে বেশ কয়েকবার বসফরাসের পানি ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার ঘটনা রয়েছে বলে জানা যায়। যার সবশেষটি ঘটেছিল ১৯৫৪ সালে। ইস্তাম্বুল ভিত্তিক মিল্লিয়েত সংবাদপত্র জানাচ্ছে, ওই বছর রোমানিয়া থেকে প্রচুর বরফ খণ্ড দানিয়ুব নদী হয়ে আসে কৃষ্ণসাগরে। এরপর সেগুলো ঢুকে যায় বসফরাসে। এক পর্যায়ে পুরো বসফরাসই বরফে ঢেকে যায়।
নামকরণের মতো বসফরার নিয়ে আরো কিছু কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। ওসমানীয় সম্রাজ্যের সময়ে সপ্তদশ শতাব্দীতে এক ব্যক্তি পাখা লাগিয়ে বসফরাস পাড়ি দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। ওই ব্যক্তির নাম হেজারফেন আহমেদ সেলেবি। ওসমানীয় ঐতিহাসিক ও পর্যটক ইভলিয়া সেলেবির মতে ওই ব্যক্তি নিজের জন্য একজোড়া পাখা বানিয়েছিলেন সত্যিকারের পাখির পালক জোড়া দিয়ে। এরপর তিনি ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশের গালাতা টাওয়ার থেকে ঝাপ দেন এবং বসফরাস পাড়ি দিয়ে দুই মাইল দূরে এশীয় অংশের একটি জায়গায় অবতরণ করেন। এই কাহিনী সত্যি হলে বলতে হবে সেই যাত্রাটি ছিলো প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় মনুষ্য উড্ডয়ন।
তুরস্ক ভ্রমণকারী পর্যটকদের জন্য বসফরাস একটি আকর্ষণীয় নাম। রিভার ক্রুজে চড়ে বসফরাসের সৌন্দর্য উপভোগ করেন প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক। এসব নৌযানগুলো তুর্কি নাচসহ বিনোদন আর আতিথিয়েতার অনেক উপকরণ দিয়ে সাজানো হয় পর্যটকদের জন্য। আবার ইস্তাম্বুলবাসীর নিয়মিত যাতায়াতের জন্যও বসফরাসের গুরুত্ব রয়েছে।
প্যাসেঞ্জার ফেরিতে চড়ে এই প্রণালী দিয়ে স্কুল কিংবা কাজে যায় এই নগরীর অনেক বাসিন্দা। ১৮৫৪ সাল থেকে বসফরাসের নৌসার্ভিস ইস্তাম্বুলবাসীকে সেবা দিয়ে আসছে। এই সেক্টরের সাথে জড়িয়ে আছে অনেকের জীবিকা। সরাসরি নৌ সার্ভিসের সাথে জড়িত ছাড়াও এই সার্ভিসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক ব্যবসা।
বসফরাসের পানিতেসাতার প্রতিযোগীতা বিশে^র সবচেয়ে বিখ্যাত মুক্তপানির সাতার প্রতিযোগীতার একটি।এটি বিশে^র একমাত্র ইন্টারকন্টিনেন্টাল সুইমিং রেসও। প্রতিবছর এই প্রতিযোগীতায় অংশ নেন কয়েক হাজার সাঁতারু। স্রোতের মধ্যে সাড়ে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ সাঁতরাতে হয় প্রতিযোগীদের। ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয় এই প্রতিযোগীতা। সেবার ৬৪ জন পুরুষ ও ৪ জন নারী সাঁতারু অংশ নিয়েছিলেন। এরপর ক্রমশই এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালে অংশ নিয়েছে ২ হাজার ৪০০ জন।
গ্রিক অর্থডক্স উপাসকরাও যিশুর ব্যাপ্টিজম বার্ষিকী পালন উৎসবেপ্রতি বছর একবার সাঁতার কাটেন বসফরাসের পানিতে।আবার এই প্রনালীর ওপর দিয়েই অনুষ্ঠিত হয় বিশে^র একমাত্র ম্যারাথান দৌড়, যা এক মহাদেশ থেকে শুরু হয়ে অন্য মহাদেশে শেষ হয়। ইস্তাম্বুল ম্যারাথন নামের এই প্রতিযোগীতা ইস্তাম্বুলের এশীয় অংশ থেকে শুরু হয়ে হায়া সোফিয়া, ব্লু মস্কের পাশ ঘুড়েফিফটিন জুলাই মার্টেয়ারব্রিজ পাড় হয়ে ইউরোপীয় অংশের সুলতান আহমেদ নামক জায়গায় গিয়ে শেষ হয়।