দুই ভাই জীবনে প্রথমবারের মতো একসাথে খেলতে নামলেন এবং সেদিনই তারা বিশ্বকাপ নিয়ে দেশে ফিরলেন। আবার একজন হলেন ম্যাচ সেরা খেলোয়াড়। বিস্ময়কর মনে হলেও গুজরাটের পাঠান ভাইদের গল্পটা এমনই। দুজনে প্রথম যেদিন ভারতের হয়ে একসাথে খেলেন, সেদিন তারা জিতেছিলেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শিরোপা। বারোদার এক মুয়াজ্জিনের দুই ছেলে ইউসুফ ও ইরফান খেলেছেন ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।
ক্রিকেটের আর সব বিখ্যাত ভাইদের চেয়ে পাঠান ভাইদের গল্পটা কিছুটা ভিন্ন। স্টিভ ওয়াহ-মার্ক ওয়াহ কিংবা এন্ডি ফ্লাওয়ার-গ্রান্ট ফ্লাওয়ার ভাইয়েরা যেমন জুটি বেধে ক্রিকেট বিশ্বে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন; ইউসুফ ও ইরফানের ক্ষেত্রে সেটি খুব বেশি হয়নি। দুজনে এক সাথে ম্যাচও খেলেছেন খুব কম। ভারতীয় জার্সি পরে আটটি ওয়ানডে ও সমান সংখ্যক টি-টোয়েন্টিতে দুজনে এক সাথে মাঠে নেমেছেন । তারপরও ভারতীয় ক্রিকেটে আলাদা ছাপ রেখে গেছেন গুজরাটের এই পাঠান ভাইয়েরা।
ছোট ভাই ইরফান পাঠানের আন্তর্জাতিক অভিষেকের চার বছর পর জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন বড় ভাই ইউসুফ। ততদিনে ইরফান অবশ্য দলে অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন। যদিও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইরফানের আগমনটা ছিল ধ্রুবতারার মতো। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ভারতীয় দলের জার্সি গায়ে তুলেই হৈচৈ ফেলে দেন।কপিল দেবের পর ভারতীয় বোলিং লাইনআপের সেরা অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো তাকে। দুর্দান্ত সুইং আর সীম বলে রীতিমতো ব্যাটসম্যানদের নাকানিচুবানি খাইয়ে ছাড়তেন।যে কারণে বামহাতি এই পেসারকে তুলনা করা শুরু হয় পাকিস্তানের কিংবদন্তী পেসার ওয়াসিম আকরামের সাথে।
ইরফানের বোলিংয়ের একটি ধারা ছিলো প্রথম স্পেলেই উইকেট তুলে নেয়া। প্রথম দিকেই প্রতিপক্ষের টপ অর্ডার গুড়িয়ে দিয়ে স্বস্তি এনে দিতেন ভারতীয় অধিনায়ককে। সেটা এতটাই ধারাবাহিক হয়ে উঠেছিল যে, টেস্ট ক্রিকেটে দ্বিতীয় বোলার হিসেবে প্রথম ওভারে হ্যাটট্রিকের রেকর্ড পর্যন্ত গড়েন।
বয়স ভিত্তিক দল থেকে দুর্দান্ত বোলিং করে ভারতীয় দলের দরজায় কড়া নাড়েন ইরফান। স্থানীয় অনূর্ধ-১৪ পর্যায় দিয়ে তার আনুষ্ঠানিক ক্রিকেটের পথচলা শুরু। ২০০৩ সালের যুব এশীয়া কাপ ছিলো তার উপরে ওঠার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সে আসরে ১৮ উইকেট নিয়ে ভারতীয় অনূর্ধ-১৯ দলকে শিরোপা এনে দেন। ওই আসরের বাংলাদেশের বিপক্ষে একটি ম্যাচে নিয়েছিলেন ১৬ রানে ৯ উইকেট। টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কারটা উঠেছিল তার হাতেই। পাশাপাশি ঘরোয়া ক্রিকেটেও ভালো পারফরম্যান্স করতে থাকেন।
২০০৩ সালের ডিসেম্বরে অ্যাডিলেড টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জহির খান ইনজুরিতে পড়লে অভিষেক হয় ইরফানের। ওই সফরেই ত্রিদেশীয় সিরিজে ১৬ উইকেট নিয়ে সেরা উইকেট শিকারি হন। সে বছরই পাকিস্তান সফরে পাকিস্তানি পেস অ্যাটাকের সাথেপাল্লা দিয়ে বোলিং করতে থাকেন। টেস্ট সিরিজে নেন ১২ উইকেট। এরপর ওয়ানডে সিরিজেও নেন ৮ উইকেট। ওই সফরে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরাই শুধু নয়, পুরো ক্রিকেট বিশ্ব টের পায় ইরফান পাঠানের সুইং দক্ষতার। একই বছর শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপেও সেরা উইকেট শিকারি হন এই পেসার।
ইরফান এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেননি। ২০০৪ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকেই পড়তি ফর্মের শুরু। যার কারণে দলে আসা যাওয়ার মাঝেই থাকতে হয়েছে তাকে। তবে ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসরে আবার ফিরে আসেন পুরনো রূপে। ফাইনালে তিন বলের মধ্যে শোয়েব মালিক ও শহীদ আফ্রিদিকে আউট করে পাকিস্তানকে চাপে ফেলেন। সেদিন ম্যাচ সেরার পুরস্কারটাও ওঠে তার হাতে।
যে প্রতিভা আর সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিলেন; ক্রিকেটকে তার দেয়ার ছিলো অনেক কিছুই। আইপিএলেও তার দাম উঠেছিল ১৯ লাখ ডলার পর্যন্ত। তবুও ইরফান পাঠান ভারতীয় ক্রিকেটের এক হারিয়ে যাওয়া প্রতিভা। ইরফানের ক্যারিয়ার আরো উজ্জল না হওয়ার পেছনে কারন হিসাবে বলা হয় একের পর এক ইনজুরি পড়া এবং কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের তাকে অলরাউন্ডার বানানোর চেষ্টা ।
সহজাত ব্যাটিং প্রতিভা ছিলো ছোট বেলা থেকেই। ওয়ানডে ও টেস্ট দুই ফরম্যাটেই তাকে ওপেনিং সহ টপ অর্ডারে খেলানো হয়েছে বেশ কিছু ম্যাচে। ভারতীয় দলে দীর্ঘদিন পেস বোলিং অলরাউন্ডারের যে শূন্যতা ছিলো সেটি দূর করতেই ইরফানকে নিয়ে এক প্রকার জুয়া খেলেছিলেন গ্রেগ চ্যাপেল। কিন্তু ব্যাটিংয়ে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ধার কমেছে বোলিংয়ের।
আবার সাবেক ভারতীয় অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনী ইরফানকে উপেক্ষা করতেনও বলেও অনেকে মনে করেন। ২০১৫ সালের আইপিএলে ধোনীর নেতৃত্বে চেন্নাই সুপার কিংসে খেললেও কোন ম্যাচে মাঠে নামা হয়নি তার। ধোনীর সময় জাতীয় দলেও খুব কমই দেখা গেছে তাকে।২৯ টেস্টে ১০০ উইকেট, ১২৪ ওয়ানডেতে ১৭৩ উইকেট ও ২৪ টি-টোয়েন্টিতে ২৮ উইকেট নিয়ে শেষ হয়েছে গেছে সম্ভাবনাময় এই ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার। টেস্টে ২ বার ১০ উইকেট নিয়েছেন, ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ৭ বার। ওয়ানডেতেও ৫ উইকেট নিয়েছিলেন ২ বার। এসব পরিসংখ্যান শুধু ভক্ত সমর্থকদের আক্ষেপই বাড়িয়ে চলবে।
ছোট ভাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তারকা হয়ে যাওয়ার পর কিছুটা হতাশই হয়েছিলেন ইউসুফ পাঠান। তাকে দিয়ে হবে না- এমন একটা ধারণা গেথে গিয়েছিলেন সবার মাঝে; কিন্তু শরীরে যাদের পাঠান রক্ত- তারা হাল ছাড়বেন কেন। জেদ আর পরিশ্রম দিয়েই গায়ে তুলেছেন ভারতীয় জার্সি।
দেরিতে হলেও ইউসুফ পাঠানের আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়েছিল বড় মঞ্চ দিয়ে। শুধু বড় মঞ্চ বললেও ভুল হবে, রীতিমতো বিশ্বকাপ ফাইনাল। জোহানেসবার্গে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালের দিন প্রথমবারের মতো ভারতীয় দলের হয়ে খেলতে নামেন পাঠান ব্রাদার্সের বড়জন। এবংসেদিনই প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক সাথে খেলেন দুই ভাই।
ইউসুফ ছিলেন হার্ডহিটার টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। যে কারণে প্রথম দিকে তাকে টি-টোয়েন্টিতেই বেশি দেখা যেত।দ্রুত রান তোলার ক্ষমতা তাকে শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটে জায়গা করে দেয়। যে কোন পরিস্থিতিতে ম্যাচের চিত্র পাল্টে দিতে সক্ষম ছিলেন এই ডান হাতি ব্যাটসম্যান। সেই সাথে অফস্পিন বলও করতেন। স্থানীয় বয়সভিত্তিক দল দিয়েই ইউসুফের ক্রিকেট শুরু। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে স্থায়ী জায়গা করে নিতে ইউসুফকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০০৪ সাল পর্যন্ত। ততদিনে তার ছোট ভাই ইরফান জাতীয় দলের হয়ে দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করেছেন। ২০০৬-০৭ মৌসুমে ঘরোয়া ক্রিকেটে তিন ফরম্যাটেই দুর্দান্ত খেলার পুরস্কার হিসেবে জাতীয় দলে আসেন ইউসুফ।
টি-টোয়েন্টি জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে যেন ইউসুফের ব্যাটের ধার আরো বেড়ে যায়। ২০০৮ সালে আইপিএলের প্রথম মৌসুমে ১৭৯ স্ট্রাইক রেটে করেন ৪৩৫ রান। ফাইনালে বল হাতে ৩ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে ৩৯ বলে ৫৬ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে শিরোপ এনে দেন রাজস্থান রয়্যালসকে। এরপর ভরতের ওয়ানডে দলেওজায়গা করে নেন।
ছোট্ট ক্যারিয়ারে ৫৭ ওয়ানডে ও ২২ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। তবে তাতেই মনে রাখার মতো বেশ কিছু ইনিংস উপহার দিয়েছেন। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে বেঙ্গালুরুতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩১৬ রানের টার্গেট তাড়া করতে নেমে ১৮৮ রানে ৫ উইকেট পড়ে যায়। সেখান থেকে অতিমানবীয় এক ইনিংস খেলেন ৬ নম্বরে ব্যাট করতে নামা ইউসুফ। ৯৬ বলে অপরাজিত ১২৩ রান করে ম্যাচ শেষ করে মাঠ ছাড়েন।আইপিএলে ২১ লাখ ডলার পর্যন্ত দাম উঠেছিল তার। তবে ওয়ানডেতে ব্যাটিংয়ে ধারবাহিক ছিলেন না বলেই হয়তো ক্যারিয়ার দীর্ঘ হয়নি।
ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটের বরোদা শহরে এক ধার্মিক পাঠান পরিবারে জন্ম ইউসুফ ও ইরফানের। জন্ম যথাক্রমে ১৯৮২ ও ’৮৪ সালে। বাবা ছিলেন স্থানীয় মান্দবি গেট জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন। মসজিদ কপ্লেক্সের মধ্যেই ছোট একটি বাসায় ছিলো তাদের বসবাস। স্বল্প আয়ে কোন মতে চলতো পরিবারটি।কয়েক প্রজন্ম ধরেই ওই মসজিদটির সাথে আত্মিক সম্পর্ক ছিলো পরিবারটির। তাদের দাদাও ছিলেন সেখানকার মুয়াজ্জিন।
মসজিদের মাঠেই ক্রিকেট হাতে খড়ি দুই ভাইয়ের। কখনো লুকিয়ে খেলতেন মসজিদের বারান্দায়। যদিও বাবা চেয়েছিলেন ছেলেদের ইসলামিক স্কলার বানাতে। কিন্তু তাদের টান বেশি ছিলো মাঠের দিকেই। তবে বাবা চাইতেন ছেলেরা যাই করুক সেটা যেন সততা, শৃঙ্খলা আর পরিশ্রমের সাথে করে। যে কারণে নিজেই সময় মত অনুশীলনে পাঠাতেন। মাঠে গিয়ে উৎসাহও দিতেন। পারিবারিকভাবে শৈশব থেকেই ধর্মীয় শিক্ষাটা পেয়েছিলেন দুজনেই। বাবার বদলে দু ভাই প্রায়ই আজান দিতেন মসজিদের মাইকে।
দুই ছেলে ভারতের জাতীয় দলের হয়ে খেলছে সেটি ছিলো বাবা মেহমুদ খান পাঠানের জীবনের অন্যতম সেরা মূহুর্ত। আাবার সেদিনই তারা জয় করেছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। মাহমুদ খান পাঠান তাই ছেলেদের নিয়ে গর্ব করতেই পারেন।
যে মহল্লায় বড় হয়েছেন সেখানকার বাসিন্দাদের বেশির ভাগই দরিদ্র মুসলিম। ক্রিকেট খেলে স্বচ্ছলতা আসার পর পাঠান পরিবার নিয়মিতই এসব মানুষের পাশে দাড়িয়েছে বিভিন্ন সময়ে। করোনা ভাইরাসের মহামারীর সময় স্থানীয় দরিদ্র পরিবারগুলোকে সহযোগিতা করেছেন দুভাই। স্থানীয় ছেলেদের কম খরচে ক্রিকেট শেখার সুযোগ করে দিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন ক্রিকেট অ্যাকাডেমি অব পাঠান। আবার গ্রেগ চ্যাপেলের মতো কোচকেও যুক্ত করা হয়েছে সেই অ্যাকাডেমির সাথে। যে কারণে দ্রুত জনপ্রিয়তা পায় অ্যাকাডেমিটি।
এরপর ভারতের বিভিন্ন স্থানে এর শাখা খোলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ২০টি শাখা রয়েছে পাঠান অ্যাকাডেমির। এই সংখ্যা পঞ্চাশে উন্নিত হবে বলে তাদের আশা। দুই ভাই এখন পুরোদমে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে ক্রিকেটার গড়ার এই কারখানা নিয়ে। অ্যাকাডেমির মাধ্যমে নিজেদের মেধা আর অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিতে চান আগামী দিনের ক্রিকেটারদের মাঝে।
ইরফান বিয়ে করেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত সৌদি মডেল সাফা বেগকে। ২০১৬ সালে মক্কায় ঘরোয়াভাবে তাদের বিয়ে হয়। আর ইউসুফের স্ত্রী আফরিন একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক। উভয় দম্পতির একটি করে ছেলে সন্তান রয়েছে।