আধুনিক ক্রিকেটে মারদাঙ্গা ব্যাটিংয়ের সূচনা হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি ভিভ রিচার্ডসের হাত দিয়ে। আর সেটাকে যারা পূর্ণতা দিয়েছেন তাদের একজন শহিদ আফ্রিদি। কেতাবি ক্রিকেটের বাইরেও যে ক্রিকেটের আরেকটি জগত রয়েছে সেটাকেই যেন অর্থ, সংজ্ঞা আর ব্যাখাসহ উপস্থাপন করেছেন তিনি। লেগ স্পিনার হিসেবে ক্রিকেটে এসে যিনি হয়ে গেছেন ওপেনার। আবার ক্যারিয়ারের মাঝপথে রূপ নিয়েছেন পুরোদস্তুর অলরাউন্ডারে। খেলার পাশাপাশি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেও যার জুড়ি নেই।
আফগান সীমান্তবর্তী পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের পাঠান জাতির এক আফ্রিদি উপজাতীয় পরিবারে জন্ম শহিদ আফ্রিদির। পুরো নাম শাহেবজাদা মোহাম্মাদ শহিদ খান আফ্রিদি। সতীর্থরা ভালোবেসে ডাকেন লালা নামে। প্রথাগত ক্রিকেটের সাথে যার আজীবনের শত্রুতা। পরিস্থিতি, কন্ডিশন, পিচের ধরন, প্রতিপক্ষ সব কিছুকে থোড়াই কেয়ার করে খেলেছেন পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে। যে কারণে ভাষ্যকারেরা নাম দিয়েছেন বুম বুম আফ্রিদি।
মহাতারকা হয়তো হতে পারেননি, তবে একটা জায়গায় তিনি অনেক মহাতারকার চেয়ে এগিয়ে। সেটা জনপ্রিয়তা আর দর্শকদের বিনোদন দেয়ার ক্ষেত্রে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট চালু হওয়ার বহু আগেই যিনি শুরু করেছিলেন ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিং। তার মাঠে নামা মানে দর্শকের নড়েচড়ে বসা। তিনি নিজেও হয়তো জানেন না কখন কী করবেন। যতক্ষণ মাঠে থাকেন প্রতিপক্ষ থেকে দর্শক সবাইকে নাচিয়ে ছাড়তেন। ক্রিকেট যদি হয় বিনোদন, তাহলে নিঃসন্দেহে সেখানে সেরা এন্টারটেইনার আফ্রিদি।
কৈশোর থেকেই ক্রিকেটকে ধ্যানজ্ঞান করে বেড়ে উঠেছেন। স্কুলের চেয়ে মাঠের প্রতিই টান ছিলো বেশি। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করে ১৬ বছর বয়সেই ডাক পান জাতীয় দলে। ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে কেনিয়ায় চারজাতি টুর্নামেন্টে মুশতাক আহমেদের বদলী হিসেবে ‘এ’ দলের হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে থাকা লেগস্পিনার আফ্রিদিকে ডাকা হয়। ২ অক্টোবর কেনিয়ার বিরুদ্ধে নাইরোবিতে অভিষেক হয় তার। সে ম্যাচে কেনিয়া অল্পরানে অল আউট হয়ে যাওয়ায় ব্যাট করার সুযোগ হয়নি।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পরের ম্যাচের আগের দিন নেটে তার ব্যাটিং স্টাইল নজর কাড়ে অধিানায়ক সাইদ আনোয়ারের। সেই ম্যাচে তাই আফ্রিদিকে তিন নম্বরে ব্যাট করতে নামিয়ে দেয়া হয়। উদ্বোধনী জুটি ভালো করায় তাকে লাইসেন্স দেয়া হয় নিজের খুশি মতো খেলার। কিছুদিন আগে শচীন টেন্ডুলকারের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন একটি ব্যাট। সেই ব্যাট নিয়েই ব্যাটিংয়ে নামেনআর গড়েন ইতিহাস। শ্রীলংকার বোলারদের ছাতু বানিয়ে গড়েন ৩৭ বলে সেঞ্চুরির নতুন রেকর্ড। আগে রেকর্ডটি ছিলো৪৮ বলে সনথ জয়সুরিয়ার। সেই জয়সুরিয়ার সামনেই গড়া আফ্রিদির রেকর্ডটি দীর্ঘ ১৭ বছরেরও বেশি সময় টিকে ছিলো ওয়ানডেতে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড হিসেবে।
ইতিহাস গড়া সেই ব্যাটিং করার পর লেগস্পিনার থেকে হয়ে যান পুরোদস্তর ব্যাটসম্যান। কিছুদিন পর দেখা যায় সাঈদ আনোয়ারের ওপেনিং পার্টনার হিসেবে। দুই বছর পর সুযোগ পান টেস্ট খেলার। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টেই চেন্নাইতে ভারতের বিপক্ষে খেলেন ম্যাচ জেতানো ১৪১ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। কিন্তু উল্টো পথে হাঁটার জন্যই যার জন্ম- তিনি কেন এক জায়গায় থিতু হবেন?
সেঞ্চুরি করে ক্যারিয়ার শুরু করা আফ্রিদির দ্বিতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরিটি পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে দুই বছরেও বেশি সময়। পড়তি ফর্মের কারনে স্থায়ী হতে পারেননি ওপেনিং পজিশনে।ছিটকেপড়ার শঙ্কা যখন তৈরি হলো, তখনই জেগে ওঠে তার পুরনো লেগস্পিনার সত্তা। ধীরে ধীরে ভালো বোলিং করতে শুরু করেন। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের ওপেনার আফ্রিদি ২০০৩ বিশ্বকাপে খেলেন লেগ স্পিনার হিসেবে। তবে তার ব্যাটিং একেবারে হারিয়ে যায়নি কখনও। ধীরে ধীরে নিজেকে পরিচিত করেন অলরাউন্ডার হিসেবে।
তবে পরিচয় যাই হোক শহিদ আফ্রিদির নাম শুনলে সবার আগেই মনে পড়বে তার ধুমধারাক্কা ব্যাটিং এর চিত্র। যে কারণে ভারতীয় ভাষ্যকার রবি শাস্ত্রী তার নাম দিয়েছেন ‘বুমবুম আফ্রিদি’। নামের স্বার্থকতা রাখতে ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ৩৫১টি ছক্কা মারার রেকর্ডটি দির্ঘদিন ধরেই তার দখলে।
আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আসার পর শহিদ আফ্রিদি যেন তার মন মতো ব্যাটিং করার জায়গাটি পেয়ে যান। এই ফরম্যাটে তিনি কতটা কার্যকর তার প্রমাণ রাখতেই যেন ২০০৭ সালের প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে তোলেন পাকিস্তানকে। মিসবাহ উল হকের সেই বহুল আলোচিত সুপার স্কুপে পাকিস্তান ফাইনালে হারলেও আফ্রিদি পান টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার। পরের বার অর্থাৎ ২০০৯ সালের আসরে আর কারো ভুলে শিরোপা হাতছাড়া না হয় সে জন্যই হয়তো নিজের কাধেই তুলে নেন সব দায়িত্ব। ফাইনাল ও সেমিফাইনালে ম্যাচ সেরা নৈপুণ্য দেখিয়ে পাকিস্তানকে এনে দেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শিরোপা।
২০০৬ সালে শহিদ আফ্রিদি বিদায় দেন টেস্ট ক্রিকেটকে। ইচ্ছে ছিল সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মনোযোগ দেয়ার; কিন্তু তিন ফরম্যাটের নেতৃত্ব কাঁধে এসে পড়ায় ২০১০ সালে ফেরেন সাদা পোশাকে। তবে ইংল্যান্ড সফরে একটি টেস্ট খেলেই আবারও ছেড়ে দেন টেস্ট খেলা। চালিয়ে যান সংক্ষিপ্ত পরিসরের ক্রিকেট।
২০১১ বিশ্বকাপে আফ্রিদির নেতৃত্বেই খেলে পাকিস্তান। সেবার বল হাতে টুর্নামেন্ট সেরা ২১ উইকেট নেন আফ্রিদি। ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় বলেছেন ২০১৫ বিশ্বকাপের পর। তারপরও কিছুদিন জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন টি-টোয়েন্টি। আর এখন খেলছেন বিভিন্ন দেশের ফ্রাঞ্চাইজি লিগে।
যখন যে পরিচয়েই খেলেছেন কখনই আলোচনার বাইরে যেতে দেননি নিজেকে। আইসিসির অলরাউন্ডার র্যাঙ্কিং চালু হওয়ার পর সব সময়ই সেরা পাঁচে ছিলেন। পুরো ক্যারিয়ারে ৩৯৮টি ম্যাচ খেলে ব্যাট হাতে ৮ হাজার রানের পাশাপাশি নিয়েছেন ৩৯৫টি উইকেট। এখনও পর্যন্ত ওয়ানডে ক্রিকেট যে কোন অলরাউন্ডারের সেরা নৈপুণ্য এটি। ৬টি সেঞ্চুরির সাথে আছে ও ৩৯টি হাফ সেঞ্চুরি। স্ট্রাইক রেট ১১৭, ১৫০টির বেশি ম্যাচ খেলেছেন এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে যা এখন পর্যন্তসেরা। তবে বড় দুর্বলতা ছিলো টাইমিংয়ে। যে কারণে বেশির ভাগ সময়ই ইনিংসটাকে লম্বা করতে পারতেন না।
ওয়ানডেতে ম্যাচ সেরা হয়েছেন ৩২ বার, যা যৌথভাবে রিকি পন্টিং ও জ্যাক ক্যালিসের সাথে তৃতীয় অবস্থান। বল হাতে ইনিংসে ৫ বা তার বেশি উইকেট নিয়েছেন ৯ বার সেটিও ওয়ানডে ইতিহাসে ওয়াকার ইউনুস ও মুরালিধরনের পরে তৃতীয় অবস্থান। অধিনায়ক হিসেবে ৩৮টি ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন যেখানে জয়ের হার শতকরা ৫২ ভাগ। ৯৯ থেকে ২০১৫- টানা পাঁচটি বিশ্বকাপে খেলেছেন। ২০১১ বিশ্বকাপে তার নেতৃত্বে সেমিফাইনালে উঠেছিল পাকিস্তান।
বলা হয়ে থাকে পরিসংখ্যান দিয়ে আফ্রিদিকে মেলানো যায় না; কিন্তু তার পরিসংখ্যানও যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্য ঈর্ষণীয়। বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারদের কাতারে থাকবে তার নাম। সমালোচকরা বলেন, একটু দায়িত্বশীল ক্রিকেট খেললে হয়তো সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবেই নিজেকে চেনাতে পারতেন।
ব্যক্তিগত জীবনে ৫ কন্যার জনক আফ্রিদি পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের প্রথাগত বিশৃঙ্খলা আর কেলেঙ্কারি থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছেন। ছোটখাট দুএকটি ঘটনা ছাড়া পরিচ্ছন্ন ক্রিকেট খেলেছেন ক্যারিয়ার জুড়ে। ২০ বছরের ক্যারিয়ারে দর্শক সমর্থক তো বটেই বড় বড় তারকা ক্রিকেটারদেরও মন জয় করেছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি বোলার মাইকেল হোল্ডিং বলেছেন, ‘ক্রিকেট ক্রিকেটই না, যেখানে আফ্রিদি নেই।’ ক্রিকইনফো তাদের ওয়েবসাইটে বলেছ- ক্রিকেটে তার মত খেলোয়াড় আগেও ছিলনা, ভবিষ্যতেও আসবে না।’
পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন বিস্তর। সেই ভালোবাসার ঋণ শোধ করতেই হয়তো সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাড়ানোর পণ করে নেমেছেন মানব কল্যাণে। ২০১৪ সালে তার গড়া প্রতিষ্ঠান শহিদ আফ্রিদি ফাউন্ডেশন ‘হোপ- নট আউট; স্লোগান নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের জন্য। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিশুদ্ধ পানি, ক্রিকেট উন্নয়ন ও জরুরী সহায়তা- এই ৫টি সেক্টরে সংগঠনটি কাজ করে। শহিদ আফ্রিদি ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, শিক্ষাখাতে কাজের অংশ হিসেবে করাচি, লাহোর, আজাদ কাশ্মিরে ১৪টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে সংগঠনটি। এসব স্কুলে বিনা খরচে পড়াশোনা করছে ৪ হাজারের বেশি শিশু শিক্ষার্থী।
প্রত্যন্ত খাইবার পাখতুন খোয়া প্রদেশের কোহাটে শহিদ আফ্রিদি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছে ১৬ বেডের শাহেবজাদা ফজল রহমান চ্যারিটি হাসপাতাল। আশপাশের ২০ গ্রামের মানুষ বিনামূল্যে চিকিৎসা পায় এখানে। আধুনিক ল্যাব সুবিধা, সার্বক্ষণিক চিকিৎসকসহ অনেক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে হাসপাতালটিতে। একই রকমভাবে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষকে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে শহিদ আফ্রিদির সংগঠন স্থাপন করেছে ১২১টি হ্যান্ড পাম্প, নির্মাণ করেছে ২৫টি পানির ট্যাংক। সব মিলে বিভিন্ন অঞ্চলের ৭৫টি গ্রামের ২ লাখ ৪৫ হাজার মানুষ বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে সংস্থাটির সহযোগিতায়।
এর পাশাপাশি উঠতি ক্রিকেটারদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও দরিদ্র ক্রিকেটারদের মাঝে ক্রীড়া সামগ্রী বিতরণ করে প্রতিষ্ঠানটি। শহিদ আফ্রিদি ফাউন্ডেশন সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে তাদের করোনাকালীন মানবিক সহায়তা কার্যক্রম দিয়ে। লকডাউনের সময় দরিদ্রদের দুয়ারে দুয়ারে খাবার পৌছে দিয়েছে। এসব কার্যক্রম সরাসরি নিজেই তত্ত্বাবধান করেছেন শহিদ আফ্রিদি। প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছে গেছেন খাবারের ট্রাক নিয়ে। নিজেও আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়, তবুও দমে যাননি। সুস্থ্য হয়েই আবার নেমেছেন ত্রাণ কাজে। বিশ^ব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে শহিদ আফ্রিদির সেসব কার্যক্রম।আরো অনেকভাবে মানুষের পাশে দাড়াচ্ছেন আফ্রিদি। যেমন করোনাকালে মানবিক সহায়তার জন্য নিলামে তোলা বাংলাদেশী ক্রিকেটার মুশফিকুর রহীমের একটি ব্যাট ১৭ লাখ টাকায় কিনেছেন আফ্রিদি।
এসব ঘটনা এক মানবদরদী চরিত্রের আফ্রিদির কথাই তুলে ধরে। ব্যাট হাতে তিনি প্রতিপক্ষের বোলারদের ওপর যতটা নিষ্ঠুর, ব্যক্তিগত জীবনে ঠিক তার বিপরীত। সেখানে মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়তে তিনি সত্যিকারের এক চ্যাম্পিয়ন।
সুদর্শন চেহারার আর মারদাঙ্গা ব্যাটিংয়ের কারণে সারা বিশ্বেই আফ্রিদির জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি। যেদিন তার ব্যাট হাসে দর্শকদের টিকেটের পয়সা উসুল হয়। দীর্ঘদিন দর্শক সমর্থকদের ক্রিকেটের নেশায় বুদ করে রেখেছেন এই তারকা। ক্রিকেট খেলা চলবে যুগ যুগ ধরে, তবে আরেকজন আফ্রিদি আসবে কিনা সেটি একমাত্র স্রষ্টাই জানেন।