শিক্ষার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় পাঠ তৈরি, শিক্ষাদান ও মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। আগামীর শিক্ষাব্যবস্থায় নিরাপদ পাঠদান নিশ্চিত করতে, করোনা ঝুঁকিমুক্ত পদ্ধতি ও ভবিষ্যতে শিক্ষাখাতে বিকল্প পথ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে। ভবিষ্যতে কোনো মহামারিতেও যেন নিরাপদ ক্লাসরুম নিশ্চিত করা যায়, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠামুক্ত পরিবেশে পঠন-পাঠন চলে তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। ক্লাসরুমের বিকল্প পদ্ধতি নিয়েও পরিকল্পনা শুরু হয়ে গেছে। পুরনো শিক্ষাপদ্ধতি অবলম্বন হবে না। অনলাইন শিক্ষা হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের বিকল্প শিক্ষার আরেকটি নতুন ধারা।
করোনার প্রভাবে উন্নতবিশ্বে ইতোমধ্যে শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষা কার্যক্রমে ডিজিট্যাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার বেড়েছে। উন্নত বিশ্বে সামাজিক মাধ্যম জুম অ্যাপ ব্যবহার করে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। ছেলেমেয়েদের ফাঁকা জায়গায় দূরে দূরে বসিয়ে ‘লকডাউন স্কুল’ চলছে। হোয়াইট বোর্ড, মার্কার ও পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে অভ্যস্ত ফ্যাকাল্টির মানসিকতাকেও এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে।
আগামীতে পরীক্ষা মুখস্থবিদ্যার উপর ভিত্তি করে হবে না। ভবিষ্যতে পরীক্ষার প্রশ্নসমূহ বিশ্লেষণাত্মক হবে এবং ছাত্রদের আরও সৃষ্টিমূলক হতে হবে। কোচিং-গাইড নির্ভরতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অবলুপ্ত হবে। মুখস্থবিদ্যার বদলে নতুন কিছু তৈরিকে, অথবা নতুন চিন্তাধারাকে উৎসাহিত করা হবে। যার যে বিষয়ে দক্ষতা রয়েছে, তাকে সে বিষয়ে পারদর্শী করে তোলা হবে।
ভবিষ্যতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। অনেক কাজ যা এখন শিক্ষকেরা করেন তা স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠবে। এই পরিবর্তনের জন্য শিক্ষকদের নিজেদের খাপ খাওয়াতে হবে।
বাচ্চারা যাতে নিরাপদে স্কুলে ফিরতে পারে তার সমাধান খোলা মাঠে স্কুল ব্যবস্থা। হালকা ওজনের টেবিল ও চেয়ার বাগানে নিয়ে টিচাররা মাঠে বসে উন্মুক্ত জায়গায় প্রকৃতির সান্নিধ্যে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে পারেন। খোলা চত্বরে, উঁচু ভবনের ছাদে এবং এমনকি পরিত্যক্ত নৌকায় পাঠদানের বিষয়টি গুরুত্ব পেতে পারে। সিঙ্গাপুরে বহু বছর ধরে বাইরে খোলা আকাশের নিচে লেখাপড়া শেখানোর চল রয়েছে। দেশটি শিশু কিশোরদের শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্ত করে তোলার জন্য খোলা জায়গায় পাঠদানে সাফল্য পেয়েছে।
এখন ক্লাস নেওয়া হচ্ছে জুম বা ওয়েবএক্স বা স্কাইপ বা গুগল হ্যাংআউটস বা মাইক্রোসফট টিম বা গোটুমিটিং ব্যবহার করে। এই ভিডিয়ো কনফারেন্সিং সফটওয়্যারগুলির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দেখতে পান শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে। লেকচারকে অনলাইন ক্যামেরার সাহায্যে রেকর্ড করায় ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষামূলক কনটেন্ট তৈরি হয়। গুগল ক্লাসরুম, গুগল হ্যাংসাউট মিট, স্কাইপে, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এর মাধ্যমে সহজেই শ্রেণী কার্যক্রম চালানো যায়।
হাতে লেখা কাগজের লেকচারশীট বা নোটের জায়গায় এসেছে পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বা পিডিএফ বা ওয়েবসাইট লিংক বা ইউটিউব লিঙ্ক। অনলাইন মাধ্যমগুলোর সবচাইতে বড় সুবিধা হচ্ছে এসবের সহজ সংরক্ষণ। তাই শিক্ষাদানের পরেও শিক্ষার্থীরা নিজেদের সময়ানুসারে অনলাইনে পড়তে বা ডাউনলোড করে নিয়ে নিতে পারছে।
উপস্থিতি নথিভুক্ত করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে গুগল স্প্রেডশিট এবং গুগল ক্লাসরুম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেও উপস্থিতির নথি রাখা হচ্ছে। এখানেও কোনও কারচুপির জায়গা নেই। যা হচ্ছে তা সাদাকালো নথির সাহায্যেই হচ্ছে। এই নথি দরকার মতো প্রশাসনিক প্রয়োজনেও ব্যবহার করা সম্ভব।
করোনা-পরবর্তীতে ৪০ শতাংশ পাঠ অফলাইনে গতানুগতিক পন্থায় দেওয়া হবে। বাকি ৬০ শতাংশ ইন্টারনেট-ভিত্তিক শিক্ষা হবে। করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে বুদ্ধিগত বিকাশে অনলাইন শিক্ষাকেই অগ্রাধিকার দেবে। অনলাইন শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার এই পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে। প্রযুক্তিনির্ভর অন্যান্য ব্যবস্থার মতোই হয়তো অনলাইন শিক্ষাটাও এক সময় ‘অতি স্বাভাবিক’ একটি কার্যক্রম হয়ে উঠছে। এর মানে অফলাইন-অনলাইন পদ্ধতির মিশ্রস্রোত শিক্ষাকাঠামোয় প্রাণ ফিরিয়ে দেবে।
দূরশিক্ষণ শিক্ষাব্যবস্থায় বিপ্লব আনছে। ক্যাম্পাস-ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ক্যাম্পাসহীন শিক্ষাব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ছাত্ররা ঘরে বসেই পড়াশোনা করবেন নানান অভিনব পন্থা ব্যবহার করে। তাই ভবিষ্যতে কাজ এবং পড়াশোনা, দুটোই চালিয়ে যাওয়ার অপরিমিত সুযোগ থাকবে। মুখস্থবিদ্যাকে প্রতিস্থাপন করবে সত্যিকারের বিদ্যা।
ডিগ্রিসর্বস্ব শিক্ষা থাকবে না। দক্ষতা দান না করলে সেই শিক্ষার মূল্য থাকবে না। কাগুজে ডিগ্রির দিন শেষ হতে চলেছে। করোনা মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার দাম। অভিজ্ঞতা বাড়ানোর সুযোগ হিসেবে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রচুর অনলাইন ক্লাস আছে। এ সংখ্যা আরো বাড়তে থাকবে।
করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। শিক্ষক এবং ছাত্র ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এবং লিঙ্কেডিন স্লাইডশেয়ারের সাহায্যে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। স্থান এবং কাল ভবিষ্যতে শিক্ষার ক্ষেত্রে গৌণ হয়ে যাবে। কোনো একটা ব্যবস্থার সঙ্গে মানুষ যখন অভ্যস্ত হয়ে যায়, সেখান থেকে সে সহজে বেরিয়ে আসতে চায় না।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্জাল একটি মৌলিক মানবাধিকারে পরিবর্তিত হবে। খাদ্য, পরিধান এবং বাসস্থানের মতো তথ্য আমাদের প্রাথমিক প্রয়োজনে পরিবর্তিত হব। একই ভাবে শিক্ষাক্ষেত্রেও অন্তর্জাল অপরিহার্য হয়ে উঠবে। অনলাইন আলোচনাসভা বা ওয়েবিনার জ্ঞান অর্জন এবং জ্ঞান বিতরণের একটি প্রাথমিক পন্থা হয়ে উঠবে। আমরা বিশ্বজুড়ে সব নামী বিশ্ববিদ্যালয় একাধিক ওয়েবিনার সংগঠিত করছে। করোনা-পরবর্তী জগতে ওয়েবিনারের সংখ্যা বাড়বে বই কমবে না।
করোনা-পরবর্তী জগতে শিক্ষা ছাত্রদের মধ্যে সৃষ্টিশীলতা বিকাশে সাহায্য করবে। তথ্যভিত্তিক শিক্ষা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই পাল্টে যাওয়া বা বদলের সঙ্গে খাপ খাওয়ায়ই সামনে চলতে হবে।
অনলাইন পাঠ কার্যক্রমের অন্যতম উপাদান। গুরুত্ব পাবে বিভিন্ন মাধ্যমে অডিও, ভিডিও রেকর্ডিং, স্লাইড, পিডিএফ, ওয়ার্ড ডক্যুমেন্ট, স্ক্যান, ইমেজ ইত্যাদির। নিয়মিত বাড়ির কাজ বা অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া, মৌখিক প্রশ্নোত্তর, কুইজ, আলোচনা বা ভাইভা নেয়ায় মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হবে। পরীক্ষা নেয়ার অনলাইন পদ্ধতি আরো সংহত হবে। ইতোমধ্যেই পড়াশোনা নতুন মাত্রা পেয়েছে ডেস্কটপ, ল্যাপটপ আর স্মার্টফোনের পর্দায়।
বিল গেটস এবং ম্যালিন্ডা গেটসের উদ্যোগে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি এবং ম্যাসাচুসেস্ট ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সহযোগিতায় অনলাইন ক্লাসরুম ‘ইডিএক্স ’ চালু রয়েছে। অলাভজনক এ প্ল্যাটফর্মের স্লোগান হচ্ছে ‘ভবিষ্যতের জন্য অনলাইন এডুকেশন: সবার জন্য, যেকোনো জায়গা থেকে, যেকোনো সময়’। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অনলাইন ক্লাসরুম রয়েছে। অনলাইন ক্লাসরুমের পাইওনিয়ার ‘খান একাডেমি’ এগিয়ে চলছে। অনলাইনে পড়াশোনার এ ধরনের উদ্যোগ দিন দিন বাড়বে। ক্লাসরুমকে চিন্তা করেই ডিজিটাল ক্লাসরুমের কনসেপ্ট তৈরি হয়েছে।
ফেসবুক বা জুম ব্যবহার করে অনলাইন পাঠদান হয়। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ইউটিউব চ্যানেলকে ব্যবহার করা যায়। ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেলেও কনটেন্টগুলো দিলে শিক্ষার্থীরা সহজে পায়। অনেকেই সেগুলো দেখে ও সে অনুযায়ী পড়াশোনা করে। প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক বা ইউটিউব চ্যানেলে প্রতিদিনকার ক্লাসগুলো আপলোড করা যায়। আগে থেকেই সব শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের নাম ঠিকানা এবং মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা যায়। শিক্ষকরা কথা বলতে পারেন। তথ্য নিতে পারেন। অভিভাবকদের মাধ্যমে পড়াশোনার নির্দেশনাও দিতে পারেন।
রেকর্ডকৃত ক্লাসের জনপ্রিয়তা জোরদার হতে শুরু করেছে।খান একাডেমির মতো শিক্ষামূলক ভিডিও ক্লাসগুলো ছাত্ররা ধীরে ধীরে ব্যবহার করা শুরু করেছে। ‘টেন মিনিট স্কুল’, ‘রেপ্টো’, ‘শিক্ষক বাতায়ন’, ‘ই-শিক্ষণ’, ‘স্টাডি-প্রেস’ ইত্যাদির মতো আরও বেশ কয়েকটি অনলাইন ক্লাসরুম প্ল্যাটফর্ম কার্যক্রম শুরু করেছে। শিক্ষার্থীরা নিজের সময়-সুযোগমতো নিজের অবস্থানে থেকেই এই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে।
বেতারকে পার্টনার করে এফএম ও কমিউনিটি রেডিওগুলোকে যুক্ত করে শিক্ষকদের মাধ্যমে পাঠদানের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। এই বেতার কার্যক্রম। টিভি ও ইন্টারনেটের চেয়েও রেডিও কাভারেজ বেশি থাকায় এবং সেটিকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীকে প্রযুক্তিগত শিক্ষাদান কার্যক্রমের আওতায় আনা যাবে বলে মনে করছেন তারা।
ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ বাড়বে, কম্পিউটারের মাধ্যমে নিত্যনতুন বিষয় শেখার সুযোগ বাড়বে। প্রতিটি শিশুর হাতে অক্ষর জ্ঞান নিয়ে বিভিন্ন গেমস, ছবি, কার্টুনসহ বিভিন্ন ই-বুকসহ ল্যাপটপ তুলে দেয়ার চেষ্টা বাড়বে। শিক্ষার জন্য স্কুলেই যেতে হবে না। অনলাইন ক্লাসরুম হবে ফ্রি। বিনা খরচে প্রতিটি মানুষ নিজের ইচ্ছামত পড়াশোনা করবে কম্পিউটারের সামনে বসেই। যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গা থেকে নিজের পছন্দমত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থাকবে।
প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নেওয়ার জন্য ব্যবহার উপযোগী সফটওয়্যার হবে। অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা গ্রহণ ও যথাযথ মূল্যায়ন নিশ্চিত করার সমস্যা দূর হবে। অনলাইনে নানা ধরনের কুইজ, অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রোজেক্ট পেপার তৈরি এবং ডিফেন্স, মৌখিক পরীক্ষা, ওপেন বুক পদ্ধতিসহ লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করে শিক্ষাকার্যক্রম চলবে।
স্কুল ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন পদ্ধতি হতে পারে অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ লাভের শ্রেষ্ঠ উপায়। উন্নত বিশ্বে দূরশিক্ষণ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইরানে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে প্রধানত জনপ্রিয় অ্যাপ্লিকেশন হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে। ইরানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘শাদ’ নামে একটি লার্নিং অ্যাপ চালু করেছে। এ অ্যাপে সব স্কুলশিক্ষার্থীকে রেজিস্টার করার জন্য বলা হয়েছে, যাতে তারা অনলাইনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে।
রিলায়েন্স জিও- উদ্ভাবন করেছে নতুন ভার্চুয়াল ক্লাসরুম এমবাইব (ঊসনরনব)। এই বিশ্বমানের ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মেই রয়েছে ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের সুবিধা। এমবিবে-র সাহায্যে অনলাইনে শিক্ষকরা ক্লাস নিতে পারবেন। ক্লাসের মধ্যেই প্রশ্ন করতে পারেন শিক্ষার্থীরা। আলাদা উইন্ডোতে প্রশ্ন লিখে পাঠানো যাবে। একসঙ্গে অনেক পড়ুয়া ক্লাস করতে পারবেন। অনলাইনেই বই পাবেন শিক্ষার্থীরা।