ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্য বা আরবের প্রাচীনতম একটি ভূখণ্ড। ইসলামের ইতিহাসের বিরাট জায়গা দখল করে আছে এই ফিলিস্তিন। কারণ, অসংখ্য নবী-রাসুলের স্মৃতিবিজড়িত এই ভূমিতে রয়েছে মুসলিম উম্মাহর প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস বা আল-আকসা। এক সময় ফিলিস্তিন ভূখণ্ড বলতে তৎকালীন বিশ্বে প্রভাবশালী বিস্তৃত এক অঞ্চলকে বুঝালেও আজ তা প্রতিনিয়ত সঙ্কুচিত হচ্ছে ইসরায়েলি আগ্রাসনে। আমেরিকা ও ব্রিটেনসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যক্ষ মদদে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হলে ফিলিস্তিনি ভূমি দখল ত্বরান্বিত হয়। একসময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নির্যাতিত ইহুদিদের আশ্রয় দিয়েছিলেন ফিলিস্তিনিরা। কিন্তু কালের বিবর্তনে আজ তারাই নিজভূমে পরবাসী।
মাত্র ৬ হাজার ২০ কিলোমিটার আয়তনের ভূমি আজকের ফিলিস্তিন। যার মধ্যে পশ্চিম তীরের আয়তন ৫ হাজার ৬৫৫ এবং গাজার আয়তন ৩৬৫ কিলোমিটার। প্রতিনিয়ত নিজেদের ভূমি, ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে ফিলিস্তিনের মুসলিমদের। শত সংগ্রামের মধ্যেও তারা রক্ষা করার চেষ্টা করছে তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সাধারণত ফিলিস্তিন বলতেই ইসরায়েলের আগ্রাসন, হামলা, হত্যা, জুলুম, নিযার্তন, গ্রেপ্তার ইত্যাদি বিষয়গুলোই আলোচনা বা প্রচার হয়ে থাকে।
ফিলিস্তিনিদের জীবনযাত্রায় গভীর প্রভাব বিস্তার করে আছে তাদের নিজস্ব রমজান সংস্কৃতি। তাদের কাছে রমজান হলো আধ্যাত্মিক সাধনা ও আপন প্রত্যয়ে বলিষ্ঠ হওয়ার মাস। এজন্য দলবদ্ধভাবে রমজানের চাঁদ দেখা থেকে শুরু করে ঈদ উযাপন পর্যন্ত গোটা মাসকে উৎসব হিসেবে পালন করেন তারা। নতুন চাঁদ দেখা দিলে ফিলিস্তিনি শিশুরা রঙিন বেলুন ও ফানুস নিয়ে আনন্দে মেতে উঠে।
বাহারি ফানুসে বর্ণিল হয় ফিলিস্তিনের আকাশ। সেখানকার অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে আনন্দের রেশ। মানুষ সম্মিলিত কণ্ঠে রমজানের বিভিন্ন সংগীত গায়। উচ্চ আওয়াজে দফ বাজানো হয়। উল্লাস ও উচ্ছ্বাসের মাধ্যমে রমজানকে বরণ করা ফিলিস্তিনের একটি প্রাচীনতম ঐতিহ্য। রমজানে বিশেষ বিশেষ খাবার তৈরি করতে পছন্দ করেন ফিলিস্তিনিরা।
পবিত্র এই মাসে বিশ্ব মুসলিমের মতো ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে ব্যাপক চর্চা করেন ফিলিস্তিনিরা। মসজিদগুলোতে দ্বীনের বিধি-বিধানের পাশাপাশি তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য আলোচিত হয়। প্রতিটি পরিবারের শিশুরা বৃদ্ধদের কাছ থেকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার পরিবারের ত্যাগ ও কোরবানির ইতিহাস শোনে।
ফিলিস্তিনিদের জীবিকা অর্জনের প্রধান মাধ্যম কৃষি। এক হিসাব অনুযায়ী ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ প্রত্যক্ষভাবে এবং ৯০ শতাংশ পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। তাদের প্রধান উৎপাদিত ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য হলো অলিভ। ফিলিস্তিনিদের অধিকাংশ কৃষক বর্গাচাষী। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরায়েলি অবরোধ ও অন্য কাজে কৃষিজমি ব্যবহারের কারণে ফিলিস্তিনিদের আয়ের প্রধান উৎসে ব্যাপক চাপ পড়েছে।
ফিলিস্তিনিদের আয়ের আরেকটি অন্যতম উৎস হলো পর্যটন। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা পূর্ব জেরুজালেম তথা আল-আকসা, পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকা ভ্রমণে আসেন। প্রতিবছর স্থানীয় ও বহির্বিশ্ব থেকে কয়েক লাখ পর্যটক ফিলিস্তিনিদের দর্শনীয় ও আকষর্ণীয় স্থানগুলো ভ্রমণ করেন।
জ্বালানির জন্য ফিলিস্তিনিরা প্রায় পুরোপুরি ইসরায়েলের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ জ্বালানি অন্য কোনো দেশ থেকে আনলেও তা ইসরায়েলের মাধ্যমে আনতে হয়। তবে গাজায় একটি গ্যাসফিল্ড রয়েছে, যা আজও উন্নত করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া গাজা উপত্যকায় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, যা আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল।
ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব কোনো মুদ্রা ব্যবহারের অনুমতি নেই। তাই পশ্চিমতীর ও গাজায় প্রধান মুদ্রা হিসেবে প্রচলিত ইসরায়েলি মুদ্রা শেকেল। তবে সঞ্চয়, বিদেশি ও ব্যয়বহুল পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে জর্ডানি দিনার ও মার্কিন ডলার ব্যবহৃত হয়। অবশ্য সেটা পশ্চিমতীরে সহজতর হলেও অবরোধের কারণে গাজায় মুদ্রা সরবরাহ পর্যাপ্ত নয়।
অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও ফিলিস্তিনিদের শিক্ষার হার অনেক বেশি। যা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত। এক হিসাবে জানা যায়, ফিলিস্তিনি তরুণদের মধ্যে শিক্ষার হার ৯৮ দশমিক ২ শতাংশ। তবে জাতীয়ভাবে শিক্ষার হার ৯১ দশমিক ১ শতাংশ। আবার অন্য একটি হিসাবে বলা হয়, অবরুদ্ধ গাজায় শিক্ষার হার ৯৯ শতাংশ।
ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যেমন শিক্ষার হার বেশি তেমনি প্রযুক্তির ব্যবহার থেকেও তারা পিছিয়ে নেই। ফিলিস্তিনের টেলিযোগাযোগ ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ৯৭ শতাংশ ফিলিস্তিনির ঘরে অন্তত একটি সেল ফোন রয়েছে। আর ৮৬ শতাংশ পরিবারে স্মার্টফোন রয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমতীরে ৯১ শতাংশ এবং গাজায় ৭৮ শতাংশ পরিবারে স্মার্টফোন রয়েছে। এছাড়া ৮০ শতাংশ পরিবারে রয়েছে ইন্টারনেট সংযোগ।
ফিলিস্তিনিদের হস্তশিল্পের বেশ সুনাম রয়েছে। শত শত বছর ধরে আজ পর্যন্ত তারা এই শিল্পের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। বিশেষ করে, ফিলিস্তিনি আরবরা এসব হস্তশিল্পের বেশিরভাগ উৎপাদন করে। তাদের উৎপাদিত হস্তশিল্প পণ্যের মধ্যে রয়েছে- এমব্রয়ডারি বা সুচিকর্ম, মার্টির তৈরি জিনিসপত্র, সাবান ও কাঁচ তৈরি, বুনন, অলিভ বা জলপাই কাঠ দিয়ে বিভিন্ন আকৃতি তৈরি এবং মুক্তার আস্তরণ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র ইত্যাদি। পশ্চিমতীরের বেথেলহেম, হেবরন ও নাবলুসের মতো কিছু শহর বিশেষ হস্তশিল্পের জন্য বিখ্যাত এবং এসব শহরের অর্থনীতিও নিয়ন্ত্রণ করে এই হস্তশিল্প।
ফিলিস্তিনিদের আয়ের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী উৎস হলো পাথরকাটিং। এই পেশায় জড়িতদের আয় অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে বেশি। পশ্চিমতীরে সাড়ে ৬০০ পাথরকাটিং আউটলেট বা কারখানা আছে। এসব আউটলেটে গোলাপী, বালি, সোনালী ও হালকা ধূসর রংয়ের ইট ও টাইলস আকারে পাথর কাটা হয়। যা জেরুজালেম পাথর নামে পরিচিত।
ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ফুটবল খুবই জনপ্রিয় খেলা। এতটাই জনপ্রিয় যে, ফিলিস্তিনের জাতীয় ফুটবল টিম আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের নৈপুণ্য প্রদর্শন করে থাকে। এ ছাড়া রাগবিও ফিলিস্তিনিদের জনপ্রিয় একটি খেলা।
ফিলিস্তিনে বেশ কিছু দৈনিক পত্রিকা, সংবাদ সংস্থা ও স্যাটেলাইট টেলিভিশন রয়েছে। এর মধ্যে বার্তা সংস্থা মা’ন, ওয়াফা, প্যালেস্টেনিয়ান নিউজ নেটওয়ার্ক এবং আল-আকসা টিভি, আল-কুদস টিভি ও সানাবেল টিভি বেশি জনপ্রিয়।
ফিলিস্তিনের সংস্কৃতি এতটাই সমৃদ্ধ যে, সেখানকার তিনটি স্থান অর্থাৎ বেথেলহেম, দ্য ওল্ড সিটি ও এর দেয়াল এবং পূর্ব জেরুজালেম ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত।
২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪৯ লাখ। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই মুসলিম। এ ছাড়া খ্রিস্টান ৬ শতাংশ এবং দ্রুজ ও সামারিটানস রয়েছে ১ শতাংশ।
ফিলিস্তিনিদের ঐতিহ্যবাহী আরবি গান আত্তাবা বেশ জনপ্রিয়। বিয়ে, পার্টি ও বিভিন্ন উৎসবে এই গান পরিবেশন করা হয়। মূলত বেদুঈন সংস্কৃতির এই গান গোটা আরব অঞ্চলেই প্রচলিত। এ ছাড়া ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অ্যারাবিক ড্যান্স ডাবকি বেশ জনপ্রিয়।
সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটি বিস্তৃত জনপদ ফিলিস্তিন। ফলে এর রন্ধনশৈলীর রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। বিশেষত, আরব উমাইয়াদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে এখানে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে এবং পরবর্তীকালে ফার্সি-প্রভাবে প্রভাবিত আব্বাসীয়দের এবং তুর্কি রন্ধনপ্রণালী দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ফিলিস্তিনি রন্ধনশৈলী। যার সঙ্গে মিল রয়েছে পার্শ্ববর্তী লেবানন, সিরিয়া ও জর্ডানি রন্ধনপ্রণালীর।
ফিলিস্তিনি বেদুঈনদের মধ্যে ভাত, দই জাতীয় খাবার, ভেড়ার মাংস ও খেজুর খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ট্যাবুন নামের খাবারের প্রচলন রয়েছে। যা আটা দিয়ে তৈরি এবং অলিভ ওয়েল দিয়ে সাধারণ কড়াইয়ে ভাজা হয়।
গাজা সাগরের তীরবর্তী হওয়ায় ব্যাপক মাছ উৎপাদন হয়। ফলে সেখানে মাছ খাওয়ার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। গাজাবাসীর খাবারে মিশরীয় সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব লক্ষনীয়। গাজার স্থানীয় একটি জনপ্রিয় খাবার হলো সুমাঘিয়েহ। এ ছাড়া ফিলিস্তিনিদের মধ্যে কিব্বি, মুসাখান, মাকলুবা, মানসাফ, কিনাফি নাবলুসি, নাবলুসি চিজ, এন্ট্রিস ইত্যাদি খাবার জনপ্রিয়। এর বাইরে চা-কফির প্রচলন তো আছেই।
ফিলিস্তিনিদের প্রধান ভাষা আরবি। এছাড়া অনেকে ইংরেজি এবং খুব অল্প সংখ্যক হিব্রু ভাষা ব্যবহার করে। ফিলিস্তিনিরা খুবই অতিথিপরায়ন ও বন্ধুসুলভ। খুব সহজেই তারা অন্যদের বিশ্বাস করে এবং আপন করে নেয়।
অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় ফিলিস্তিনি নারীরা অনেকটা স্বাধীন। রাস্তাঘাটে স্বাধীনভাবে চলাফেরার পাশাপাশি তাদের চাকরি করারও সুযোগ আছে। এমনকি তারা অনেক ক্রীড়াকর্মেও অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। প্রয়াত ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত ১৯৭০-এর দশক থেকেই নারীদের শিক্ষিত এবং প্রগতিবাদী হওয়ার ব্যবস্থা করেন। ফিলিস্তিনে বোরকা পরা বাধ্যতামূলক না হলেও সেখানকার নারীরা কর্মক্ষেত্রে প্যান্ট-শার্ট ও মাথায় হিজাব পরে থাকেন।