একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়
মাঠ পেরুলেই বন,
পুলের ওপর বাজনা বাজে
ঝন ঝনাঝন ঝন।
কবি শামসুর রাহমানের ছন্দোবদ্ধ এ বর্ণনাই ছিল ট্রেন চলাচলের জীবন্ত ছবি। কিন্তু সময় পাল্টেছে। এখন ট্রেনে বাজনা বাজার ঝন ঝনাঝন শব্দ আমাদের দেশে মাঝেমধ্যে শোনা গেলেও উন্নত বিশ্বের ট্রেন থেকে সেই শব্দ উঠে গেছে। ট্রেনে এমন সর্বাধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে, ট্রেনের কারণে উড়োজাহাজই এখন লোকসানের মুখে।
ইউরোপের কথা বলছি। সেখানে রেললাইনের বিস্তার হয়েছিল বেশ কয়েক দশক আগে। তবে রেলব্যবস্থা অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছিল বিমানের কাছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে গোটা ইউরোপে ট্রেন চললেও যাত্রীরা বিমানে গন্তব্যে পৌঁছাতে বেশি পছন্দ করতেন।
২০০৮ সালে ইউরোপের দেশ ইতালিতে হাইস্পিড ট্রেন চালু হওয়ার পর থেকে চিত্রটা ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে। শুধু ইতালি নয়, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও ইংল্যান্ডেও হাইস্পিড ট্রেনের ছড়াছড়ি। ট্রেনগুলি যেমন উচ্চগতিতে চলে, তেমনই যাত্রী সুরক্ষা, স্বাচ্ছন্দ ও সুযোগ-সুবিধায় অনেকটাই পাল্লা দিতে শুরু করেছে বিমান পরিবহনের সঙ্গে। এর ফলে ২০১৯ সালের মধ্যেই ইতালি-সহ গোটা ইউরোপে প্রধান বাণিজ্যিক রুটে ট্রেনে যাতায়াতকারীর সংখ্যা এক দশকে বেড়েছে প্রায় চারগুণ।
এক দশক আগে, যারা কাজের জন্য রোম থেকে মিলান শহরে যেতেন, তাদের অনেকেই বিমানে চড়তেন। এখন এ সংখ্যা বেশ কম। এ পথে প্রায় সবাই এখন ট্রেনই ধরেন। ট্রেনকে বেছে নেওয়া লোকেদের মধ্যে রয়েছেন ফ্রান্সেসকো গ্যালিয়েতি।
আগে পরিসংখ্যানটা দেখে আসি। ইতালির রাষ্ট্রীয় রেলওয়ে কোম্পানি ফেরোভি ডেলো স্ট্যাটোর ২০১৯ সালের হিসাব বলছে, দেশটির প্রধান বাণিজ্যিক রুট রোম ও মিলানের মধ্যে ট্রেনে যাতায়াতকারীর সংখ্যা এক দশকে বেড়েছে প্রায় চারগুণ। ২০০৮ সালে এ রুটে ট্রেনযাত্রীর সংখ্যা ছিল ১০ লাখ। আর ২০১৮ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৬ লাখে।
দুই শহরের মধ্যে ভ্রমণকারীর দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি এখন ট্রেনে চড়ে। এ প্রবণতা শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে, যখন ইতালির উচ্চগতির ট্রেন যোগাযোগ শুরু হয়।
মিলান এবং রোমের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৪০০ মাইল। ট্রেনে এ পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে ২ ঘণ্টা ৫৯ মিনিট। ট্রেন স্টেশনগুলোর অবস্থান শহরের কেন্দ্রে হওয়ায় স্টেশন ধরার জন্য আপনাকে অনেক দূর পথ হাঁটার প্রয়োজন নেই। বেশিক্ষণ অপেক্ষারও প্রয়োজন নেই। মাত্র দুই মিনিট দরজা বন্ধ থাকে, এরপর যাত্রা শুরু।
অন্যদিকে আপনি যদি বিমানে চড়তে চান, রোমের ফিউমিসিনোতে যেতে লাগবে দেড় ঘণ্টা। বিমান ওড়ার ৯০ মিনিটের মধ্যে চেকিং। আকাশে এক ঘণ্টা। মিলানের বাইরে লিনেট বিমানবন্দরে নামার পর শহরে যেতে প্রায় ২০ মিনিটের গাড়ি। কেন বিমান ছেড়ে মানুষ ট্রেন ধরছে, এর কারণ সহজেই অনুমেয়।
এ কারণেই ইতালির জাতীয় এয়ারলাইন আলিতালিয়া-র কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাহলে কি এ উচ্চগতির ট্রেনই আলিতালিয়া-কে হত্যার জন্য দায়ী? আমরা একটু আগে যে গ্যালিয়েতি-র কথা বলেছি, তা-ই মনে করেন তিনি।
১৫ অক্টোবর থেকে বন্ধ হয়ে যায় ক্যারিয়ারটির সব ধরনের কার্যক্রম। ১৯৪৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু করে সুনামের সঙ্গে যাত্রীসেবা দিয়ে এলেও সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। এ কারণেই নিজেদের গুটিয়ে নেয় আলিতালিয়া। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েন ১২ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী।
অথচ এ এয়ারলাইনে ছিল ৮৪টি সচল উড়োজাহাজ এবং বিশ্বের প্রায় ৯৭টি গন্তব্যে নিয়মিত যাতায়াত করত এটি। ১৯৪৬ সালে যাত্রা শুরুর পর বছরে প্রায় আড়াই কোটি যাত্রী বহন করেছে আলিতালিয়া। ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক থাকলেও ২০১৭ সাল থেকে ক্রমাগত লোকসানের মুখে পড়তে হয় তাদের।
অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়লেও ধীরগতিতে এগিয়ে চলছিল কার্যক্রম। তবে ২০২০ সালে একেবারে অচল হয়ে পড়ে ইতালির পতাকাবাহী কোম্পানিটি।
গ্যালিয়েতি মনে করেন, আলিতালিয়া-র পঙ্গুত্বের প্রধান কারণ উচ্চগতির ট্রেনই। তিনি ব্যাখ্যা করেন, ইতালীয়দের অধিকাংশই ছুটি কাটান নিজ দেশে। ভ্রমণকারীরা দেশের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে চান। তারা মিলানে উড়ে যেতে চান, নেপলস বা রোম যেতে চান। এসব স্থানে সুখকর ভ্রমণের জন্য উড়োজাহাজের বিকল্প ছিল না। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে।
তিনি বললেন, আমাকে যদি মিলান, তুরিন অথবা ভেনিসে যেতে হয়, আমি অনেকের মতো ট্রেনেই যাই। ফ্রেসিয়ারোসা হলো হাইস্পিড ট্রেনগুলোর একটি। এটি এক শহরের কেন্দ্র থেকে অন্য শহরের কেন্দ্রে যাতায়াত করে। শহরতলীর কোথাও নেমে আপনাকে ২০ মাইল অতিক্রম করতে হচ্ছে না। তাই, আলিতালিয়া-র জন্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন ছিল।
সব পর্যটকের অনুভব একই রকম। যুক্তরাজ্য থেকে বেশ ঘনঘন ইতালিতে আসেন ক্রিস্টিনা টেলর। তিনি মনে করেন, বিমান যাতায়াতের চেয়ে ট্রেনই সহজ। বললেন, শহরের কেন্দ্রে আসবেন, শহরের কেন্দ্রে নামবেন। এয়ারপোর্টে চেকইনের প্রয়োজন নেই। এয়ারপোর্ট থেকে শহরে যাতায়াতের প্রয়োজন নেই। গত কয়েক বছর ধরে ট্রেনগুলোর পরিসরও উন্নত হয়েছে। আন্তর্জাতিক যাত্রীরা তাদের মালপত্র রাখার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা পাচ্ছেন। একগাদা টাকা গুনতে হচ্ছে না। তিনি সোজাসাপ্টা বললেন, আপনার সময় বাঁচছে, সঙ্গে টাকাও।
বিমান ব্যবসাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া উচ্চ-গতির রেলগুলো সাধারণত ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার গতিতে চলে। অবশ্য পুরোনো রেললাইনে প্রতি ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার গতিতে চললে এগুলোকেও উচ্চগতির রেল হিসেবে গণ্য করা হয়।
১৯৬৪ সালে প্রথম উচ্চগতির রেল জাপানে চলাচল শুরু করে। এর গতিবেগ বর্তমানে ঘণ্টায় ৩২০ কিলোমিটার। অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, সুইডেন, তাইওয়ান, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, উজবেকিস্তান-সহ বহু দেশ প্রধান শহরগুলির মধ্যে সংযোগ তৈরি করতে উচ্চগতির রেল চলছে। ইউরোপে উচ্চগতির রেল আন্তর্জাতিক সীমান্তও অতিক্রম করে। প্যারিস থেকে ব্রাসেলস হয়ে আমস্টারডাম পর্যন্ত ‘থ্যালিস’ নামের ট্রেনটি ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার গতিতে চলে। লন্ডন-প্যারিস বা প্যারিস-ব্রাসেলস ‘ইউরোস্টার’ ট্রেনের গতি ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার।
চীনে ২৭ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ উচ্চগতির রেলপথ রয়েছে, যা বিশ্বের মোট উচ্চগতির রেলপথের দুই-তৃতীয়াংশ। ২০২৫ সালে এ নেটওয়ার্ক ২৮ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত হবে বলে জানিয়েছে দেশটি। ২০২০ সালের শুরুর দিকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত চালকবিহীন বুলেট ট্রেন চালু করে চীন। ট্রেনটি রাজধানী বেইজিংয়ের সঙ্গে ঝাংজিয়াকাউ শহরকে সংযুক্ত করবে। এ ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩৫০ কিলোমিটার। ফলে বিশ্বে চলমান চালকবিহীন ট্রেনগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে দ্রুতগতির।
আমাদের প্রতিবেশী ভারতেও শুরু হতে যাচ্ছে বুলেট ট্রেন চলাচল। গুজরাটের আহমেদাবাদ থেকে মহারাষ্ট্রের মুম্বাই পর্যন্ত বুলেট ট্রেন চালু করতে ২০২০ সালের শেষদিকে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে ভারত। প্রকল্পটির গুজরাট অংশের ৩২৫ কিলোমিটার নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জাপানি প্রতিষ্ঠান লারসেন অ্যান্ড টার্বোকে। প্রকল্পের এ অংশ নির্মাণে ব্যয় হবে ২৫ হাজার কোটি রুপি। প্রথম বুলেট ট্রেন প্রকল্প শেষ হওয়ার পর এ ধরনের আরও সাতটি রুটে ট্রেন করিডোর তৈরি করার চিন্তা রয়েছে ভারত সরকারের।
বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। সরকার বলছে, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত চলবে বুলেট ট্রেন। এজন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং বিশদ ডিজাইন তৈরি হয়েছে। এ পথে মাত্র ১ ঘণ্টায় যাত্রীরা চলাচল করতে পারবেন। এ রেলপথের সঙ্গে ইউরোপের আদলে ৬টি রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হবে। সমীক্ষা অনুযায়ী ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ২২৭ কিলোমিটার উড়াল রেলপথ নির্মাণ করা হবে। পথের পুরোটাই হবে স্বয়ংক্রিয় সিগনাল ব্যবস্থাসম্পন্ন। ট্রেনের গতি হবে ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার। বুলেট ট্রেন প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় এক লাখ হাজার কোটি টাকা। এ প্রকল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীনের দুই প্রতিষ্ঠান। প্রস্তাব অনুযায়ী, চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন করপোরেশন ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন যৌথভাবে একটি কোম্পানি গঠন করে রেলপথ নির্মাণ করবে। এজন্য প্রয়োজনীয় ঋণের সংস্থান ও রেলপথটি নির্মাণের দায়িত্ব নেবে প্রস্তাবিত কোম্পানি। ঋণ পরিশোধ করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। পাঁচ বছর রেলপথটি পরিচালনার পর তা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করা হবে।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশই ঝুঁকছে উচ্চগতির রেলের দিকে। নতুন আসে, পুরাতন হারিয়ে যায়। এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে কবি শামসুর রহমানের ঝন ঝনাঝন শব্দের ট্রেনগুলো। শুধু পুরনো ট্রেন কেন, ইতালির মতো অনেক স্থানে ঝুঁকির মুখে পড়েছে উড়োজাহাজ ব্যবসাও। যেখানে অর্থ সাশ্রয় হবে, সময় বাঁচবে, সেই পথে তো মানুষ হাঁটবেই।