পাক-ভারত পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি


  • মারুফ চৌধুরী
  • ১০ নভেম্বর ২০২১, ১৭:০৬

উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তান। সম্পর্কের ধরন সাপে-নেউলে। বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মধ্যে উত্তেজনার বিষয়টি নতুন নয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ভারত-পাকিস্তান একাধিকবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। উভয় দেশই পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। আর এশিয়ার জন্য বিপদের বার্তাও সেটাই। কোনো কারণে কেউ মেজাজ হারালেই ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে পুরো এশিয়াকে।

যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক এক গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, পাক-ভারত পরমাণু যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে সাড়ে ১২ কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। ২০২৫ সাল নাগাদ এমন ঘটনা ঘটতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে সেই গবেষণায়। যদিও সালটি নির্দিষ্ট নয়, বরং ভবিষ্যতের যে কোনো একটি বছর বোঝাতে রূপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই গবেষণার বরাত দিয়ে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, এই যুদ্ধের ফলে জলবায়ুর ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে তাতে ১২ কোটির বাইরেও কোটি কোটি মানুষ মারা যাবে অনাহারে। যুদ্ধ কীভাবে শুরু হতে পারে, তার কিছু কাল্পনিক দৃশ্যও বর্ণনা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

হতে পারে কোনো সন্ত্রাসী ভারতীয় পার্লামেন্টে বোমা হামলা চালাবে অথবা কাশ্মীরে কঠিন আক্রমণ শুরু করবে ভারত। এখান থেকে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে এবং পারমাণবিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে দুই দেশ।

পানির কারণেও এই যুদ্ধ বেধে যেতে পারে বলে মনে করেন সাবেক ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ব্যানার্জি। তিনি বলেন, ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল তাতে দুটো দেশের কেউই খুশি নয়। যখন উভয় পক্ষ সমান অখুশি তখন যে কারও পানির প্রয়োজন বেড়ে গেলেই প্রতিপক্ষ বেশি নাখোশ হবে। তখন যুদ্ধের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। আবার সন্ত্রাসবাদের মতো কিছু ইস্যুও যুদ্ধের কারণ হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। যেমন ২০০৮ সালে পাকিস্তান থেকে সন্ত্রাসীরা এসে মুম্বাইয়ে আক্রমণ করেছিল।

রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. অ্যালান রোবোক বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমন কিছু হয় না বা হবেও না হয়ত। নেতারা ঠান্ডা মাথায় পরমাণু যুদ্ধকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন। কিন্তু কখনো কখনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরেও তো চলে যেতে পারে! কারণ, ভারত ও পাকিস্তান তাদের পরমাণু অস্ত্রভান্ডর বাড়িয়ে চলেছে। শুধু সংখ্যার বিচারেই নয়, এসব অস্ত্রের বিস্ফোরণের শক্তিও তারা ক্রমাগত বৃদ্ধি করছে। গবেষণার সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন পাকিস্তানের কায়দে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরমাণু বিজ্ঞানী ড. পারভেজ হুডভাই। তিনি বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধের সম্ভাবনা সবসময়ই আছে। কোন পরিকল্পনা থেকে নয়, বরং দুর্ঘটনাবশতই এ রকম যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে।

১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান আণবিক বোমা পরীক্ষা চালিয়েছে। এরপর এক যুগ অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে কারগিল যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু কখনোই আণবিক বোমা ব্যবহারের কথা উঠেনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দুদেশের মধ্যেই এই বিষয়ে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে ভারতের নীতি হচ্ছে, তারা এই অস্ত্র আগে ব্যবহার করবে না। তবে এখন তারা এই নীতি পুনর্বিবেচনার কথা বলছে। আর পাকিস্তান সবসময় বলেছে, এরকম অঙ্গীকার করতে তারা রাজি নয়। ফলে আশঙ্কার দিকটা রয়েই গেছে।

গবেষক অ্যালান রোবোক বলেন, শুধু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নয়, ভারত ও চীনের মধ্যেও পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যেও এমন যুদ্ধ হওয়ার অনেক উপলক্ষ আছে। তবে আমরা ভারত ও পাকিস্তানকে বেছে নিয়েছি, কারণ কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে এ-দুটো দেশের মধ্যে অব্যাহত বিরোধ চলছেই। সামরিক যুদ্ধে জড়ানোর অতীত ইতিহাসও তাদের রয়েছে।

বর্তমানে সামরিক শক্তিতেও বেশ এগিয়েছে দুই দেশ। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে সামরিক শক্তিতে ভারতের অবস্থান চার। অন্যদিকে ১৫ থেকে এক লাফে সেরা দশে চলে এসেছে মুসলিবিশ্বের একমাত্র পারমাণবিক শক্তির অধিকারী পাকিস্তান। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান এক নম্বরে। আর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে তুরস্ক।

ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট চলতি অর্থবছরে ৬৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পাকিস্তান সামরিক খাতে বরাদ্দ করেছে ৭ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। তবে সামিরক বিশ্লেকরা বলছেন, পাকিস্তানের প্রকৃত সামরিক বাজেট এর চেয়ে অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রশ্নের মুখে না পড়তে পাকিস্তান কিছু খরচ সামরিক বাজেটের সঙ্গে যুক্ত করেনি।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তথ্য মতে, পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর মোট জনবল ১২ লাখ চার হাজার। এর মধ্যে সক্রিয় সদস্য ৬ লাখ ৫৪ হাজার, আর রিজার্ভ সদস্য আছে সাড়ে ৫ লাখ। এর বাইরেও রয়েছে ৫ লাখ সদস্যের একটি আধা সামরিক বাহিনী। ভারতীয় আর্মির মোট সৈন্য সংখ্যা ৫১ লাখ ২৭ হাজার। এর মধ্যে সক্রিয় সেনা সংখ্যা ১৪ লাখ ৪৫ হাজার। রিজার্ভ সেনা ১১ লাখ ৫৫ হাজার। প্যারামিলিটারি ২৫ লাখ ২৭ হাজার।

পাকিস্তানের স্থল বাহিনীর যুদ্ধ সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে ২ হাজার ৬৮০টি ট্যাংক, ৯ হাজার ৬৩৫টি সাজোয়া যান, ৪২৯টি সেল্ফ প্রোপেল্ড আর্টিলারি, টাউড আর্টিলারি ১ হাজার ৬৯০টি। রকেট প্রজেক্টর রয়েছে ৩৩০টি।

ভারতে ট্যাঙ্ক রয়েছে ৪ হাজার ৭৩০টি, সাজোয়া যান ১০ হাজার, সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি ১০০টি, টাউড আর্টিলারি ৪ হাজার ৪০টি এবং রকেট প্রজেক্টর ৩৭৪টি।

পাকিস্তান বিমান বাহিনীর মোট এয়ারক্রাফট সংখ্যা ১ হাজার ৩৬৪। এর মধ্যে ফাইটার ৩৫৭টি, স্পেশাল মিশন এয়ারক্রাফট ২৪টি, প্রশিক্ষণ বিমান ৫১০টি এবং অ্যাটাক হেলিকপ্টার ৫৩টি। বিভিন্ন সংস্করণের ১৬৫টি এফ-সিক্সটিন ফাইটার সক্রিয় আছে পাকিস্তানের বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতে।

ভারতের বিমান বাহিনীর মোট বিমানের সংখ্যা ২ হাজার ১১৯টি। এর মধ্যে ফাইটার জেট ৫৪২টি। ডেডিকেটেড অ্যাটাক ১৩০টি। সামরিক পরিবহন বিমান ২৫১টি। প্রশিক্ষণ বিমান ৩৪৫টি। স্পেশাল মিশন ৭০টি। ট্যাঙ্কার ফ্লিট ৬টি। ৭৭৫টি হেলিকপ্টারের মধ্যে অ্যাটাক হেলিকপ্টার ৩৭টি।

ভারতের নৌবাহিনীর কাছে মোট যুদ্ধযান রয়েছে ২৯৫টি, আর পাকিস্তানের আছে ১৯৭টি। ভারতের কাছে ১৬টি সাবমেরিন থাকলেও পাকিস্তানের আছে ৮টি। ফ্রিগেট রয়েছে ভারতের ১৪টি, আর পাকিস্তানের ১০টি। ভারতের ১১টি ডেস্ট্রয়ার ও ২২টি কর্ভেটও রয়েছে। ভারতের প্যাট্রোল নৌযান রয়েছে ১৩৯টি, আর পাকিস্তানের আছে ১১টি। মাইন যুদ্ধজাহাজ রয়েছে ভারতের ৪টি, পাকিস্তানের ৩টি। এসব হিসেবে ভারত এগিয়ে থাকলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পারমাণবিক শক্তির দিক দিয়ে পাকিস্তান এগিয়ে।

সাম্প্রতিক হিসেবে পাকিস্তানের ১৬৫টি আর ভারতের কাছে ১৫৬টি পারমাণবিক বোমা আছে। যদিও এই তথ্য অত্যন্ত গোপনীয় তারপরেও ধারণা করা হয় যে পাকিস্তানের কাছে দশ বা বিশটি বোমা বেশিই রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা বলছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান ৪০০ থেকে ৫০০ পারমাণবিক অস্ত্র মজুত করে ফেলবে। ভারতের এখন পারমাণবিক ডুবোজাহাজও রয়েছে। পাকিস্তানও এ রকম ডুবোজাহাজ নির্মাণ করছে।

অ্যালান রোবোক বলেন, পারমাণবিক অস্ত্র যেহেতু আছে, পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কাও আছে। ইতোমধ্যেই এরকম একটি যুদ্ধ হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমায় পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল, যা থেকে আমরা ভবিষ্যতেও এরকম যুদ্ধের আশঙ্কা করতে পারি। আমরা যদি এগুলো ব্যবহার না করি, তাহলে এসব ধ্বংস করে ফেলা উচিত।

২০১৭ সালে জাতিসংঘে পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার রোধে একটি চুক্তি সই হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত ৩২টি দেশ এই চুক্তি অনুমোদন করেছে। ৫০টি দেশ অনুমোদন করলেই এটি কার্যকর হবে। তাই এখন বাকি বিশ্বের এগিয়ে আসা উচিত।

জলবায়ু বিজ্ঞানী রোবোক বলেন, পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলে আগুন লেগে যাবে, সেই আগুন থেকে যে পরিমাণ ধোঁয়া তৈরি হবে সেটা ছড়িয়ে পড়বে সারা পৃথিবীতে। এই ধোঁয়ার কারণে আমাদের এই গ্রহে সূর্যের আলোও ঠিক মতো এসে পৌঁছাতে পারবে না। ফলে পৃথিবী অনেক ঠান্ডা আর অন্ধকারময় হয়ে পড়বে। ধোঁয়া যখন পৃথিবীর আরও উপরের আবহমন্ডলে চলে যাবে তখন সেটা সূর্যের আলোতে উত্তপ্ত হয়ে আরও বেশি ছড়িয়ে পড়বে যা সেখানে স্থায়ী হবে কয়েক বছর। বৃষ্টিপাত কমে যাবে। তেজস্ক্রিয়তার ঘটনা ঘটবে। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে খাদ্য উৎপাদনের ওপর। ফলে যুদ্ধের পরেও অনাহারে মানুষের মৃত্যু হবে।

এসব কিছু বিবেচনায় নিলে মনে হয় না যে, ভারত ও পাকিস্তান আদৌ এই ধরনের যুদ্ধে জড়াবে। কিন্তু দুই ​দেশেরই নিরাপত্তা বিশ্লেষকরদের শেষ কথা, পারমাণবিক যুদ্ধ যে কখনোই ঘটবে না, তার গ্যারান্টি নেই।