রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার জন্য প্রকাশ্য তৎপরতার পাশাপাশি অনেক গোপন কর্মকাণ্ডও চালায় ইসরায়েল। গুপ্তহত্যা, সাইবার হামলা, স্যাবোটাজসহ অনেক ধরনের অপতৎপরতা রয়েছে দেশটির। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে গুপ্তহত্যা করেছে ইসরায়েল। বিজ্ঞানী, সেনা কমান্ডার, রাজনীতিক থেকে শুরু করে এই তালিকা অনেক লম্বা। ইসরায়েলের এসব ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে দেশটির দুর্ধর্ষ গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ। মুসলিম বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাদের গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। মোসাদ কাউকে টার্গেট করলে তাকে হত্যার জন্য কোনো পদ্ধতি অবলম্বন বাকি রাখে না। আল জাজিরার প্রতিবেদনের আলোকে মোসাদের গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কৌশলের নানা দিক তুলে ধরা হলো।
২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর ইরানের প্রধান পারমাণবিক বিজ্ঞানী মহসিন ফাখরেজাদেকে তেহরানের রাস্তায় হত্যা করে মোসাদ। তেহরানের কাছে এক সড়কে চলন্ত গাড়িতেই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয় দূর নিয়ন্ত্রিত রিমোট কন্ট্রোল রাইফেল দিয়ে। রাস্তার পাশে একটি পিকআপ ভ্যানের ওপর সেট করা ছিল অত্যাধুনিক সেই রাইফেল। আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল বিজ্ঞানীর গাড়ি বাক নেওয়ার সময় গতি কমালেই যাতে তাকে টার্গেট করা যায়। পরিকল্পনা মতোই হামলা হয় এবং ইরান হারায় তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন।
ইরানের মতো একটি দেশের ভেতর ঢুকে সেই দেশের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীকে হত্যা করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু মোসাদ সেই কাজটিই অত্যন্ত নিখুঁতভাবেই করতে পেরেছে। এমন ঘটনা মোসাদ আগেও অনেকবার ঘটিয়েছে। এমনকি ইউরোপের উন্নত দেশেও প্রকাশ্যে দিবালোকে তারা টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে হত্যা করেছে বিনা বাধায়। যে কারণে গুপ্তহত্যায় মোসাদ বিশ্বে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ সংগঠন বলে মনে করা হয়। তাইতো ইসরায়েল কাউকে টার্গেট করলে তাকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয় মোসাদকে।
ইসরায়েলি গোয়েন্দারা যখন কাউকে হত্যার জন্য টার্গেট করে তখন বিষয়টি মোসাদের অভ্যন্তরীণ বেশ কয়েকটি সংস্থার হাত ঘুরে চূড়ান্ত পরিকল্পনার দিকে অগ্রসর হয়। এছাড়া ইসরায়েলের অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকদেরও সংশ্লিষ্টতা থাকে এ বিষয়ে। মোসাদ সাধারণত বৈদিশিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে। তাই কখনো কখনো ইসরায়েলের সেনাবাহিনী কিংবা অন্য কোনো সংস্থা কোনো বিদেশি নাগরিককে টার্গেট করলে সেটিও বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে মোসাদের ওপর। মোসাদ তা পালন করে দক্ষতার সাথে।
২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে হামাসের বিজ্ঞানী ফাদি আল বাতসকে মালয়েশিয়ায় হত্যা করে মোসাদের আততায়ীরা। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দাদের যেসব ইউনিট হামাসের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করে তাদের সংগৃহীত সমন্বিত তথ্যের ভিত্তিকে আল বাতসকে টার্গেট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া ইসরায়েলের অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা ও সারা বিশ্বে কাজ করা তাদের গুপ্তচরদের কাছ থেকেও তথ্য নেওয়া হয়েছে হামাসের এই উদীয়মান বিজ্ঞানীর বিষয়ে। আল জাজিরার অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনেক দিন ধরে গাজা, ইস্তাম্বুল ও বৈরুতের মধ্যকার যোগাযোগে আড়ি পেতেছে ইসরায়েলের গোয়েন্দারা। এসব যোগাযোগ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেও বিজ্ঞানী বাতসকে টার্গেট করা হয়ে থাকতে পারে।
কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার পর মোসাদ তার অবস্থা-অবস্থান ও গুরুত্ব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় তাকে হত্যা করা হবে কিনা। এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে হত্যা করলে ইসরায়েলের কী লাভ হবে সেই বিষয়টি প্রাধান্য পায়। এরপর তারা খোঁজে হত্যার সেরা উপায় কোনটি হবে? অনেকগুলো বিকল্প থেকে সেরা ও নিখুঁত পদ্ধতিটি বেছে নেওয়া হয়। কখনো বা একাধিক উপায়ে হামলার ছক কষা হয়।
মোসাদ কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ফাইলটির কাজ শেষ করে আনার পর তাতে ইসরায়েলের ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস কমিটির মতামত চাওয়া হয়। এই কমিটিতে থাকেন ইসরায়েলের সব গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরা। হিব্রু ভাষায় যেটি ভারাশ নামের পরিচিত। এই সংস্থাটি ওই ফাইল পর্যালোচনা করে অপারেশনের বিষয়ে নিজেদের মতামত ও পরামর্শ দেয়। তবে কোনো হত্যার অনুমতি দেওয়ার অধিকার নেই এই কমিটির। শুধুমাত্র ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এসব অপারেশনের চূড়ান্ত অনুমতি দিতে পারেন।
ইসরায়েলের খ্যাতিমান অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোনেন বার্গম্যান জানিয়েছেন, সাধারণত রাজনৈতিক কারণে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীরা এ ধরনের সিদ্ধান্ত একা নিতে চান না। যে কারণে তারা সিদ্ধান্ত নিতে বিষয়টির সাথে দু’একজন মন্ত্রীকে যুক্ত করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এই প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে থাকেন।
অনুমোদন হওয়ার পর ফাইলটি আবার চলে যায় মোসাদের হাতে। তারা পরিকল্পনা শুরু করে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর। এতে কখনো সপ্তাহ, মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত চলে যায়। তবে সময় যতই লাগুক, কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মোসাদ তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে।
মোসাদের একটি বিশেষ ইউনিটের নাম কায়সারিয়া। সাধারণত আরব বিশ্বে গুপ্তচর ও এজেন্ট তৈরি এবং তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করাই এই ইউনিটের কাজ। ১৯৭০ এর দশকে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইসরায়েলের নামকরা গুপ্তচর মাইক হারিরি এই ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। কায়সারিয়া ইউনিট মোসাদের টার্গেটকৃত ব্যক্তির ওপর কঠোর নজরদারি করে। তার গতিবিধি কঠোরভাবে বিশ্লেষণ করা হয় এবং এরপরই হামলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এছাড়া ভবিষ্যতে টার্গেট হতে পারে এমন ব্যক্তিদের ওপরও নজরদারি করে এই ইউনিট।
প্রতিবেশী অনেক দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সাথে সহযোগিতার সম্পর্কও রয়েছে মোসাদের। বিশেষ করে জর্দান ও মরোক্কোর সাথে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সহযোগিতার কথা সবার জানা। কিছু দেশের সাথে গোপন সম্পর্কও রয়েছে সংস্থাটির। এসব দেশের গোয়েন্দাদের কাছ থেকেও সহযোগিতা নেওয়া হয়।
কায়সারিয়া ইউনিটের আরেকটি সাব-ইউনিট রয়েছে কিডন নামে। হিব্রু কিডন শব্দের মানে হচ্ছে বেয়নেট। এই গ্রুপটি মোসাদের সবচেয়ে দুর্ধষ কর্মীদের নিয়ে গড়া। এই গ্রুপের সদস্যরা সবাই পেশাদার খুনি, যারা গুপ্তহত্যা ও ধ্বংসাত্মক কাজে দক্ষ। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী, স্পেশাল ফোর্স কিংবা অন্যান্য বাহিনী থেকে বাছাই করা সদস্যদের নেওয়া হয় কিডন গ্রুপে। মালয়েশিয়ায় এই গ্রুপের সদস্যরাই হামাসের বিজ্ঞানী আল বাতসকে হত্যা করেছে বলে মনে করা হয়।
মোসাদের কায়সারিয়া ইউনিট অনেকটা সিআইএ’র স্পেশাল অ্যাক্টিভিটিস সেন্টার বা এসএসি’র অনুকরণে তৈরি। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স অথরিটি বা সিআইয়ে এই ইউনিটের মাধ্যমে গুপ্তহত্যা চালায়। সিআইয়ের এই ইউনিটের ভেতর রয়েছে স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ নামে একটি সাবইউনিট। যেটিও দুর্ধর্ষ খুনিদের নিয়ে গড়া। মোসাদের কিডন গ্রুপটি সিআইয়ের স্পেশাল অপারেশন গ্রুপের আদালেই গড়ে তোলা হয়েছে। তবে সিআইয়ের সাথে মোসাদের গুপ্তহত্যায় অনুমোদন প্রক্রিয়ার কিছু পার্থক্য রয়েছে।
সিআইয়ের কোনো অপারেশনের অনুমোদন দিতে মার্কিন সরকারকে বেশ কয়েকটি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। গুপ্তহত্যা মিশনে সিআইয়ের অফিস অব জেনারেল কাউন্সিল, আইন মন্ত্রণালয় ও হোয়াইট হাউজের লিগ্যাল কাউন্সিলের অনুমোদন নিতে হয়। প্রেসিডেন্টের দফতর এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে সিদ্ধান্ত দেয়, যা মূলত সিআইয়ের জন্য আইনি বৈধতা হিসেবে কাজ করে। এছাড়া বিচার মন্ত্রণালয় ও হোয়াইট হাউজের আইনজীবীরাও বিষয়টির সাথে জড়িত থাকেন। সব কিছুর চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই হওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডন্ট ফাইলে স্বাক্ষর করে গুপ্তহত্যার অনুমতি দিয়ে থাকেন।
এক হিসেবে বলা হয়েছে, বারাক ওবামা প্রেেিসডন্ট থাকা অবস্থা ৩৫৩টি টার্গেট কিলিংয়ের অনুমোদন দিয়েছেন। তার পূর্বসূরী জর্জ ডব্লিউ বুশ এ ধরনের ৪৮টি হত্যাকাণ্ডের অনুমোদন দিয়েছেন। সিআইয়ের টার্গেট কিলিংয়ের বেশির ভাগই হয় ড্রোন হামলার মাধ্যমে। যেমন ইরানের সেনা কমান্ডার কাশেম সোলাইমানি হত্যাকাণ্ড একটি। অন্যদিকে ইসরায়েল হামলা করে সুর্দিষ্টি উপায়ে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরাসরি আততায়ী পাঠিয়ে।
আইনগত দিক থেকে ইসরায়েলের গুপ্তহত্যার ফাইল অনুমোদন প্রক্রিয়া য্ক্তুরাষ্ট্রের চেয়ে সহজ ও কম সময় সাপেক্ষ। আবার যুক্তরাষ্ট্র কাউকে হত্যার আগে যতটা যাচাই-বাছাই করে, ইসরায়েল সে তুলনায় অনেক বেশি আগ্রাসী। মোসাদের হত্যাকাণ্ডে কোনো আইনি যাচাই-বাছাই হয় না, সরাসরি প্রশাসনিক ও সামরিক কর্মকর্তারা অনুমোদন দিয়ে থাকেন। সিআইয়ের সাবেক অপারেশন্স অফিসার রবার্ট বায়ের এ প্রসঙ্গে আলজাজিরাকে বলেন, এই বিষয়টি একান্তই ইসরায়েলের জাতীয় নীতির অংশ।
সাংবাদিক রোনেন বার্গম্যানের তথ্য মতে, ২০০০ সালের দ্বিতীয় ইন্তিফাদার আগ পর্যন্ত ইসরায়েল ৫০০ গুপ্তহত্যার মিশন চালিয়েছে। যাতে নিহত হয়েছে ১ হাজারের বেশি লোক। টার্গেট ছাড়াও আশপাশের অনেক লোক নিহত হয়েছে এসব ঘটনায়। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ইসরায়েলের গোয়েন্দারা ১ হাজারের বেশি অপারেশন চালিয়েছে, যার মধ্যে ১৬৮টি সফল হয়েছে বলে বার্গম্যান তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন। আর দ্বিতীয় ইন্তিফাদার পর থেকে মোসাদ আরো ৮০০টি অপারেশন চালিয়েছে গাজা উপত্যকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে। এসব হামলার বেশিরভাগই হামাসের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের চালানো হয়েছে।