যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় অনেক সমরাস্ত্র রেখে গেছে। আবার আফগান সেনাবাহিনীর জন্যও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অনেক অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল। তালেবান পুরো আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পর এসব অস্ত্রের অনেক কিছুই তাদের দখলে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধবিমান, অ্যাটাক হেলিকপ্টার, ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যানসহ অনেক কিছু। সেগুলো এখন তালেবানের অস্ত্রভান্ডারে যুক্ত হয়েছে। আর এর ফলে রাতারাতি তালেবানের যোদ্ধাদের শক্তিও বেড়ে গেছে অনেকগুণ।
কয়েক দশক ধরে তালেবানের যুদ্ধ ছিল মূলত রাইফেল নির্ভর। বিভিন্ন মডেলের কালাশনিকভ রাইফেল ছিল তাদের যোদ্ধাদের মূল অস্ত্র। এই অস্ত্রের ওপর নির্ভর করেই তারা পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছে। অবশ্য অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সাহস আর অদম্য মানসিকতাই ছিল তালেবানের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। যার কারণে তারা পরাশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতেও পিছপা হয়নি। তালেবানের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ ছিল জিহাদ বা ন্যায়ের পথে লড়াই। যে কারণে মৃত্যু কিংবা অন্য কোনো পরিণতিরই পরোয়া করেনি তারা। এটি তাদের ২০ বছর টিকে থাকতে এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হতে সাহায্য করেছে।
কালাশনিকভ রাইফেল ছাড়াও তালেবান আর যেসব অস্ত্র ব্যবহার করত তার মধ্যে রয়েছে- বিস্ফোরক, স্থল মিসাইল, রকেট লঞ্চার ও অল্প কিছু কামান। গত শতাব্দীর আশির দশকে সোভিয়েত-বিরোধী লড়াইয়ের সময় যুক্তরাষ্ট্র মুজাহেদিনের যেসব অস্ত্র দিয়েছিল তারও কিছু তালেবান যোদ্ধাদের কাছে ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল স্ট্রিঞ্জার মিসাইল। এই অস্ত্রট দিয়েই সোভিয়েত বিমান বাহিনীকে কাবু করেছিল মুজাহিদরা। এছাড়াও সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি আরো কিছু অস্ত্র তালেবানের হাতে ছিল, যেগুলো আফগানিস্তান ত্যাগ করার সময়ে ফেলে গিয়েছিল তারা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর নেভাল অ্যানালাইসিসের কাউন্টারিং থ্রেটস এন্ড চ্যালেঞ্জেস প্রোগ্রামের ডিরেক্টর জনাথন শরডেন মনে করেন, তালেবান যে সব অস্ত্র ব্যবহার করে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি ১২০ মিলিমিটারের চাকাযুক্ত কামান ডি-থার্টি হাউইটজার। তিনি বলেন, তালেবানরা এই অস্ত্রটির ব্যবহার খুব ভালো করেই জানে। যে কারণে স্থলযুদ্ধে তারা এটি ব্যবহার করে অনেক সুবিধা পেয়েছে।
কোনো সমতল জায়গায় তিনটি পায়ের ওপর দাড় করিয়ে এই কামান ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে গোলা ছুড়তে পারে। এর গোলা সংস্করণ ভেদে ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত আঘাত হানতে পারে। যদিও ১৯৬০ এর দশকে তৈরি এই অস্ত্রটি এখন অনেকটাই সেকেলে হয়ে গেছে তবু, তালেবান এর সাহায্যেই যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রসর হয়েছে।
তালেবান এবার যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি কিছু অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে পেয়েছে। এর কিছু মার্কিন বাহিনী ফেলে গেছে, আর কিছু অস্ত্র দেশটিতে আনা হয়েছে আশরাফ গনি সরকারের বাহিনীর জন্য। এসব অস্ত্রের মধ্যে আছে অ্যাটাক হেলিকপ্টার, ছোট বিমান, নাইট ভিশন গগলস, প্রচুর গোলাবারুদ। এছাড়া প্রচুর সামরিক প্রযুক্তি হাতে এসেছে তালেবানের। এছাড়া দানবাকৃতির একটি সি-ওয়ান থার্টি হারকিউলিস সামরিক পরিবহন বিমানও মার্কিন বাহিনী রেখে গেছে আফগানিস্তানে।
মার্কিন বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া তালেবানের উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ব্রাজিলের তৈরি এ-টুয়েন্টি নাইট সুপার টুকানো অ্যাটাক এয়ারক্রাফট। হালকা ধরনের এই যুদ্ধবিমানের দাম সংস্কারণ ভেদে ২০ থেকে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বেশ কয়েক ধরণের অস্ত্র বহন করতে পারে এই বিমান। যুদ্ধক্ষেত্রে স্থল বাহিনীকে ক্লোজ এয়ার সাপোর্ট, দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ, নজরদারি করতে পারে এটি। শত্রুর কামান হামলার মুখে কাজ করতে পারে টুকানো।
আফগানিস্তানের মতো পার্বত্য এলাকায় এই যুদ্ধবিমান বেশ কার্যকরী। যে কারণে এই যুদ্ধে শুরু থেকেই এ ধরণের বিমান ব্যবহার করেছে মার্কিন বাহিনী। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্য মতে, মাজার-ই শরিফ থেকে অন্তত একটি এই মডেলের যুদ্ধবিমান জব্দ করেছে তালেবান। তালেবানের অভিযানের মুখে আফগান সরকারের সৈন্যরা উজবেকিস্তানে পালানোর সময় এই মডেলের অনেকগুলো বিমান নিয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারও হাতে এসেছে তালেবানের। কাবুল বিজয় ও সরকার গঠনের পর সামরিক মহড়ায়ও তারা এই হেলিকপ্টার প্রদর্শন করেছে তারা। এটি একই সাথে সামরিক পরিবহন ও অ্যাটাক হেলিকপ্টার হিসেবে কাজ করে। খুবই অত্যাধুনিক এই হেলিকপ্টারের বাজার মূল প্রায় ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। এতে রয়েছে রেজার ডেজিগনেটেড মিসাইল সিস্টেম।
টার্গেট নির্ধারণের জন্য ব্যবহৃত হয় অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি। দিন-রাত যেকোনো সময় হামলা চালাতে পারে এই হেলিকপ্টার। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াতেও কাজ করতে পারে। অনেক দূর থেকেও এর হামলা হয় নির্ভুল। ১২ আগস্ট তালেবান কান্দাহার বিজয়ের পর ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার জব্দ করে। আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছিল বড় একটি ঘাঁটি।
প্রায় ৬৫ ফুট দীর্ঘ এই হেলিকপ্টারটি ঘণ্টায় ২৯৪ কিলোমিটার গতিতে উড়তে পারে। ২ ইঞ্জিনের হেলিকপ্টারটি ৫৯০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত অভিযান চালাতে পারে। মেশিন গান ছাড়াও হেলফায়ার ও স্ট্রিঞ্জার মিসাইল বহন করতে পারে এই হেলিকপ্টার।
তালেবান ঠিক কতটি ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টার জব্দ করেছে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কোনো কোনো সূত্র সেই সংখ্যা ১৮টি বলে দাবি করেছে, যার মধ্যে ৬টি ব্যবহারযোগ্য। তবে সামরিক বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, তালেবান হয়তো এই হেলিকপ্টার সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবে না। কারণ এতে রাডার, জিপিএস, টার্গেটিংসহ যেসব উন্নত প্রযুক্তি রয়েছে তার যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়া কারো পক্ষে আয়ত্ব করা কঠিন। তবে তালেবানের কাছ থেকে এই হেলিকপ্টারের প্রযুক্তি চীন, রাশিয়া কিংবা ইরানের হাতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি স্ক্যান ঈগল মিনি মিলিটারি ড্রোনও হাতে এসেছে তালেবানের। ছোট আকারের এই ড্রোনটি নজরদারি, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও অনুসন্ধানের কাজে ব্যবহৃত হয়। টানা ২৪ ঘণ্টা আকাশে থেকে এই ড্রোনটি পাখির চোখে নজরদারি চালাতে পারে। এর প্রতিটি ড্রোনের দাম ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বোয়িংয়ের তৈরি এই ড্রোনটি ব্যবহার করতো মার্কিন নৌ সেনারা। এরপর আফগান সেনাবাহিনীকে এই ড্রোন দেয় তারা। ১৯ হাজার ৫০০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় কাজ করতে সক্ষম এই ড্রোন এখন এসেছে তালেবানের হাতে।
যুক্তরাষ্ট্রের এমডি-৫৩০ লাইট অ্যাটাক হেলিকপ্টারও এখন তালেবানের হাতে। উদ্ধার অভিযান কিংবা কাছ থেকে হামলার কাছে ব্যবহৃত হয় এই হেলিকপ্টার। এছাড়া কৌশলগত ও পরিবহনের কাজেও এই হেলিকপ্টার ব্যবহার হয়। এই মডেলের প্রতিটি হেলিকপ্টারের দাম ২৪ লাখ মার্কিন ডলার। অন্যান্য সামরিক আকাশযানের তুলনায় এটি খুব দ্রুত উড্ডয়ন করতে পারে। স্থল বাহিনীকে এয়ার সাপোর্ট দিতে এটি কাছ থেকে শত্রুর অবস্থানের ওপর হামলা করতে পারে এটি। তালেবানে এই মডেলের অন্তত একটি হেলিকপ্টার জব্দ করেছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে।
অনেকগুলো সাঁজোয়া যান জব্দ করেছে তালেবান। তার মধ্যে একটি হচ্ছে এমআরএপি। যেটি স্থল মাইল ও শত্রুর অ্যামবুশ মোকাবেলা করেও এগিয়ে যেতে পারে। এই সামরিক যানটির মূল্য সংস্করণ ভেদে ৫ থেকে ১০ লাখ মার্কিন ডলার। সঙ্ঘাতময় এলাকায় নিরাপদে কোনো কিছু পরিবহনের জন্যও এই যানটি ব্যবহৃত হয়। বোমা কিংবা মাইন বিস্ফোরণ থেকে এর যাত্রীরা সুরক্ষিত থাকবে সব সময়। প্রচণ্ড যুদ্ধপ্রবণ এলাকায় মার্কিন সেনারা অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে এই সামরিক যানটি ব্যবহার করতো। কয়েকশো এমআরপি এখন তালেবানের হাতে বলে জানা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এম ওয়ান ওয়ান ফাইভ ওয়ান হামভি সামরিক যানও এখন তালেবানের হাতে। এর প্রতিটি মূল্য ২ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি। ২০১৭ সালে আফগানিস্তানে ৪ হাজার ৭০০টি হামভি সরবরাহ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর এগুলোর বেশির ভাগই এখন তালেবানের হাতে।
যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ছোট সমরাস্ত্রও এখন তালেবানের হাতে এসেছে। এর মধ্যে একটি হলো এম-টুয়েন্টি ফোর স্নাইপার ওয়েপন সিস্টেম। স্নাইপার রাইফেল ও এর সাথে অন্য কিছু যন্ত্রাংশ আছে এই সিস্টেমে। স্নাইপার রাইফেলের জগতে এম-টুয়েন্টি ফোর খুবই প্রসিদ্ধ। দেখতে সাধারণ মানের হলেও এই রাইফেলের টার্গেটিং অ্যাকুরেসি বিশ^ বিখ্যাত। এর টার্গেটিং রেঞ্জ চার হাজার মিটার। আর তালেবান যেহেতু রাইফেল চালানায় খুবই সিদ্ধহস্ত, তারা দ্রুতই এই রাইফেলের ব্যবহার আয়ত্ব করে নেবে বলে মনে করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া অন্যান্য অস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে এম-এইটিন অ্যাসল্ট রাইফেল। কয়েক হাজার এম-এইটিন রাইফেল এসেছে তালেবানের হাতে। এছাড়া আছে এম-ফোর কারাবাইন। গ্যাস চালিত এই অস্ত্রটি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা ও নৌ বাহিনীর সদস্যরা। এম-ফোর কারবাইনে আছে টেলিস্কোপিং টার্গেটিং সিস্টেম, নাইট ভিশন সিস্টেম ও একটি গ্রেনেড লঞ্চিং সিস্টেম। আফগানিস্তানে কয়েক হাজার কারবাইন রেখে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। যা এখন যুক্ত হয়েছে তালেবানের অস্ত্র ভাণ্ডারে।
এর বাইরেও অসংখ্য গ্রেনেড, বিভিন্ন মডেলের রাইফেল, পিস্তলসহ অনেক ধরণের সামরিক সরঞ্জাম আফগানিস্তানে ফেলে যেতে বাধ্য হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। রাডার সিস্টেম, এয়ার ডিফেন্সসহ অনেক সামরিক প্রযুক্তিও তারা দেশটিতে এনেছিল। যেগুলো এখন সবই তালেবানের হাতে। উন্নত এসব মিলিটারি প্রযুক্তির ব্যবহার তালেবান পুরোপুরি না জানলেও ক্রমশ তারা এসব আয়ত্ত করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।