এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যবর্তী অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্য নামে পরিচিত। এই অঞ্চলে বিশে^র সবচেয়ে প্রভাবশালী তিনটি ধর্ম ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের জন্মস্থান। মধ্যপ্রাচের্য নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্টার জন্য জন্য আদিকাল থেকে বিভিন্ন সাম্রাজ্য প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে আসছে। এমনকি মানুষ সৃষ্টির পর হাবিল আর কাবিলের লড়াই হয়েছে এ অঞ্চলে। যার ধারবাহিকতা এখনও চলছে । মধ্যপ্রাচ্যে ১৭টি দেশ রয়েছে। এসব দেশের ওপর নানা ভাবে প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সামরিক ঘাটি স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা এসব দেশে অবস্থান করছে। গড়ে তুলেছে অনেকগুলো নৌ ও বিমান ঘাটি। আমরা দেখে নেই কোথায় কিভাবে আছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাটি।
বাহরাইন :
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ড রয়েছে বাহরাইনে। যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহরের অবস্থান বাহরাইনে। ৭ হাজারের বেশি মার্কিন সৈন্য এই নৌঘাটিতে অবস্থান করে। ১৯৪৮ সাল থেকে এখানে মার্কিন নৌবাহিনীর অবস্থান রয়েছে এ দেশে। তবে ১৯৭১ সালে দুদেশের মধ্যে প্রথম সামরিক অবস্থান সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯১ সালে দুদেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি করে। বাহরাইনের নৌঘাটি থেকে আরব সাগর, ওমান উপসাগর, লোহিত সাগর, হরমুজ প্রনালী, সুয়েজ খাল এবং বাব আল মানদের প্রনালীর ওপর নজর রাখে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ বাহিনী।
বাহরাইনের শেখ ইসা বিমান ঘাটিও যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করে থাকে। সাড়ে ১২ হাজার ফিট রানওয়েতে এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান থেকে শুরু করে অন্য বিমানগুলো অবতরন করতে পারে। এছাড়া কার্গো পরিবহন ও বড় ধরনের বিমান অবতরনের জন্য মুহারাক বিমান ঘাটি ব্যবহার করে থাকে। এটি বাহরাইন আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দরের অংশ।
জিবুতি
জিবুতি উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সামরিক কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ন বাব এল মানদেব প্রনালীর তীরে, লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত। দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম শহরের নামও জিবুতি। আফ্রিকার জিবুতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সামরিক ঘাটি রয়েছে। যেখানে ৪ হাজারের বেশি সৈন্য রয়েছে। এখান থেকে সোমালিয়া ও নাইজারের মতো দেশগুলোতে অভিযান চালানো হয়। জিবুতিতে ১০ হাজার ফিটের একটি রানওয়ে রয়েছে। জিবুতির ঘাটি থেকে মনুষ্য বিহীন বিমান থেকে ইয়েমেনে অভিযান চালানো হয়। জিবুতিতে সম্প্রতি চীনও নৌঘাটি স্থাপন করেছে। ধারনা করা হয় এখানে চীনের ১ হাজারের মতো সৈন্য রয়েছে।
মিশর
মিশরে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি কোনো ঘাটি নেই। তবে মিশরের সেনাবাহিনীর সাথে যুক্তরাষ্ট্র নিবিড় ভাবে কাজ করে থাকে। বিশেষ করে ১৯৭৯ সালে মিশর-ইসরাইল শান্তি চুক্তির পর এই সহযোগিতামুলক সর্ম্পক জোরদার হয়েছে। কায়রোতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি মেডিকেল রিসার্চ ইউনিট রয়েছে।
ইরাক
মধ্যপ্রাচ্যে সরাসরি মার্কিন সৈন্যরা যুদ্ধে অবতীর্ন হয় ইরাক। ইরাক দখলের সময় দেশটিতে বেশ কয়েকটি ঘাটি স্থান করেছিলো যুক্তরাষ্ট্র। ২০১১ সালে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর সেখানে ঘাটির সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। আল আনবার প্রদেশের আল আসাদ বিমান ঘাটিটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যর ব্যবহার করে থাকে।
ইসরাইল
ইসরাইলের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নিবিড় সামরিক সর্ম্পক রয়েছে। ইসরাইলকে সুরক্ষা দিতে যুক্তরাষ্ট্র আয়রন ডোম প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে। ইসরাইলের হাইফা বন্দরে নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ট নৌবহর যাতায়াত করে থাকে। ইসরাইলের মাসহাবিম বিমান ঘাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ জন সৈন্য সার্বক্ষনিক মিসাইল ডিফেন্স ব্যবস্থা পর্যবেক্ষন করে থাকে।
কুয়েত
ন্যাটো ভুক্ত দেশের বাইরে কুয়েত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ট মিত্রদের একটি। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর দুদেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। কুয়েতে যুক্তরাষ্ট্রের রাডার স্টেশন ছাড়াও সামরিক ও নৌ উপস্থিতি রয়েছে। এর মধ্যে আলি আল সালেম বিমান ঘাটি অন্যতম। এছাড়া রয়েছে তিনটি ক্যাম্প।
ওমান :
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট মিত্রদেশের একটি ওমান। ওমানের নৌ বন্দরের মাধ্যমে পুরো পারস্য উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্র নজরদারি করে থাকে। ১৯৮০ সালে দুদেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আফগানিস্তানে অপরারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম অপরারেশনের সময় ওমানের বিমান ঘাটি ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওমানের মারিশ দ্বীপে ১০ হাজার ফুটের একটি বড় রানওয়ে রয়েছে। যেখানে যুদ্ধ বিমান উঠানামা করতে পারে। মাস্কাট ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে রয়েছে সিব এয়ার বেস। যেখানে যুদ্ধ সামগ্রী মওজুদ রাখা হয়। ওমানের দুকাম নৌবন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ জাহাজ ও সাবমেরিন আসতে পারে। সেগুলো রক্ষনাবেক্ষনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। দুকাম বন্দর শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয় ইরান, যুক্তরাজ্য ও চীনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন বন্দর। এছাড়া ওমানের সবচেয়ে বড় নৌ বন্দর পোর্ট অব সালাহলাহ যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করতে পারে।
কাতার :
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাটি রয়েছে কাতারে। ইরাক যুদ্ধের সময় আল উদেইব বিমান ঘাটি থেকে ইরাকে বিমান হামলা চালানো হয়েছে। কাতারে এই বিমান ঘাটিতে বর্তমানে ১০ হাজারের বেশি মার্কিন সৈন্য রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর এটি সেন্ট্রাল কমান্ড। এই বিমান ঘাটিতে সব ধরনের যুদ্ধ বিমান অবতরন করতে পারে।
এছাড়া ক্যাম্প আল সালাইয়াহ নামে আরেকটি ঘাটি রয়েছে কাতারে। যেখানে যুদ্ধ সরঞ্জাম রক্ষানাবেক্ষন ও সংরক্ষন করা হয়।
সৌদি আরব :
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি নিরাপদ সামরিক ঘাটি সৌদি আরব। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় সৌদি আরব থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহন করে। এখনও সামরিক প্রশিক্ষনের জন্য মার্কিন সৈন্য সৌদি আরবে অবস্থান করছে। রিয়াদের কাছে এসকন ভিলেজ মার্কিন সৈন্যদের অবস্থানের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে মার্কিস সৈন্যদের অবস্থানের জন্য অনেক গুলো ভিলা বা বিলাসবহুল বাড়ি নির্মান করা হয়েছে। সৌদি আরবের ন্যাশনাল গার্ড ও মিলিটারি পুলিশ এখানে প্রশিক্ষন গ্রহন করে থাকে।
তুরস্ক :
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সামরিক জোটের একমাত্র মুসলিম দেশ তুরস্ক। কোল্ড ওয়ারের সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পরীক্ষিত মিত্র হিসাবে পরিচিত তুরস্ক। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলোর সাথে সর্ম্পক অনেকটা শীতল হয়ে পড়ে। এখন রাশিয়ার সাথে তুরস্কের ঘনিষ্টতা বাড়ছে। ১৯৫১ সালে তুরস্কে ইনসারলিক বিমান ঘাটি তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র। এই বিমান ঘাটিতে প্রায় ২৫০০ মার্কিন সৈন্য অবস্থান করছে। ২০১৬ সালে এরদোগানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুন্থানের সময় কয়েকদিন বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছিলো।
তুরস্কের ইজমিরে আরেকটি বিমান ঘাটি রয়েছে। এই ঘাটিটিও যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো দেশগুলো ব্যবহার করে থাকে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত :
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় ৫ হাজার মার্কিন সৈন্য দেশটিতে অবস্থান করে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে নিরাপত্তা চুক্তির অধীনে বিমান ও নৌ বন্দর ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা। আফগানিস্তানের অভিযানের সময় দেশটির বিমান ঘাটি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র। এরমধ্যে আল দাফরা বিমান ঘাটি থেকে এ অঞ্চলের সব নজরদারি বিমান পরিচালনা করা হয়। ২০১৬ সালে এই বিমান ঘাটিতে প্রায় ৩৮০০ মার্কিন সৈন্য অবস্থান করে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের পোর্ট জেবেল আলি গভীর সমুদ্র বন্দরে মার্কিন যুদ্ধ জাহাজ গুলো ভিড়তে পারে। এছাড়া পারস্য উপসাগরে হুরমুজ প্রনালীর উল্টোদিকে ফুজাইরাতে আরেকটি নৌ ঘাটি রয়েছে। যেখানে মার্কিন যুদ্ধ জাহাজ অবস্থান করতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে এ অঞ্চলের সব গুরুত্বপূর্ন স্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও নৌঘাটি রয়েছে। এই অঞ্চল থেকে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিরাট অংশের ওপর সামরিক নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র।