মিশরের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি কারাবন্দী অবস্থায় মারা গেছেন। আদালতে বক্তব্য দেয়ার সময় তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা যান বলে মিশরের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জানানো হয়। মোহাম্মদ মুরসিকে একটি নির্জন সেলে বন্দী রাখা হয় এবং কোনো ধরনের চিকিৎসা সুবিধা দেয়া হয়নি। মিশরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারক ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গনআন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন। ২০১২ সালে জুন মাসে দেশটিতে প্রথম অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন মোহাম্মদ মুরসি। ক্ষমতা গ্রহনের এক বছর পর ২০১৩ সালের জুলাই মাসে সেনা বাহিনীর এক অভ্যুন্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এরপর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহন করেন সেনা প্রধান আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসি। এর মধ্যদিয়ে ফেরাউনের দেশ হিসাবে পরিচিত মিশরের ইতিহাসে গনতন্ত্র প্রতিষ্টার জনআকাঙ্খার মৃত্যু ঘটে। মোহাম্মদ মুরসি আরব বিশ্বের সবচেয়ে পুরানো ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা ছিলেন। তার মৃত্যু আরব বিশ্বের রাজনীতিতে নি:সন্দেহে কম বেশি প্রভাব ফেলবে।
৬৭ বছর বয়সী পাঁচ সন্তানের জনক ড. মুরসির জন্ম মিসরের সারকিয়া প্রদেশে। পিতা ছিলেন একজন কৃষক। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭০ সালে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর যুক্তরাষ্ট্র চলে যান। সেখানে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এরপর সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। কিছু দিন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসায় কাজ করেন। দেশে ফিরে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মোবারক আমলে পার্লামেন্টে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। মোবারক আমলে তাকে জেলেও পাঠানো হয়েছিল। মোবারকবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন মুরসি ছিলেন কারাগারে। ড. মুহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত জাগজিগ ইউনিভার্সিটির শিক্ষকতা করছিলেন।
মোহাম্মদ মুরসি ২০১২ সালে এমন এক রাজনৈতিক দল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, যে দলটি দীর্ঘ সময় নিষিদ্ধ ছিল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে সেনা অভ্যুন্থানের মাধ্যমে তাকে উৎখাত করা হয়। এ সময় তার সমর্থনে হাজার হাজার লোক মিশরের রাস্তায় নেমে আসে। রাবা স্কায়ারে অবস্থান গ্রহন করে। সেনাবাহিনী রক্তাক্ত অভিযানের মাধ্যমে তার সমর্থকদের সরিয়ে দেয়। যেখানে শত শত মানুষ মারা যায়। মোহাম্মদ মুরসি সহ মুসলিম ব্রাদারহুডের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। মোহাম্মদ মুরসির বিরুদ্ধে হত্যাকান্ড, রাষ্ট্রীয় তথ্য পাচার, রাষ্ট্র্রীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকান্ড এমনকি গোয়েন্দা কার্যক্রম চালানোর মত বহু অভিযোগ আনা হয়। এসব মামলায় তার বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়। কারাগারে তাকে একাকি রাখা হয়। স্বজনদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ এবং চিকিৎসা সুবিধাও দেয়া হয়নি। ১৭ জুন মিশরের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলা হয় মোহাম্মদ মুরসি আদালতে হার্টঅ্যাটাক করে মারা গেছেন। মুসলিম ব্রাদারহুড মুরসির মৃত্যুকে রাষ্ট্রীয় হত্যাকান্ড হিসাবে উল্লেখ করেছে।
কারাবন্দী অবস্থায় মোহাম্মদ মুরসির এই মৃত্যু আরব বিশ্বে গনতন্ত্র প্রতিষ্টার সংগ্রাম কতটা নিষ্টুর হতে পারে তার একটি উদহারন হয়ে থাকবে। মুরসির বিজয়ের মধ্যদিয়ে আরব বিশ্বে সবচেয়ে পুরানো রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছিলো। ২০১০ সালে আরব বসন্তের সবচেয়ে বড় অর্জন হিসাবে দেখা হয়েছিলো মিশরের নির্বাচনে মুরসির বিজয়কে। তার মৃত্যু আরব দেশগুলোতে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে আরেক দফা হতাশার সৃষ্টি করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যদিও বিভিন্ন আরব দেশে মুসলিম ব্রাদারহুড তাদের কর্মকৌশল বদলে ফেলেছে। বিশেষ করে তিউনিসিয়া ও মরোক্কোর মতো দেশে। মুসলিম ব্রাদারহুডকে বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থী রাজনীতির মাতৃসংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আরব দেশগুলোতে মুসলিম ব্রাদারহুডের অনেক গুলো শাখা সংগঠন রয়েছে। অনেক আরব দেশে মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতার অংশীদার।
মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানুল মুসলিমিনের জন্ম হয়েছিল ১৯২৮ সালে, যা দ্রুত আরব দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। দলটির প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল বান্না। যিনি ছিলেণ একজন স্কুল শিক্ষক। শুধু রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, জনকল্যাণমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে সমগ্র আরব বিশ্বে তিনি ইখওয়ানকে জনপ্রিয় রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম হন। রাজনৈতিক দলটি জন্মের পর থেকে সব আরব দেশে ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসকদের রোষানলে পড়েছে। কার্যত আরব বিশ্বে ঔপনিবেশিক শাসন-পরবর্তী ইসলামের রাজনৈতিক আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি তিনি তৈরি করে গেছেন।
১৯৪০ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে হাসান আল বান্নার দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অজ্ঞাত পরিচয় এক বন্দুকধারীর গুলিতে হাসান আল বান্না নিহত হন। ধারণা করা হয়, ইখওয়ানের রাজনৈতিক আন্দোলন দমনের অংশ হিসেবে তাকে হত্যা করা হয়। এর পর থেকে মিসরের প্রত্যেক সামরিক শাসকের নিপীড়নের শিকার হয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা। জামাল আবদুল নাসেরের স্বৈরশাসনের অবসানে আনোয়ার সাদাতের ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্টের প্রতি ইখওয়ানের সমর্থন ছিল। কিন্তু আনোয়ার সাদাত ক্ষমতায় আসার পর অল্প কিছু দিন ইখওয়ানকে রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর অনুমতি দেয়া হলেও আবারো দলটি নিষিদ্ধ করা হয়। এর আগে ১৯৫৪ সালে জামাল আবদুল নাসেরের ওপর আক্রমণের অভিযোগ এনে দলটি নিষিদ্ধ করা হয়। হাজার হাজার ইখওয়ান নেতাকর্মীকে জেলে পোরা হয়। ইখওয়ানের শীর্ষস্থানীয় ছয়জন নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়। দীর্ঘ সময় নিষিদ্ধ থাকার পর ১৯৮০ সালে মুসলিম ব্রাদরহুড বা ইখওয়ান আবারো মূলধারায় ফিরে আসে। ওয়াফদ পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে জোটবদ্ধ হয়। ১৯৮১ সালে ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরে বিক্ষুব্ধ সৈনিকের হাতে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত প্রাণ হারানোর পর তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সে সময় দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ক্ষমতাচ্যুতির পূর্বপর্যন্ত ২৯ বছর ধরে মিশরে জারুরি অবস্থা জারি ছিল। আরব বসন্তের মধ্যদিয়ে হোসনি মুবারক ক্ষমতাচ্যুত হলে মিশরের প্রথমবারের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্টিত হয়। এই নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শক্তি ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি সংখ্যাগরিষ্ট আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।
আরব বিশ্বের বৃহৎ এই রাজনৈতিক দলটির ইতিহাস থেকে দেখা যাচ্ছে প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্য থেকে দলটি ঘুরে দাড়িয়েছে। মুরসির মৃত্যু দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি করলেও দলটি নি:শ্বেস হয়ে যাবে তা কোনো ভাবেই বলা যায় না। মোহাম্মদ মুরসি দায়িত্ব গ্রহনের কিছু দিনের মধ্যে সেনাবাহিনীর সাথে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। অপরদিকে আরব দেশগুলো বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইল মুরসি সরকারকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহন করেনি। মুরসি সরকার উৎখাতে সেনা কর্মকর্তাদের সাথে এসব দেশ গোপন যোগাযোগ রক্ষা করে। সংযুক্ত আরব আমিরাত মুরসি সরকারকে উৎখাতে বিলিয়ন ডলার ব্যায় করে। আরব বসন্তের পর রাজতান্ত্রিক এই দেশগুলোতে পরিবর্তনের শঙ্কা ছিলো। প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তিন হাজারের বেশি ব্রাদারহুড নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। বহু নেতাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। আধ্যাত্মিক নেতা মোহাম্মদ বদির বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় দিয়ে কারারুদ্ধ রাখা হয়েছে। দলের শীর্ষ পর্যায়ের সব নেতা এখন কারাগারে রয়েছে। নির্বাসনে রয়েছেন দলটির অনেক নেতা। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে দলটির ১০ লাখেরও বেশি সক্রিয় সদস্য রয়েছে।
মুসলিম ব্রাদারহুডকে বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থী রাজনীতির মাতৃসংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আরব দেশগুলোতে মুসলিম ব্রাদারহুডের অনেক গুলো শাখা সংগঠন রয়েছে। অনেক আরব দেশে মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতার অংশীদার। জর্ডানে মুসলিম ব্রাদারহুডের শাখা সংগঠন ইসলামিক অ্যাকশন ফ্রন্ট প্রধান বিরোধী দলের ভুমিকায় আছে। মরোক্কোতে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট পার্টি নামে ব্রাদারহুডের আদর্শিক রাজনৈতিক দল ২০১১ সালে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। তিউনিসিয়াতে আন নাহাদা নামে ইসলামপন্থ’ী রাজনৈতিক দলটি একাধিকবার সরকার পরিচালনা করেছে। কুয়েতের পার্লামেন্টে মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যদের অংশগ্রহন আছে। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রধান সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সম্পৃক্ত। আবার অনেক দেশে বিভিন্ন ধরনের সেবামুলক কাজের সাথে মুসলিম ব্রাদারহুড জড়িত। হাসপাতাল, এতিমখান ও বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্টান পরিচালনাসহ বিভিন্ন ধরনের মানবসেবা মুলক কাযক্রম পরিচালনা করে থাকে সংগঠনটি।
মোহাম্মদ মুরসির মৃত্যুতে রাজতান্ত্রিক আরব দেশগুলো হয়তো স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলবে। কিন্তু এই দলটির সাথে তুরস্ক ও কাতারের সাথে আরো বেশি ঘনিষ্টতা বাড়বে। কারন তুরস্ক ও কাতার মিশরের সিসি সরকারকে এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। মোহাম্মদ মুরসিকে মিশরের বৈধ প্রেসিডেন্ট হিসাবে মনে করতো তুরস্ক। তাকে একজন শহীদ হিসাবে উল্লেখ করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান। নির্বাচিত বৈধ প্রেসিডেন্টকে উৎখাতে পশ্চিমা বিশ্ব ও ইউরোপীয় দেশগুলোর নীরবতার কঠোর সমালোচনা করেছেন এরদোগান। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ গভীর দু:খ প্রকাশ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে মুরসির উৎখাত এবং কারাবন্দী অবস্থায় মত্যৃ গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করবে। আরব দেশগুলোর আভ্যন্তরিন রাজনীতিতে শুধু নয় কাতার, তুরস্ক, ইরানের সাথে সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে বিরোধপূর্ন সর্ম্পকের ওপর এর প্রভাব পড়বে।