বিন সালমান কী আর্ন্তজাতিক বিচারের মুখোমুখি হবেন?

-

  • আলফাজ আনাম
  • ২৬ জুন ২০১৯, ২০:৩৩


তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের এক তদন্ত নিয়ে নতুন করে চাপের মুখে পড়েছেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। এই হত্যাকান্ডের পর আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে সৌদি আরবের ভাব মর্যাদা দারুন ভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। এখন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বিষয়ক বিশেষ দূত অ্যাগনেস ক্যালামার্ড দাবি করেছেন, এই হত্যাকান্ডের জন্য পুরোপুরি ভাবে সৌদি আরব দায়ী। তিনি একই সাথে একথাও বলেছেন হত্যাকান্ডের বিচারের অধিকার তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রেরও রয়েছে। কারন জামাল খাশোগি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতেন আর ঘটনাটি ঘটেছে তুরস্কে। এই রিপোর্ট সৌদি আরবের সাথে তুরস্কের সর্ম্পক আরো জটিল করে তুলবে। ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া কঠিন হবে। এই রিপোর্ট নিয়ে আলোচনার আগে আমরা জামাল খাশোগি সর্ম্পকে কিছু তথ্য জেনে নেই।


জামাল খাশোগি সৌদি আরবের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার। ৩০ বছরের বেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কাজ করেছেন। জন্ম মদিনায় ১৯৫৮ সালে। তার বাবা ছিলেন রাজপরিবারের চিকিৎসক। চাচা আদনান খাশোগি ছিলেন সৌদি আরবের বিখ্যাত অস্ত্র ব্যবসায়ী। একজন সংস্কারকামী সাংবাদিক হিসেবে তিনি সৌদি শাসকদের বিভিন্ন নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন।


খাশোগি সাংবাদিকতা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। সাংবাদিকতা শুরু করেন রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ইংরেজি দৈনিক সৌদি গেজেটের সংবাদদাতা হিসেবে। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত লন্ডনভিত্তিক সৌদি মালিকানাধীন সংবাদপত্র আশ্শারাক আল আওসাতে কাজ করেছেন। একই সময় তিনি প্যান আরব সংবাদপত্র আল হায়াতেও প্রায় আট বছর লিখেছেন। সাংবাদিক হিসেবে তিনি ১৯৯০ দশকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ঘটনা কাভার করেছেন। আফগানিস্তান এবং আলজেরিয়ার ঘটনাবলির ওপর অসংখ্য সংবাদ ও সংবাদভাষ্য লিখেছেন। তিনি ১৯৯৯ সালে সৌদি মালিকানাধীন সংবাদপত্র আরব নিউজের ডেপুটি এডিটরের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি আল ওয়াতান পত্রিকার এডিটর ইন চিফের দায়িত্ব পালন করেন। সম্পাদকীয় নীতির কারণে ২০০৩ সালে তাকে পত্রিকাটি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।


সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান ও যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি রাষ্ট্রদূত প্রিন্স তুর্কি বিন ফয়সালের মিডিয়া উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন খাশোগি। ২০০৭ সালে তাকে আবার আল ওয়াতন পত্রিকার এডিটর ইন চিফ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু তিন বছর পর ২০১০ সালে তাকে আবার অব্যাহতি দেয়া হয়। তিনি সৌদি ধনকুবের প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিন তালালের মালিকানাধীন সংবাদ চ্যানেল আল আরবের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করেন। বাহরাইনের রাজধানী মানামা থেকে চ্যানেলটির কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৫ সালে চ্যানেলটি চালু হওয়ার এক দিনের মাথায় বন্ধ করে দেয়া হয়। জামাল খাশোগি রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে বিভিন্ন সময় আরব বিশ্বের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে মতামত তুলে ধরেছেন। ২০১৭ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ভার্জিনিয়ায় বসবাস করছিলেন। ওয়াশিংটন পোস্টে নিয়মিত কলাম লিখতেন। এ ছাড়া লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকাতেও লিখতেন। টুইটারে তাকে প্রায় ১৬ লাখ মানুষ অনুসরণ করত।


তিনি কনস্যুলেটে তার সাবেক স্ত্রীর ডিভোর্স-সংক্রান্ত কাগজের জন্য গিয়েছিলেন। তুর্কি এক নারী গবেষক হেতিশ চেঙ্গিসের সাথে তার বাগদান হয়েছিলো। বিয়ে করার পাশাপাশি ইস্তাম্বুলে থাকার জন্য ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। সাবেক গোয়েন্দা প্রধানের সাথে কাজ করা এবং রাজপরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে জামাল খাশোগি বহু বিষয় জানতেন, যা সাংবাদিকতার পরিচয়ের গন্ডি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তিনি সম্ভবত এই জানার রেডলাইন অতিক্রম করেছিলেন।


জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্টে খুব স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে জামাল খাসোগজিকে সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পনা করে হত্যা করা হয়েছে। এর দায় সৌদি রাষ্ট্রের। জাতিসংঘের রিপোর্ট বলছে, 'কে বা কারা এই হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা কার্যকর করেছে তা গুরুত্বপূর্ন নয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ হলো এই ব্যক্তিরা রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করেছে।' জাতিসংঘ তদন্তকারীরা আরো বলছেন, খাসোগজি হত্যার পেছনে যুবরাজ মোহাম্মদসহ সৌদি সরকারের আরো কজন ক্ষমতাবান ব্যক্তির প্রত্যক্ষ ভূমিকা তদন্তের জন্য 'বিশ্বাসযোগ্য প্রমান' তারা পেয়েছেন। সৌদি আরব অবশ্য এই রিপোর্ট প্রত্যাখান করেছে। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবায়ের বলেন, এটা নতুন কিছু নয়। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই মানবাধিকার পরিষদের দূত বারবার প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছেন।তিনি বলেন, এই প্রতিবেদনে অনেক স্পষ্ট দ্বন্দ্ব এবং ভিত্তিহীণ অভিযোগ রয়েছে যা এর গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তিনি সৌদি বিচারিক প্রক্রিয়ায় কোনরকম প্রভাব খাটানোর কথা অস্বীকার করেছেন।


ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে খেেশাগজির সঙ্গে কী ঘটেছে তা নিয়ে আলামত পর্যালোচনার পর ১০০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘের বিশেষ দূত অ্যাগনেস ক্যালামার্ড। এই প্রতিবেদন তৈরিতে তুর্কি কনস্যুলেট থেকে পাওয়া অডিও রেকর্ডিং বিশ্লেষন করা হয়।জাতিসংঘের এই তদন্ত প্রতিবেদনে খাসোগজি হত্যায় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়ে আরো তদন্তের জন্য জোর সুপারিশ করেছে। তদন্তকারীরা বলছেন, এই ঘটনায় সৌদি বিচার প্রক্রিয়ার মান গ্রহণযোগ্য নয়, এবং তা স্থগিত করা উচিৎ। যেভাবে খাসোগজিকে হত্যা করা হয়েছে সেটাকে নির্যাতন বলে বর্ণনা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে এই হত্যাকান্ড একটি 'অন্তর্জাতিক অপরাধ' এবং এর বিচারের অধিকার শুধু সৌদি আরবের নয়। এ ঘটনায় যুবরাজ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারার আগ পর্যন্ত ও তার ব্যক্তিগত সম্পদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশও করা হয়েছে। ছয় মাসের তদন্তের পর দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয় খাশোগজি উদ্দেশ্যমূলক, পূর্বপরিকল্পিত ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী এর জন্য সৌদি আরব দায়ী।’ এতে বলা হয়েছে যুবরাজের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে পর্যাপ্ত বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ প্রমানগুলো আরও তদন্তের দাবি রাখে।’ এ ব্যাপারে আর্ন্তজাতিক তদন্ত নিশ্চিতে জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এ বছরের শুরুতে একটি ফরেনসিক ও আইনি বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে তুরস্ক গিয়েছিলেন ক্যালামার্ড। তুর্কি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খাশোগি হত্যার আলামত সংগ্রহ করেন তিনি। দীর্ঘ তদন্তের পর এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।


আর্ন্তজাতিক চাপের মুখে এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৮ ব্যক্তিকে আটক করার ঘোষণা দেয় সৌদি সরকার। এরমধ্যে দুজন রহস্যজনকভাবে মারা গেছে। এ ঘটনায় সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের মিডিয়া উপদেষ্টা সউদ আল কাহতানি এবং গোয়েন্দা বিভাগের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি মেজর জেনারেল আহমেদ আল আসিরিকে বরখাস্ত করা হয়। রাজপরিবারের বাইরের এই দু’জনকে সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের ‘দুই হাত’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। খাশোগি হত্যার ঘটনায় ১১ জন সন্দেহভাজনকে বিচারের মুখোমুখি করার কথা জানিয়েছিলো সৌদি সরকার। তাদের বিচার প্রক্রিয়া চলছে অত্যন্ত গোপনে। জাতিসংঘের রিপোর্টে এই বিচারকে প্রত্যাখান করা হয়েছে।


সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ একটি স্কোয়াড এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিলো। সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের তত্ত্বাবধানেই ফিরকাত আল নিমর বা টাইগার স্কোয়াড নামে পরিচিত গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ এই ইউনিট এই হত্যাকান্ডটি ঘটায় বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে। খাশোগিকে হত্যার উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের জেনারেল সিকিউরিটি বিভাগের ফরেনসিক প্রমাণসংক্রান্ত প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সালাহ মোহাম্মদ আল তুবাইগিসহ ১৫ জনের একটি দল প্রাইভেট জেটে করে ওই দিন সকালে আঙ্কারা পৌঁছান। ২ অক্টোবর মাত্র সাত মিনিটে পুরো হত্যাকান্ড সম্পাদিত হয়েছে। দূতাবাসের কনসাল জেনারেলের অফিস থেকে খাশোগিকে টেনেহিঁচড়ে কনসাল জেনারেলের পড়ার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে হত্যা করা হয়। তুরস্কের কর্তৃপক্ষ এই হত্যাকান্ডের সময়ের কথপোকথনের রেকর্ড হাতে পায়। ফলে সৌদি আরবের পক্ষে এই ঘটনা অস্বীকার করা দুরুহ হয়ে পড়ে।


জাতিসংঘের এই তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকান্ডের নেপথ্য ব্যক্তি হিসেবে অনেকটা প্রতিষ্টিত হলেন সৌদি রাজপুত্র মোহাম্মদ বিন সালমান। মাত্র কয়েকদিন আগে আসরাক আল আওসাত পত্রিকার সাথে সাক্ষাতকারে খাশোগজি হত্যাকান্ড নিয়ে তুরস্ক রাজনীতি করছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। এখন আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে তার পক্ষে কার্যকর ভুমিকা পালন করা কঠিন হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন এখন পর্যন্ত যুববরাজের পক্ষে অবস্থান নিলেও তা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৌদি রাজপরিবারের সঙ্কট আরো জটিল রুপ নিতে পারে।