তুরস্ক-পাকিস্তান সামরিক সহযোগিতা বাড়ছে

তুরস্ক-পাকিস্তান পতাকা -

  • হাসান সেনজিক
  • ০৮ জুলাই ২০১৯, ১১:৫৬


তুরস্ক ও পাকিস্তানের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ট সর্ম্পক রয়েছে। কোল্ড ওয়ারের সময় দুই দেশ ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট মিত্র। ন্যাটাতে একমাত্র মুসলিম দেশ তুরস্ক। অপরদিকে দক্ষিন এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ট মিত্র ছিলো পাকিস্তান। আফিগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য পাঠানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তানের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। সময়ের পরিবর্তনের দুদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতার বন্ধন অনেক শিথিল হয়ে পড়ছে। বলা যায় তুরস্ক ও পাকিস্তান উভয় দেশই ঝুকে পড়ছে রাশিয়ার দিকে। একই সাথে তুরস্ক ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার সর্ম্পক বাড়ছে। চোখ ফেরানো যাক নেই এই দুদেশের মধ্যে ঐতিহাসিক সর্ম্পকের ভিত্তি কতটা শক্তিশালী সে দিকে।


পাকিস্তান ও তুরস্কের মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ট সর্ম্পকের গোড়াপত্তন হয় ১৯ শতকের শেষের দিকে। ১৮৫৩ সালের অক্টোবর মাসে তুরস্ক নিয়ন্ত্রিত দারদানেলিস প্রনালী দিয়ে যুদ্ধজাহাজ চলাচলের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং তুরস্কের খ্রিস্টানদের রক্ষার অজুহাতে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে রাশিয়া।
ক্রাইমিয়ার যুদ্ধ নাম পরিচিত এই যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে উসমানীয় বা অটোমান সাম্রাজ্যের মিত্রশক্তি হিসেবে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং সারডিনিয়া যোগ দেয় । ১৮৫৬ সালের বসন্ত কাল পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা তখনকার উসমানি সাম্রাজ্যকে আর্থিক সাহায্য ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হওয়া তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধেও ভারতীয় মুসলমানরা উসমানি খলিফাকে জোরালোভাবে সমর্থন করে। ব্রিটিশ সরকারকে চাপে রাখতে ভারতীয় উপমহাদেশব্যাপী শুরু হয় খিলাফত আন্দোলন। এছাড়াও তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধে আর্থিক সাহায্য হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম নারীদের স্বর্ণালংকার প্রেরণের ঘটনা দুই মুসলিম জাতির ঐতিহাসিক সর্ম্পকের ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।তখনকার এই সহযোগিতা বা সমর্থন ভারতীয় উপমহাদেশের তথা বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের মুসলমানদের সামষ্টিক প্রচেষ্টা হলেও বিষয়টিকে পাকিস্তান-তুরস্কের ঐতিহাসিক সর্ম্পকের মূল ভিত্তি বলে ধরে নেয়া হয়।


আধুনিক তুরস্ক ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় ১৯৪৭ সালে। ব্রিটিশ ভারত ভেঙে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র জন্ম নেওয়ার কিছুদিন পরেই। ভারত ও পাকিস্তানের বিভক্তির পর যে দেশগুলো খুব দ্রত পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দেয় তুরস্ক তাদের মধ্যে অন্যতম। পাকিস্তানের জাতিসংঘ সদস্য পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে তুরস্কের ভূমিকা অপরিসীম। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান ব্রিটিশ মুদ্রা ব্যবহারের পরিবর্তে "রুপি " নামে নিজস্ব মুদ্রা চালু করে এবং তখন তুরস্ক এই নতুন রুপি মুদ্রনের দায়িত্ব নেয়।


বিংশ শতাব্দীতে দুই দেশের সম্পর্কে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক গন্ডির বাইরেও পারস্পরিক আন্তর্জাতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, সামরিক, নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক সহযোগিতাসহ আরও অনেক দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক বিষয় যুক্ত হয়েছে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ, আরব বিশ্বে তুরস্ক ও কাতারের মধ্যে সঙ্ঘাতের কারণে সীমান্তে নতুন ঝুঁকির মোকাবেলা করতে হচ্ছে তুরস্ককে। অপরদিকে আফগানিস্তানে অস্থিতিশীল যুদ্ধের কারণে পাকিস্তান -যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এছাড়া বিগত কয়েক বছর ধরে তুরস্ক ও পাকিস্তান উভয়ের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক মোটেই ভালো যাচ্ছে না। তুরস্কের সাথে ইউরোপিয় ইউনিয়নের সমস্যা সঙ্কুল সর্ম্পকের কারণে বাইরে বন্ধুর সংখ্যা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছে আঙ্কারা। পাকিস্তানের মতো পরমানু শক্তিধর মুসলিম দেশ পাশে থাকা তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির বড় সাফল্য হিসাবে দেখা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে তুরস্ক নিজেকে ইসলামাবাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে তুলে ধরেছে। একই সাথে দুদেশের মধ্যে বাড়ছে সামরিক সহযোগিতার সর্ম্পক।


আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি তুরস্ক ও পাকিস্তানকে গভীর মিত্রতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমরাস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আঙ্কারা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্ক ও পাকিস্তান প্রায় ৬০টি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ২০০৩ সালে গঠিত দুদেশের সামরিক কনসালটেশান গ্রুপকে উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতা কাউন্সিলে উন্নীত করা হয়েছে। চীনের পর তুরস্ক এখন পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমরাস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। ২০১৮ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে ইতিহাসের সর্ব বৃহৎ সামরিক সরঞ্জাম চুক্তি।


এই চুক্তির আওতায় পাকিস্তান তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি ৩০টি সামরিক অ্যাটাক হেলিকোপটার ক্রয় করে। এর মূল্যমান ধরা হয় দেড় বিলিয়ন ডলার বা এক হাজার ২৬০ কোটি টাকা। অন্যদিকে তুরস্ক পাকিস্তানে নির্মিত কয়েক ডজন প্রশিক্ষন বিমান নেয়ার চুক্তি করে। আঙ্কারা পাকিস্তান থেকে এমএফআই -১৭ সুপার মুশশাক বিমান কেনার পাশাপাশি পাকিস্তানের তিনটি সাবমেরিন আপগ্রেড এবং যৌথভাবে একটি ফ্লিট ট্যাংকার নির্মাণের চুক্তি করে।
২০১৮ সালের অক্টোবরে, পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ হয় ১৭ হাজার টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এক অত্যাধুনিক জাহাজ। তুর্কি প্রতিরক্ষা কোম্পানি এসটিএমের সহযোগিতায় নির্মিত এই জাহাজটি এখনো পর্যন্ত পাকিস্তানে নির্মিত সর্ববৃহৎ সামরিক জাহাজ।


২০১৮ সালের জুলাই মাসে, পাকিস্তান নৌবাহিনীকে সরবরাহের জন্য চারটি করভেট রণতরি নির্মাণের একটি মাল্টিবিলিয়ন ডলারের টেন্ডার জিতে নেয় তুরস্কের প্রতিরক্ষা প্রতিষ্টান। পাঁচ বিলিয়ন ডলার বা ৪১ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা মূল্যমানের এই টেন্ডারটিকে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রফতানি চুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। চুক্তিমতে দুটি জাহাজ নির্মাণ করা হবে ইস্তাম্বুলে এবং বাকি দুটি করাচিতে।


তুরস্ক পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর এফ-১৬ জঙ্গি বিমান আপগ্রেড করার ব্যাপারেও সহায়তা করেছে। তুরস্ক ও পাকিস্তান শিগগিরই একসাথে মিলে যৌথভাবে নিজস্ব জেএফ-১৭ জঙ্গি বিমান তৈরি করতে পারে। এর পর তারা স্টেলথ ফাইটার বিমান তৈরির দিকে যেতে পারে। একটি আর্ন্তজাতিক গনমাধ্যমকে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন পাকিস্তানের একজন সেনা কর্মকর্তা।


ড্রোন তৈরির ব্যাপারে দুই দেশ এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তুরস্ক ও পাকিস্তানি সেনারা উজবেকিস্তানে উজবেক বাহিনীর সাথে যৌথ সন্ত্রাস বিরোধী মহড়ায় অংশ নেয়। গত এক দশকে পাকিস্তানের প্রায় ১৫০০ সামরিক কর্মকর্তা তুরস্কে প্রশিক্ষন নিয়েছে।


আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলেও তুরস্ক ও পাকিস্তান পরস্পরকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তান যখন নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্র্স গ্রুপে যোগ দেয়ার চেষ্টা করে বা ফিনান্সিয়াল অ্যাকশান টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) যখন পাকিস্তানকে গ্রে লিস্টভুক্ত করেছিল, তখন একমাত্র দেশ হিসেবে পাকিস্তানকে সমর্থন দেয় তুরস্ক। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বিষয়ে পাকিস্তানকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দেয় তুরস্ক। পাকিস্তান তেমনই তুর্কি সাইপ্রাসেও আঙ্কারার নীতিকে সমর্থন করে। ২০১৬ সালে সামারিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণাৎ এরদোগান সরকারকে সমর্থন দেয় পাকিস্তান। সামরিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতার গন্ডি পেড়িয়ে ব্যবসায়- বানিজ্যের ক্ষেত্রে দুদেশের মধ্যে সর্ম্পক ঘনিষ্টতা বাড়ছে। যা এ অঞ্চলে কৌশলগত প্রভাব বাড়াতে বিশেষ ভুমিকা রাখছে।


ইস্তাম্বুল -তেহরান-ইসলামাবাদের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্য করিডোরের উদ্বোধন করা হয় ২০১৮ সালের এপ্রিলে। এই রুটটি ইরান, মধ্য এশিয়া, তুরস্ক ও ইউরোপকে যুক্ত করবে। যার বানিজ্য সম্ভাবনা অপরিসীম। এই বানিজ্য রুটের মধ্যদিয়ে তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে ঘনিষ্ট মিত্রতার বন্ধন তৈরি হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেখানে রয়েছে চীনের নীরব সমর্থন। কারন পাকিস্তানের বন্দরে রয়েছে চীনের বিপুল বিনিয়োগ।


২০১৭ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী পাকিস্তানে তুরস্কের বিনিয়োগ সাত হাজার পাঁচ শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পাকিস্তানে অনেক আধুনিক হাসপাতাল পরিচালনা করছে তুরস্ক । লাহোরের সবচেয়ে বড় ট্যাক্সিক্যাব কোম্পানিগুলোর একটি তুরস্ক মালিকানাধীন। লাহোর শহরের ট্রাফিক সিস্টেম এবং ময়লা-আবর্জনা পরিচ্ছন্ন কোম্পানিও তুর্কির। এছাড়াও দেশটির টেক্সটাইল, রাস্তা নির্মাণ এবং ভবন নির্মাণে কাজ করছে অনেক তুর্কি কোম্পানি। আঙ্কারা এবং ইসলামাবাদ শিগ্রই একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে আগ্রহী। দুদেশের নাগরিকদের ভ্রমণব্যবস্থাকে আরও সহজকরণের লক্ষে ভিসামুক্ত ভ্রমণের বিষয়ে আলোচনা চলছে।


দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্ব ব্যবস্থায় সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ধরন বদলে যাচ্ছে। বিশে^র নানা অঞ্চলে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির উন্থান ঘটছে। পারস্পরিক সর্ম্পক সেভাবে নির্ধারিত হচ্ছে। এক সময়ের সৌদি আরবের ঘনিষ্ট মিত্র পাকিস্তানের সাথে তুরস্ক ও ইরানের এই মিত্রতা আঞ্চলিক রাজনীতির গতি বদলে দিচ্ছে।